""

২০২১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা ১৪৮ জনকে গ্রেফতার, ৯১ জনকে নির্যাতন, ১৪৩ বাড়ি-ঘরে তল্লাশি

 ইউপিডিএফের মানবাধিকার পরীবিক্ষণ সেলের বার্ষিক রিপোর্টের তথ্য

রিপোর্টে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী কর্তৃক খুন-অপহরণ; ভূমি বেদখল; নারী নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে


নিজস্ব প্রতিবেদক, সিএইচটি নিউজ।। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা অন্যায় গ্রেফতার, শারীরিক নির্যাতন, বেআইনি তল্লাশি, হয়রানি; রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী কর্তৃক খুন-অপহরণ; সাম্প্রদায়িক হামলা; ভূমি বেদখল ও নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য তুলে ধরে ২০২১ সালের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ইউপিডিএফ’র মানবাধিকার পরীবিক্ষণ সেল।

গতকাল ৮ জানুয়ারি ২০২২ এ রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়। এতে ২০২১ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক ১৪৮ জনকে গ্রেফতার, ৯১ জনকে শারীরিক নির্যাতন, ১৪৩টি বাড়ি-দোকাঘরে বেআইনি তল্লাশি, গুলি করে ৩ জনকে আহত করা; রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী কর্তৃক ৯ জনকে খুন, ২৮ জনকে অপহরণ, ৬ জনকে মারধর; ৪টি সাম্প্রদায়িক হামলা; সেটলার বাঙালি কর্তৃক ২ জনকে খুন; ২৯ জন নারী-শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন ও সেনা-সেটলার কর্তৃক ভূমি বেদখলের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

রিপোর্টে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী বিশেষত সেনাবাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৭ সালের চুক্তির পরও তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন থেমে নেই। তাদের বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভুত হত্যা, গ্রেফতার, শারীরিক নির্যাতন, ঘরবাড়িতে তল্লাশি, হয়রানি, ভূমি বেদখল ইত্যাদির অভিযোগ রয়েছে।

অন্যায় গ্রেফতারের তথ্য তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, ২০২১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক অন্তত ১৪৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ৯ জন, এপ্রিলে ৮ জন, মে মাসে ৬ জন, জুনে ১৬ জন, জুলাইয়ে ১৪ জন, আগস্টে ২০ জন, সেপ্টেম্বরে ১৩ জন, অক্টোবরে ১৫ জন, নভেম্বরে ১৪ জন এবং ডিসেম্বরে ১৪ জন গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ইউপিডিএফের ৩৪ জন কর্মী-সমর্থক ও জেএসএস-এর ৭জন কর্মী রয়েছেন। বাকী সবাই সাধারণ লোকজন। গ্রেফতারের তালিকায় ছাত্র ও জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন। আর জেলগেট থেকে ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্য থেকে নির্যাতন ও হয়রানি শেষে ৩৮ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, ১৩ জন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।

উক্ত রিপোর্টে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক শারীরিক নির্যাতন, ঘরবাড়িতে বেআইনি তল্লাশি-লুটপাট, গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে বাধাদান, গুলিবর্ষণ ও হয়রানির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, ২০২১ সালে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯১ জন; তল্লাশি চালানো হয় ১৪৩টি বাড়ি ও দোকানঘরে। তল্লাশিকালে নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ফোন লুটে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। সেনা-বিজিবির গুলিতে আহত হয়েছেন ৩ জন।

এছাড়া গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে বাধাসহ ব্যানার-ফেস্টুন খুলে নেয়া, সাজেকে কাঁচা মালামাল পরিবহন-বিক্রিতে বাধা প্রদান, মোটর সাইকেল জব্দ করা, চুক্তি বর্ষপূর্তি র‌্যালিতে যোগ দিতে বাধ্য করা, গোপনে পাহাড়ি যুবকদের তথ্য সংগ্রহ, ব্রাশফায়ার করে আতঙ্ক সৃষ্টি ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে। আর কারাগারে বন্দি অবস্থায় ১ জন মারা যান বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।

রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী কর্তৃক সংঘটিত ঘটনা তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট মগপার্টি, মুখোশ বাহিনী সন্ত্রাসীদের খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ থেমে নেই। রাষ্ট্রের নিয়োজিত বাহিনীগুলোই এসব সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সহযোগীতা দিয়ে এসব অপকর্ম চালাচ্ছে। এই সন্ত্রাসীদের দ্বারা ২০২১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফের সাবেক দুই কর্মী ও জেএসএস-এর ৩ নেতাকর্মীসহ অন্তত ৯ জন খুনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদপুষ্ট মুখোশ ও মগ পার্টির সন্ত্রাসীদের দ্বারা ৭ জন ও অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের দ্বারা ২ জন প্রাণ হারান।

সন্ত্রাসীদের দ্বারা অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮ জন। অপহৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রায়ই মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করা হয়। আর মারধরের শিকার হয়েছেন ৬ জন। এছাড়া সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন জনের কাছে চাঁদা দাবি ও ইউপিডিএফ’র ৩ কর্মী পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের হুমকির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের দ্বারা দীঘিনালা, মহালছড়ি ও লক্ষ্মীছড়িতে ইউপিডিএফ নেতা-কর্মীদের ওপর ৩টি সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ইউপিডিএফ সংগঠক দীপন জ্যোতি চাকমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সন্ত্রাসীদের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন।

এছাড়া সন্ত্রাসীরা বান্দরবানে ইউপিডিএফের বান্দরবান জেলা ইউনিটের সংগঠক ছোটন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যার বাড়িতে ও ইউপিডিএফ কার্যালয়ে হামলা চালায়। প্রশাসনের যোগসাজশে সন্ত্রাসীরা ইউপিডিএফ’র কার্যালয়টি দখল করে নেয় বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।

রিপোর্টে নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ২০২১ সালে অন্তত ২৯ জন নারী ও শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭ জন, ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৩ জন, যৌন হয়রানি-শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৪ জন এবং অপহরণ ও অপহরণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৬ জন।

নিপীড়নের শিকার হওয়া নারী-শিশুদের মধ্যে ৪ বছর বয়সী শিশু থেকে প্রতিবন্ধী নারী-শিশুও রয়েছেন। এর মধ্যে সেনা ও বিজিবি সদস্য দ্বারা ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৩জন, শিক্ষক দ্বারা ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৬ জন ছাত্রী।

জনগণের ক্ষতিসাধন করে সেনাবাহিনীর সীমান্ত সড়ক নির্মাণের তথ্য তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকের রুইলুই থেকে ভারত সীমান্তবর্তী উদয়পুর-কমলাক পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার এবং খাগড়াছড়ির রামগড় হতে মাটিরাঙ্গার তবলছড়ি পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ করছে সেনাবাহিনী। এই সড়ক নির্মাণের কারণে জনগণ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের জমির ফসল, বাগান-বাগিচা নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাপক আকারে পাহাড়-টিলা কাটার ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যেরও বড় ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।

রিপোর্টে সেনাবাহিনী দ্বারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জায়গা বেদখলের পাঁয়তারা চালানোর বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা ধর্মীয় পরিহানির ঘটনা নতুন নয়। প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে থাকে। ২০২১ সালে ২টি বৌদ্ধ বিহারে উন্নয়ন কাজে বাধা প্রদান ও ৩টি বিহার এলাকায় সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়ে বিহারের জায়গা বেদখলের পাঁয়তারা চালানো হয়।

পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন করে নতুন ক্যাম্প স্থাপনের তথ্য তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে অস্থায়ী সকল ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা উল্লেখ থাকলেও তা বাস্তবায়ন না করে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে। ২০২১ সালেও রাঙামাটি ও বান্দরবানে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে অন্তত ৬টি স্থানে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রাঙামাটির নান্যাচরে এক ব্যক্তির ভোগদখলীয় ৭ একর জায়গায় বাৎসরিক ৭ হাজার টাকায় জোরপূর্বক লিজ নিয়ে একটি ক্যাম্প স্থাপনের ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এছাড়া সাজেকে বিজিবি’র একটি ক্যাম্প স্থাপনের জন্য গ্রামবাসীদের ভোগদখলীয় জায়গা জোরপূর্বক দখল করার অভিযোগ রয়েছে।

রিপোর্টে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, সেটলার ও কথিত উন্নয়নের নামে ভূমি বেদখলের চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ২০২১ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক অন্তত ৬টি স্থানে ভূমি বেদখল ও বেদখল চেষ্টার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গুইমারার সিন্দুকছড়িতে সেনাবাহিনী কর্তৃক সনে রঞ্জন ত্রিপুরার জমি দখল করে সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকের নামে একটি সেনা চৌকি ও সোহেল ত্রিপুরার জমি দখল করে সেখানে একটি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়। এছাড়া একই এলাকায় এক গ্রামবাসীর জুম ঘরে অগ্নিসংযোগ ও একজনের জুমঘর ভাংচুর করা হয়।

অপরদিকে মাটিরাঙ্গার তবলছড়ি এলাকায় বিজিবি কর্তৃক পাহাড়ি গ্রামবাসীদের ঘরবাড়ি ভাংচুর ও উচ্ছেদের চেষ্টা, সিন্দুকছড়ির গড়িয়াছড়ি সেনা ক্যাম্প এলাকায় পাহাড়িদের হলুদ, কচু ক্ষেত ও বাগান-বাগিচা কেটে ধ্বংস করে দেয়া এবং রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার নভাঙ্গা নামক স্থানে হেলিপ্যাড স্থাপনের নামে এলাকার একটি খেলার মাঠ বেদখলের চেষ্টা করা হয়।

কথিত উন্নয়নের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ভূমি বেদখল অব্যাহত রয়েছে। ২০২১ সালেও বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চিম্বুক পাহাড়ে যেখানে পাঁচতারকা হোটেল স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে সে এলাকায় স্থানীয় ম্রোরা গ্রামবাসীদের নিজেদের ভোগদখলীয় জায়গায় ঝাড়–ফুল কাটতে বাধা প্রদানের ঘটনা ঘটে। এতে প্রতিবাদ করতে গিয়ে এক সেনা সদস্য বন্দুক উঁচিয়ে প্রতিবাদী ম্রোদের গুলি করতে উদ্যত হয়।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে সরকারি আশ্রায়ণ প্রকল্পের নামে পাহাড়ি মালিকানাধীন ভূমি বেদখলের অভিযোগ পাওয়া যায়।

রাঙামাটির সাজেকের রুইলুই পর্যটন এলাকায় ১৭ ত্রিপুরা পরিবারকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করা হয়। ফলে তাদেরকে উচ্ছেদ আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করতে হচ্ছে।

বান্দরবানের আলী কদমে বনবিভাগ কর্তৃক খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের একটি গীর্জা ভেঙে দেওয়া হয়। আর লামায় রাবার কোম্পানি কর্তৃক ম্রোদের ২০০ একর জায়গা বেদখল করার অভিযোগ পাওয়া যায়, যা দেশের প্রধান দৈনিক ডেইলি স্টারে খবর প্রকাশিত হয়।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় পুনর্বাসিত সেটলার বাঙালি কর্তৃক খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে অন্তত ১০ স্থানে ভূমি বেদখল ও বেদখল চেষ্টার ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করে বলা হয়, খাগড়াছড়ির পানছড়িতে ১২ ত্রিপুরা গ্রামবাসীর প্রায় ৬৫ একর জমি দখলের তথ্য পাওয়া যায়।

এছাড়া একই উপজেলার আরো এক ব্যক্তির জমিতে সেটলার কর্তৃক বাঁধ দেওয়া, মাটিরাঙ্গায় এক ব্যক্তির জমি দখলের চেষ্টা, মহালছড়ির মাইসছড়িতে পাহাড়িদের ভোগদখলীয় জমি দখল করে সেটলারদের ঘর নির্মাণ, পানছড়ির মরাটিলায় দেব রঞ্জন ত্রিপুরা নামে গ্রামবাসীর কলাবাগান কেটে দেওয়া, রাঙামাটির লংগদু উপজেলার আটারক ছড়া এলাকায় আর্যগিরি বনবিহার নামে একটি বৌদ্ধ বিহারের জায়গা বেদখলের চেষ্টা, রাঙামাটি সদর উপজেলার বালুখালীতে মারমা গ্রামবাসীদের শ্মশান ভূমি দখল করা এবং বান্দরবানের লামা উপজেলায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কর্তৃক ম্রোদের পানির উৎস ধ্বংস করে দেয়া এবং ভূমিদস্যু কর্তৃক একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা বেদখল চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া যায়।

সাম্প্রদায়িক হামলার তথ্য তুলে ধরে উক্ত রিপোর্টে বলা হয়, ২০২১ সালে ৪টি সাম্প্রদায়িক হামলা ও হামলার চেষ্টার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৩টি পার্বত্য চট্টগ্রামে ও ১টি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে কক্সবাজার জেলার টেকনাফে। এসব ঘটনায় কমপক্ষে ১৯ জন আহত হন এবং একটি বৌদ্ধ বিহারের রান্না ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

প্রথম ঘটনাটি ঘটে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি এলাকায়। পাহাড়িদের জুমচাষের জমি বেদখলে বাধা দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেটলার বাঙালিরা পাহাড়ি গ্রামে হামলার চেষ্টা চালায়। তারা রাতের আঁধারে পাহাড়ি বিদ্বেষী উস্কানিমূলক শ্লোগান দিয়ে মিছিল করে। এতে পাহাড়ি গ্রামবাসীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সরোয়াতলী ইউনিয়নে। দুই ব্যক্তির কথা বাগ্বিতন্ডার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেটলাররা উক্ত ইউনিয়নের পেরাছড়া নামক স্থানে পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়। এতে ৩ জন পাহাড়ি আহত হয়।

তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে বান্দরবানের লামা উপজেলার সদরের মাষ্টার পাড়ায়। পাড়ার পাশর্^বর্তী ঝিরিতে শুকরের মাংস পরিষ্কার করাকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী মুসলিম বাঙালিদের দ্বারা এক পাহাড়ি (মারমা) গ্রামবাসী হামলার শিকার হন। মুসলিমরা তাকে লাঠিসোটা দিয়ে মারধর করলে তিনি গুরুতর আহত হন।

আর কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নে কাটাখালী চাকমা পাড়ায় সংঘটিত হামলায় চাকমা সম্প্রদায়ের অন্তত ১৫ জন আহত হন। মুসলিম যুবক কর্তৃক চাকমা গ্রামে প্রবেশ করে নারীদের উত্যক্ত করলে চাকমা যুবকরা বাধা প্রদান করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে একদল মুসলিম বাঙালি পাহাড়িদের ওপর হামলা চালায়। এতে অন্তত ১৫ জন চাকমা আহত হন। এছাড়া হামলাকারীরা গ্রামের একটি বৌদ্ধ বিহারের রান্না ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

সেটলার দুর্বৃত্ত দ্বারা সংঘটিত ঘটনা তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, সেটলার বাঙালি দুর্বৃত্ত কর্তৃক একজনকে পুড়িয়ে হত্যাসহ ২ জনকে খুন, এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে কুপিয়ে জখম ও এক পাহাড়ির বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ঘটনাগুলো ঘটেছে খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকায়।

এর মধ্যে খাগড়াছড়ির রামগড়ে চাইথোয়াই মারমা নামে এক ব্যক্তিকে আরফিন শরীফ পাটোয়ারি নামে এক সেটলার দুর্বৃত্ত প্রথমে ইট দিয়ে আঘাত করে ও পরে শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। খাগড়াছড়ি শহরের শান্তিনগর এলাকায় সেটলার দুর্বৃত্ত কর্তৃক ছুরিকাঘাতে এক পাহাড়ি যুবক নিহত হন।

খাগড়াছড়ির পানছড়িতে সেটলার দুর্র্বত্তরা প্রজ্ঞা সাধনা বনবিহারের ঢুকে বিহারাধ্যক্ষ অগ্রজ্যোতি ভান্তেকে কুপিয়ে ও রড দিয়ে আঘাত করে গুরুতর জখম করে। এ সময় সেটলার দুর্র্বত্তরা বিহার থেকে অর্ধলক্ষাধিক টাকা লুট করে নিয়ে যায়।

সেটলার বাঙালি কর্তৃক ডাকাতির ঘটনাটি ঘটে মাটিরাঙ্গা পৌরসভা এলাকায়। ডাকাতরা মঙ্গল কুমার চাকমা নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে ডাকাতি করে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নিয়ে যায়। এ সময় বাধা দিতে গেলে সেটলার ডাকাতরা মঙ্গল কুমার চাকমার পুত্রবধু অনিতা চাকমাকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর জখম করে।

সিন্দুকড়িতে সেটলার পুনর্বাসনের পরিকল্পনার খবরে এলাকাবাসী আতঙ্কে থাকার কথা উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি ও মহালছড়ি হতে সিন্দুকছড়ি-জালিয়া পাড়া পর্যন্ত নতুন করে নির্মিত রাস্তার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে ৪০০ পরিবার বাঙালি সেটলার পুনর্বাসনের পাঁয়তারার তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া বেশ কয়েকটি স্থানে পর্যটন স্পট নির্মাণের পরিকল্পনার কথাও জানা যায়। এ নিয়ে পাহাড়ি অধিবাসীরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। তবে এ রিপোর্ট তৈরির সময় পর্যন্ত সেটলার পুনর্বাসনের খবর পাওয়া যায়নি।

রিপোর্টে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্মান্তরকারী মৌলবাদী চক্রের তপরতার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী পাহাড়িদেরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে একটি ইসলামী মৌলবাদী চক্র এ কাজটি করে যাচ্ছে। তারা দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন জাতিসত্তার শিশুদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পাচার করে বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় নিয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর করছে। বান্দরবান জেলায় ‘উপজাতীয় মুসলিম আর্দশ সংঘ’,‘উপজাতীয় মুসলিম কল্যাণ সংস্থা’ ও ‘উপজাতীয় আর্দশ সংঘ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি সংগঠনের নাম দিয়ে জনবসতিও গড়ে তোলা হয়েছে এবং এসব সংগঠনের মাধ্যমে পাহাড়িদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণের কাজ চালানো হচ্ছে।

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে কক্সবাজারের ‘ঈদগাহ উপজাতীয় মুসলিম কল্যাণ সংঘ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১৩ ম্রো শিশুকে উদ্ধার করা হয়। একদল সচেতন ম্রো ছাত্র স্থানীয় এনজিও কর্মী ও সমাজ কর্মীদের সহযোগিতায় এই শিশুদের উদ্ধার করেন। মিডিয়ায় প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১০ বছরের মধ্যে ধর্মান্তরের উদ্দেশ্যে পাচারকালে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক পাহাড়ি শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এই ইসলামী ধর্মান্তরকারী শিশু পাচারকারী চক্রটির বিরুদ্ধে প্রশাসনের তেমন কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।





0/Post a Comment/Comments