মাটিরাঙ্গা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ৯ এপ্রিল ২০২১
‘তারুণ্যর শক্তিকে সমাজ-জাতির কল্যাণে নিয়োজিত করো’ এই শ্লোগানে মদ-জুয়া-ডাব্বো তথা সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় ছাত্র-যুব-নারী সম্মেলন করেছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।
আজ শুক্রবার (৯ এপ্রিল ২০২১) সকাল ১১টায় ইউপিডিএফ’র মাটিরাঙ্গা-গুইমারা
ইউনিটের উদ্যোগে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে এলাকার ছাত্র, যুবক ও নারীরা অংশগ্রহণ
করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার দাবি আদায়ের আন্দোলন শহীদদের সম্মানে দাঁড়িয়ে
২ মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শুরু হয়।
সম্মেলন মঞ্চে দু’টি ফেস্টুনের শ্লোগান সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র,
যুবক ও নারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এর একটিতে লেখা ছিল “হে তারুণ্য, তোমার দিকে চেয়ে
থাকে নতুনেরা জানি; তুমি দেখাবে সাহস, ভাঙবেই শৃঙ্খল পরাধীনতার গ্লানি”, আরেকটিতে লেখা
ছিল “শাসকের অত্যাচার-দমনে ভীত না হয়ে আদর্শিকভাবে লড়াই করি”।
এছাড়া সম্মেলন স্থলে “প্রচলিত আইনে নয়, প্রথাগত আইনে ভূমি অধিকার চাই”;
“পার্বত্য চট্টগ্রাম জনগণের ন্যায্য দাবি পূর্ণস্বায়ত্তশাসন মেনে নিন’ এসব দাবি সম্বলিত
লেখা ফেস্টুনও ছিল।
সম্মেলনে ইউপিডিএফ’র মাটিরাঙ্গা ইউনিটের সংগঠক তৈফাং ত্রিপুরার সভাপতিত্বে
ও গুইমারা ইউনিটের সদস্য তানিমং মারমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফ সংগঠক ঝিমিত
চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক শুভ চাক, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের
কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক নীীত চাকমা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের
কেন্দ্রীয় সদস্য রোনাল চাকমা ও খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিনিধি শান্ত চাকমা এবং গণতান্ত্রিক
যুব ফোরামের মাটিরাঙ্গা উপজেলা সভাপতি নন্দ লাল ত্রিপুরা।
ইউপিডিএফ সংগঠক ঝিমিত চাকমা সম্মেলনে আসা ছাত্র, যুবক ও নারীদের ধন্যবাদ
জানিয়ে বলেন, আজকের এই সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলনের মাধ্যমে আপনাদের
মাধ্যমে আমরা সমাজের কাছে একটি সুন্দর বার্তা নিয়ে যেতে পারবো।
তিনি বলেন, এই অঞ্চলের পাহাড়িদের অবস্থা যে শোষণীয় তা আমরা সবাই জানি। একদিকে বাঙালি সেটলারদের সংখ্যা যেমন দিন দিন বৃদ্ধি ঘটছে, অপরদিকে মদ, জুয়া প্রবণতার কারণে পাহাড়িরা দিন দিন নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। বেদখল হয়ে যাচ্ছে পাহাড়িদের বংশপরম্পরার ভিটেমাটি, জায়গা-জমি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ছাত্র, যুবক ও নারীদেরকে সচেতন হতে হবে এবং সমাজ ও জাতির মঙ্গলের জন্য নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে।
যুব ফোরাম নেতা শুভ চাক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা পাহাড় জুড়ে সেটলার
ও রাষ্ট্র দ্বারা যে ভূমি জবরদখল চলছে তা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করতে হবে। সরকার
আমাদের ভূমিগুলো নানা কায়দায় কেড়ে নিচ্ছে। সংরক্ষিত বন, পর্যটন, কথিত উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয়
বিভিন্ন বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের নামে চলছে এই ভূমি জবরদখল। ফলে আমরা পাহাড়িরা নিজ
ভূমিতে বসবাসের মতো নিরাপত্তা পাচ্ছি না।
তিনি আরো বলেন, শাসকগোষ্ঠী পাহাড়িদের মধ্যে জাতিগত নানা বিভেদ সৃষ্টি
করে আমাদের ঐক্য শক্তিকে বিনষ্ট করে দেয়ার চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে আমাদের
সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। আমাদেরকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তের
বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সমাজ-জাতি, ভাষা-সংস্কৃতি তথা জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম
জোরদার করতে হবে। আর এক্ষেত্রে ছাত্র, যুব ও নারী সমাজকে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে
হবে।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী নীতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ
সারাদেশে নারীদের উপর যে সহিংসতা, অত্যাচার তা সহনশীল মাত্রার বাইরে পৌঁছেছে। কিন্তু
নারী নির্যাতনের সাথে জড়িত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক কোন সাজা হচ্ছে না। পাহাড়ে কল্পনা
চাকমা অপহরণ ও তুমাচিং, উমাচিং সুজাতা, কৃত্তিকাসহ অসংখ্যা নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা
করা হলেও আমরা কোন সুষ্ঠু বিচার পাইনি। তিনি এর জন্য সরকারের উদাসীনতা ও বিচারহীনতাকেই
দায়ি করেন।
তিনি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, সম্মেলনে অংশগ্রহণ
করাটা বড় নয়, আমাদের সচেতন হওয়াটাই এখন সবচেয়ে জরুরি। আমরা যতই সচেতন হবো, নিজেকে
বুঝতে ও জানতে পারবো এবং নিজের সংস্কৃতিকে লালন করতে পারবো ততই আমরা এগিয়ে যেতে পারবো।
আমরা নারীরা সচেতনভাবে এগিয়ে যেতে পারলে আমাদের সমাজ ও জাতি এগিয়ে যাবে। তাই এই সময়ে
আমাদেরকে সচেতন হয়ে নারীর নিরাপত্তা ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার
জন্য আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা রোনেল চাকমা বলেন, সমতল ও পাহাড়ের শিক্ষা
ব্যবস্থার মধ্যে বিরাট তফাৎ। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে। আমাদের পাহাড়ে
যে কচি কচি কোমলমতি শিশুরা রয়েছে তাদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা শিখানো খুবই জরুরি।
কারণ তারা নিজেদের মাতৃভাষায় যেভাবে সহজে শিখতে পারবে, অন্য ভাষায় তা পারবে না। তাই
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ প্রাথমিক স্তরে সকল জাতিসত্তার মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর
দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার এখনো পর্যন্ত যথাযথভাবে এটা কার্যকর করতে পারেনি। তাই
আমাদেরকে এই দাবি আরো জোরালো করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদেরও এই দাবি নিয়ে সোচ্চার হতে
হবে।
তিনি আরো বলেন, একজন ছাত্রকে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পড়ে থাকলে হবে
না, তাকে সমাজ, জাতি ও অধিকার সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। অধিকার অর্জনে ছাড়া একটি জাতি
কখনো অগ্রগতি লাভ করতে পারে না। তাই অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্র সমাজকে আন্দোলনে আগুয়ান
হয়ে কাজ করতে হবে।
তিনি উপস্থিত ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা রাজনৈতিকভাবে
সচেতন হোন। সমাজকে জাগিয়ে তুলুন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে লড়াইয়ে সামিল হোন।
যুব ফোরামের মাটিরাঙ্গা উপজেলা সভাপতি নন্দলাল ত্রিপুরা বলেন, গুইমারা,
মাটিরাঙ্গা উপজেলার যুব সমাজের অবস্থা খুবই হতাশাজনক। তারা নিজেরাই নেশা ও জুয়ায় আসক্ত
হয়ে পড়ছে। অপরদিকে সমাজের মুরুব্বীমহলও সচেতন নয়। বর্তমানে মদ-জুয়া-ডাব্বো-শিলং তীর
এই এলাকার সমাজ ব্যবস্থাকে কলুষিত করছে। তাই সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ থেকে এসব
দূর করতে হবে।
তিনি বলেন, শাসকগোষ্ঠী চায়, আমাদের যুব সমাজ মদ, জুয়ায় আসক্ত হয়ে আন্দোলনবিমুখ
হয়ে পড়ুক। তাই এ ব্যাপারে যুব সমাজকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ-এর খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিনিধি শান্ত চাকমা বলেন, আজকে
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বড়ই নাজুক। শিক্ষা আজ বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের
শিক্ষা ব্যবস্থা আরও করুণ। এখানকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ
পায় না। কারণ সরকার প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ না করে ফাইভ স্টার
হোটেল, পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ করে থাকে।
তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই সরকারের
বিশেষ মহলের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। ফলে সৃষ্টিশীল কোন কাজ করতে গেলে শিক্ষার্থীরা
নানা বাধার সম্মুখীন হয়। অপরদিকে জেলা পরিষদ লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষের বিনিময়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের
শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার তালেই রয়েছে।
তিনি অধিকার সচেতন হয়ে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে সামিল হওয়ার জন্য
ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।
পরে মদ-জুয়া-ডাব্বো তথা সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি ও
প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সকলে হাত উঁচিয়ে শপথ গ্রহণ করেন।