""

পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন, বন ও পরিবেশ সম্পর্কে

 শৈলেন চাকমা, বৃশ্চিক ত্রিপুরা


পর্যটন যে বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের জন্য এক বিরাট হুমকি তা খোদ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক সুপারিশে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে। গত ২১ ডিসেম্বর (২০২০) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ‘বন বিভাগও চায় নির্বিচার পর্যটন বন্ধ রাখতে’ শিরোনামে এক সংবাদ প্রকাশিত হয়, যেখানে সরকারের উক্ত দুই সংস্থা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও প্রতিবেশ বাঁচানোর জন্য পর্যটকদের মুক্ত বিচরণে বাধা-নিষেধ আরোপের সুপারিশ করেছে।

উক্ত সংবাদে বলা হয়, “কোভিড—১৯ মহামারীর ‘লকডাউনের’ সময় ‘জীববৈচিত্র্যের অবস্থার উন্নতি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে লকডাউনের সময় পরিবেশের ‘ফিরে আসা’ তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশকে পুনরুদ্ধারে প্রথম পদক্ষেপই হবে মানুষের নির্বিচারে পর্যটন বন্ধ করা।’ বাংলাদেশে দুই মাসের বেশী করোনা লকডাউনের সময় প্রকৃতি কীভাবে নিজেকে পুনরুদ্ধার করেছে রিপোর্টে সে সম্পর্কে তুলে ধরা হয়। বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোভিড—১৯ এর কারণে লকডাউনের সময় মাঠ পর্যায় থেকে আমরা যে তথ্য পেয়েছি, তাতে দেখা গেছে পর্যটন বন্ধ থাকায় বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণীদের উপর পজিটিভ সাইন এসেছে।” পরিবেশ বিশেষজ্ঞ সেন্টার ফর গ্লোবাল চেঞ্জের নির্বাহী পরিচালক আহসান উদ্দিন আহমেদের মতে গত ৪০ বছরে গ্রামগুলোতে সবুজের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সবুজ কমেছে।

অবারিত পর্যটন কেবল বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি নয়, তা বনের সাথে ঘনিষ্টভাবে যাদের জীবন বাঁধা সেই সংখ্যালঘু জাতিগুলোর অস্তিত্বও বিপদাপন্ন করে তুলেছে। বান্দরবানের চিম্বুকসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের ফলে বহু পাহাড়ি পরিবার জমা—জমা হারিয়ে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে, তাদের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। বর্তমানে চিম্বুক পাহাড়ে নতুন একটি পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে সেখানে ম্রো জাতির জনগণ তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

চিম্বুক পাহাড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে পাঁচতারকা হোটেল


পর্যটন শিল্প হলো মূলতঃ একটি মুনাফা—তাড়িত কর্মকাণ্ড। ব্যক্তিগত মুনাফাই এই শিল্পে বিনিয়োগের একমাত্র আকর্ষণ। বন, বন্যপ্রাণী, প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষ, প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থ এই শিল্পের উদ্যোক্তাদের কাছে উপেক্ষিত থেকে যায়। বন উজার হলো, না বন্যপ্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হলো, নাকি মানুষকে উচ্ছেদ হতে হলো এতে তাদের কিছুই যায় আসে না। মুনাফা এবং মুনাফাই হলো তাদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। এ কারণে পর্যটন পার্বত্য চট্টগ্রামে মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতির জন্য সুফল বয়ে আনলেও তা বন, জীববৈচিত্র্য ও সেখানকার অধিবাসীদের জন্য এক বিরাট অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে।

তবে এখানে একটি কথা বলা দরকার। অন্যান্য শিল্প (ইন্ডাস্ট্রি) থেকে এই শিল্পের কিছু পার্থক্য রয়েেছে। অন্যান্য মৌলিক শিল্পে পুঁজির মালিককে মুনাফার জন্য পণ্য উপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু পর্যটনের বেলায় সেটা হয় না। এখানে মুনাফার জন্য ফিনিশ্ড গুডস—এর দরকার হয় না। স্বয়ং প্রকৃতিকে এখানে পণ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু এখানে একটি দ্বান্দ্বিকতা কাজ করে। যাকে ভিত্তি করে (প্রকৃতি) পুঁজিপতিরা পর্যটন শিল্প গড়ে তোলে, তাদের কর্মকাণ্ড সেই ভিত্তিকেই ধ্বংস করে।

পর্যটনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে রাস্তাঘাট অন্যতম। কিন্তু যত্রতত্র আধুনিক পাকা রাস্তা পার্বত্য চট্টগ্রামে বন ও প্রকৃতির উপর কী বিরূপ প্রভাব ফেলছে তার কোন হিসাব রাখা হয় না। গবেষক স্বপন আদনান পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক এক গবেষণামূলক গ্রন্থে বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যেদিকে পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, সেদিকের বন উজাড় হয়ে গেছে। তার এই পর্যবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তা বাস্তব সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তা সত্বেও তার এই গবেষণা—লব্ধ পর্যবেক্ষণকে সরকারের নীতি নির্ধারকগণ আদৌ আমলে নিয়েছেন বলে মনে হয় না।

স্বপন আদনানের পর্যবেক্ষণের সত্যতা ও যথার্থতা প্রমাণের জন্য একটি উদারহণ দেয়া যেতে পারে। রাঙামাটির পর্যটন কেন্দ্র সাজেক এক সময় ঘন গহীন বনে আচ্ছাদিত ছিল। বাঘ, ভালুক, হাতিসহ বহু প্রাণীর অভয়ারণ্য ছিল এই এলাকা। কিন্তু ২০০৫—৬ সালে বাঘাইহাট থেকে রুইলুই পর্যন্ত পাকা সড়ক নির্মাণ করা হলে কয়েক বছরের মধ্যেই সাজেকের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল সাবাড় হয়ে যায়। কারণ পাকা সড়ক নির্মাণের কারণে ব্যবসায়ীদের সেখানকার গাছ আহরণের স্বর্ণ দুয়ার খুলে যায়। যেখানে যুগের পর যুগ জুম চাষ করেও বনের কোন ক্ষতি হয়নি, রাস্তা হওয়ার পর গাছ ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক চর্চায় ২/৩ বছরের মধ্যেই সেই বন ধ্বংস হয়ে যায়। আর বন্য হাতি, বাঘ ইত্যাদি প্রাণীগুলো হয় ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে নতুবা বিলুপ্তির পথে রয়েছে।

শুধু সাজেক নয়, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে বনাঞ্চল কমে যাওয়ার কারণে বর্তমানে বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব চরম হুমকির মুখে। ইদানিং শোনা গেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে বাঘ ছেড়ে দেয়া হলে টিকে থাকতে পারবে কী না সে ব্যাপারে গবেষণা করা হচ্ছে। এই তথ্য কী ভয়াবহ বাস্তবতার সাক্ষ্য দেয় তা সকলেরই বোঝা উচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে বন কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এই অঞ্চল বাঘের মতো বন্যপ্রাণীদের জন্য কীরূপ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, এটা তারই প্রমাণ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও পরিবেশের কেন এমন দুর্দশা হলো তার কোন বিস্তারিত গবেষণা আজ অবধি হয়নি। সরকারের মধ্যে সে রকম চিন্তাভাবনাও দেখা যায় না। যা দেখা যায় তা হলো কীভাবে বন ও জীববৈচিত্র্যের আরও ক্ষতি করা যায় সে ব্যাপারে কর্মতপরতা। যেমন সরকার বর্তমানে বনের জন্য ক্ষতিকর বেশ কয়েকটি রাস্তা নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছে। তার মধ্যে রাঙামাটির সাজেকে সিজকছড়া গ্রাম থেকে পূর্বে মিজোরাম সীমন্ত পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার,  খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ধনপাদা থেকে নারেইছড়ি পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার ও পানছড়ি থেকে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত বরাবর নারেইছড়ি পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে। এই রাস্তাগুলো নির্মাণ করা হলে ঐ অঞ্চলের বন যে পুরোপুরি সাবাড় হয়ে যাবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন কেবল সাজেক অঞ্চলে কিছু গভীর বন অবশিষ্ট আছে। এই রাস্তার কারণে তাও শেষ হয়ে যাবে।

সাজেকে বন ধ্বংস করে কাটা হচ্ছে মাটি


এছাড়া সাজেকে পর্যটক আকর্ষণের জন্য সিজকছড়ায় একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই বাঁধ নির্মাণ করা হলে দুই শত পাহাড়ি পরিবার উচ্ছেদ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সরকার দিনরাত বন ও পরিবেশ রক্ষার কথা বলে থাকে। কিন্তু মুখে এসব কথা বললেও বাস্তবে তার কাজ হলো উল্টো। পার্বত্য চট্টগ্রামে বনের ভেতর রাস্তা ও পর্যটন বন-প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হওয়া সত্বেও সরকার এখনও সেসব বন্ধ করছে না, বরং অপ্রয়োজনীয় নতুন নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ করে চলেছে এবং পর্যটনের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার ঘটাচ্ছে।

উপরে যে রাস্তার কথা বলা হয়েছে সেগুলোর আসলে কোন প্রয়োজন নেই। যে এলাকায় রাস্তাগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে জনবসতি নেই বললেই চলে। তাই রাস্তাগুলোর তেমন ব্যবহারও হবে না। ধনপাদা — নারেইছড়ি রাস্তাটি কেবলমাত্র একটি বিজিবি টহল পোস্টের সুবিধার জন্য তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এই রাস্তাটিরও প্রয়োজন নেই। কারণ উক্ত বিজিবি পোস্টে যাওয়ার জন্য সহজ বিকল্প নৌপথ রয়েছে, যে পথ দিয়ে বর্তমানে বিজিবি ও সাধারণ লোকজন যাতায়াত করে থাকে। আর পানছড়ি থেকে নারেইছড়ি পর্যন্ত রাস্তাটি যে দিকে নেয়া হবে সেদিকে কোন জনমানবের বসতি নেই। নতুন রাস্তা হলে বসতি গড়ে উঠবে এবং সে এলাকার সমস্ত বন উজার হয়ে যাবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও বনজ সম্পদ কেবল পাহাড়ি বা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের নয়, তা দেশের সম্পদ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের পরিবেশবাদীরা, বুদ্ধিজীবী তথা প্রগতিশীলরা সুন্দরবনের জন্য যতটা সোচ্চার, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় ততটা নীরব। পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও পরিবেশ রক্ষার জন্য এখনই দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে উঠা দরকার।

 

সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।





0/Post a Comment/Comments