সাধারণত জ্যেষ্ঠ -আষাঢ় মাসের দিকে এই খাদ্যাভাব
বা দুর্ভিক্ষ (ভাদ’ রাদ) দেখা দেয়।
রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার মিজোরাম
সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন হলো সাজেক। এখানে কাজলং, গঙ্গারাম ও সাজেক এই তিন ভ্যালিতে ১৭৪টি
গ্রামে মোট ৮৭০০ পরিবার বাস করে, যাদের অধিকাংশই পাহাড়ি জুম চাষী। এছাড়া বাঘাইহাটে
কয়েক শ’ বাঙালি পরিবারও রয়েছে, তারা মূলত ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে জড়িত এবং আর্থিকভাবে
মোটামুটি স্বচ্ছল।
সাজেকবাসীর এই দুরাবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি।
২০০৫-৬ সালে বাঘাইহাট থেকে রুইলুই পযন্ত সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি পাকা সড়ক নির্মাণ
করা হয়। এরপর সেখানে পযটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে প্রতিদিন শত শত পযটকের আগমণ ঘটে। আর
এতে লাভবান হয় এই ব্যয়বহুল শিল্পের সাথে জড়িত বিত্তশালী কিছু বাঙালি।
অপরদিকে সাজেকের গরীব পাহাড়ি জুমচাষীরা
এই পযটন থেকে সুবিধা পাওয়া দূরের কথা, তারা গরীব থেকে আরও গরীব হয়ে পড়ে।
এছাড়া পাকা রাস্তা হওয়ায় সেখানকার বিশাল
প্রাকৃতিক ও বনজ সম্পদ কয়েক বছরের মধ্যে উজার হয়ে গেছে। ব্যবসায়ী শ্রেণী কর্তৃক শোষণের
দ্বার হয়েছে অবারিত। জুম চাষের এলাকা হয়ে পড়ে সীমিত। আর জুমে উৎপাদনও কমে যায়।
আগে যেখানে এক আড়ি পরিমাণ (১০ কেজি) ধান
রোপন করলে সারা বছরের খাবার জোগাড় হতো, বর্তমানে জুম থেকে কয়েক মাসের খোরাকীও পাওয়া
যায় না।
সাজেকের লোকজন মূলত জুমে উৎপাদিত পণ্যের উপর নির্ভরশীল। এ
বছর নভেল করোনা ভাইরাসের মহামারীর কারণে বাজার বন্ধ ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায়
তারা তাদের উৎপাদিত কাঁচামাল যেমন আদা, হলুদ, কলা, ফুলঝাড়ু ইত্যাদি বিক্রি করতে পারছে
না। সেসব এখন অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
অপরদিকে বেশ কয়েকটি গ্রামে হামের প্রাদুর্ভারের কারণে জুমের কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে এবং চিকিৎসা করতে জমানো টাকাও ফুরিয়ে গেছে।
অপরদিকে বেশ কয়েকটি গ্রামে হামের প্রাদুর্ভারের কারণে জুমের কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে এবং চিকিৎসা করতে জমানো টাকাও ফুরিয়ে গেছে।
কর্ণফুলি পেপার মিলের জন্য বাঁশ কেটেও
অনেকে কিছু অর্থ উপার্জন করে থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছর বাঁশ সস্তা হওয়ায় বাঁশ কেটে
বিক্রি করেও লাভ হয় না। যে পরিশ্রম ও অর্থ খরচ করে বাঁশ সংগ্রহ করা হয়, বাজারে বিক্রি
করে সে টাকাও তোলা যায় না। ফলে রোজগারের এ উৎসও অনেকটা বন্ধ বলা যায়।
এক সময় বাঁশ কাটার পাশাপাশি সওদাগরদের
জন্য গাছ কেটেও উপার্জনের একটা পথ খোলা ছিল। কিন্তু ইদানিং সে গাছও ফুরিয়ে গেছে। রাস্তা
হওয়ার পর কয়েক বছরের মধ্যে বিশাল বিশাল গাছ সাবাড় হয়ে যায়।
এসব কারণে সাজেকবাসীর জীবনধারণের জন্য
উপার্জনের ক্ষেত্র বেশ সীমিত হয়ে পড়েছে। তাদের বর্তমান এই দুরাবস্থা ও দারিদ্র্যের
জন্য তারা প্রধানত বাঘাইহাট-রুইলুই পাকা সড়ককেই দায়ি করে থাকেন।
করোনাভাইরাসের কারণে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে না পারলেও
তাদেরকে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। আগে যেখানে অতি সাধারণ
মানের চালের দাম বস্তা প্রতি (৫০ কেজি) ১৩০০ টাকা, বর্তমানে তার দাম বেড়ে হয়েছে ১৮০০
টাকা। বস্তা প্রতি ১৬০০ টাকা দামে যে চাল বিক্রি হতো তা এখন ২২০০/২৩০০ টাকা। এ অবস্থায়
বহু পরিবার অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে।
গত সপ্তাহে কিছু পরিবারকে ২০ কেজি করে
চাল দেয়া হয়। কিন্তু সে ত্রাণের চাল সংগ্রহ করতে দূরবর্তী গ্রামের লোকজনকে যে টাকা
খরচ করতে হয়, তা ঐ ২০ কেজি চালের যে দাম তার থেকেও বেশী। তাছাড়া ঐ ত্রাণ আনতে তাদের
পুরো দিনটি মাটি হয়ে যায়, সেদিন আর কোন কাজ হয় না। এ কারণে গ্রামবাসীরা গ্রামে গ্রামে
গিয়ে অথবা নিকটবর্তী স্থানে গিয়ে ত্রাণ সরবরাহ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
সাজেকে খাদ্য সংকট মোকাবিলা করতে সরকার
ও অন্যান্য সংস্থাকে প্রতিবছর ত্রাণ সরবরাহ করতে হয়। এবছরও তার ব্যতিক্রম হবে না। খাদ্য
সংকট সাজেকে যেন ক্রনিক ডিজিজ এবং ত্রাণ বিতরণ একটি রুটিন কাজ হয়ে গেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো এভাবে ত্রাণের উপর নির্ভর
করে কত বছর পরিস্থিতি সামাল দেয়া হবে বা যাবে? সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত
সাজেকবাসীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ
বা কর্মসুচি গ্রহণ করা।
-----