- রোনাল চাকমা
জেএসএসের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির
বিপরীতে সরকারের আনুগত্যশীল তথাকথিত ট্রাইভাল কনভেনশনের নেতাদের সাথে ‘স্থানীয় সরকার পরিষদ’ প্রজেক্ট হাজির করলে তা পার্বত্য
চট্টগ্রামের প্রকৃত সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়। পরে বিএনপি-আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় জনমত
ও ভূ-রাজনীতির পটপরিবর্তনের কারণে রাজনৈতিক সমস্যা স্বীকৃতি দিয়ে
সমাধানের প্রচেষ্টা চালায়। তথ্যমতে, পার্বত্য চুক্তির আগ পর্যন্ত জেএসএস ও ক্ষমতাসীন বিভিন্ন
সরকারের মধ্যে মোট ২৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সরকারগুলোর সাথে প্রথমদিকের বৈঠকে জেএসএস এর প্রধান দাবিসমূহ ছিল:
১. জুম্মল্যান্ড
নামে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক একক হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন,যা পরিচালিত
হবে আইন প্রণয়নের ক্ষমতাসহ একটি নির্ধারিত আঞ্চলিক পরিষদ দ্বারা, এবং জুম্ম
জনগণের পরিচিতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি।
২. বিডিআর
(বাংলাদেশ রাইফেলস, সীমান্তরক্ষী বাহিনী) ক্যাম্প ছাড়া বাকি ছাড়া সকল
নিরাপত্তা বাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করা।
৩. পার্বত্য
চট্টগ্রাম থেকে বসতিস্থাপনকারীদের সরিয়ে নেওয়া এবং আসল মালিকদের নিকট জমি ফেরত
দেওয়া।
৪. ভারত
থেকে জুম্ম শরনার্থীদের ফেরত এনে
UNHCR এবং ICRC এর তত্ত্বাবধানে
যথাযথ পুর্ণবাসন করা।
৫. সাধারণ ক্ষমা এবং
জেএসএস সদস্যদের যথাযথ পুর্নবাসন
‘পার্বত্য জেলা ০৩ টিতে ডিসি,
এসপি থাকবেন, থাকবেন পূর্বের ন্যায় সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাঙালিরা যেমন আছেন তেমনি থাকবেন...........................আমি আবারোও দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলতে চাই, পার্বত্য এলাকায়
পাহাড়ি-বাঙালি সবাই থাকবে । কোনো বাঙালিকে জোরপূর্বক প্রত্যাহার করা হবে না।’
পার্বত্য
চট্টগ্রাম সমস্যাটি রাজনৈতিক। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তকগণ, রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানে পরামর্শ দিয়েছেন। সরকার প্রধানের উপরোক্ত বক্তব্য প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানের সাথে
সাংঘর্ষিক। পার্বত্য
চুক্তির ফলে রাজনৈতিক সমাধানের আনুষ্ঠানিকতা দেখানোর প্রবণতা সমস্যার মাত্রাকে আরো
বাড়িয়ে তুলেছে। কেননা
চুক্তির মধ্যে দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের প্রকৃত রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে কোথাও পাহাড়ি জনগণের প্রথাগত ভূমি
অধিকার, জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি
ও নাগরিকত্ব নির্ধারণ, ৭৫ পরবর্তী রাষ্ট্রীয় মদদে সেটেলার পুনর্বাসন
বন্ধ ও প্রত্যাহার, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সেনা শাসন প্রত্যাহারসহ
জননিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
খোদ
যে চুক্তি হল তা বাস্তবায়নের কোন সময়সীমা কিংবা রোডম্যাপ নেই। চুক্তি বাস্তবায়নে
চাপ প্রয়োগে করার মতন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থারও সম্পৃক্ততা নেই। সম্পাদিত চুক্তির সাংবিধানিক গ্যারান্টিও
নেই যা যেকোন সময় বাতিল হয়ে যেতে পারে। এবং চুক্তির ফলে গঠিত আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য
জেলা পরিষদের মতন প্রতিষ্ঠানগুলোর আইন প্রণয়ন ক্ষমতা নেই । এগুলো রাষ্ট্রীয় নীতির বাস্তবায়ন
ছাড়া রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে কার্যকর নয়।
চুক্তির
২৫ বছরে এসে খোদ চুক্তি স্বাক্ষরকারী উভয়পক্ষেরই চুক্তি বাস্তবায়নে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার
অভাব রয়েছে।
উভয়পক্ষ থেকেই জনগণকে শান্তির ঘুম
পাড়ানির গান শোনানো হচ্ছে। চুক্তি
স্বাক্ষরকারী জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা আঞ্চলিক পরিষদের মতন একটি অকার্যকর সরকারি
প্রতিষ্ঠানে বসে সরকারের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়েছেন। জনগণের উপর নির্ভরশীল গণআন্দোলনের পথপরিত্যাগ করে দেশের তথাকথিত
আওয়ামী সুশীল, এনজিও ঘরানার ব্যাক্তি-সংগঠনের দ্বারস্থ হচ্ছেন। সন্তু
লারমা আক্ষেপের সুরও তুলছেন ‘বিশ্বাস
করে চুক্তি করেছিলাম, কেউ প্রতিদান দেয়নি।’ (সাক্ষাৎকার; প্রথম
আলো, ২০২১)। তাহলে
বিগত ২৫টি বছর ধরে আপনাদের উপর জনগণ যেটুকু আস্থা রেখেছিল
সেটার প্রতিদান কে দিবে? পার্বত্য চুক্তি উত্তর সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন উত্তরণ’, ১৯টি‘র বেশি
সাম্প্রদায়িক ঘটনা, হাজার হাজার একর ভূমি বেদখল, হত্যা, ধর্ষণ, অঘোষিত সেনাশাসন
‘অপারেশন উত্তোরণ’, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দমনমূলক ‘১১ দফা’ নির্দেশনা, দেশে-বিদেশে বিতর্কিত র্যাব বাহিনী মোতায়েন,
নতুন এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপন, প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে পর্যটন ব্যবসা, প্রাকৃতিক
সম্পদ পাচার ও লুন্ঠন এবং সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, সেনা
মদদপুষ্ট ঠ্যাঙারে বাহিনী গঠন করে ত্রাস সৃষ্টি এই অঞ্চলের রাজনৈতিক সমস্যায় নতুন
মাত্রা যোগ করেছে।
শাসকের মনগড়া ও ইচ্ছা-অনিচ্ছার
উপর নির্ভর চুক্তি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব রাজনৈতিক
সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই উভয়পক্ষ পার্বত্য চুক্তি
বাস্তবায়ন নিয়ে যত চট্কদার কথাবার্তা, মুখরোচক গল্প বলুক,
মান-অভিমান-ঝগড়া-ঝাটি করুক
তাঁরা যে পাহাড়ে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সময়ক্ষেপন করছে তা প্রমাণিত।
পার্বত্য চুক্তি কি প্রকৃতই পাহাড়ের রাজনৈতিক সমাধান? চুক্তির ২৫বছর উদযাপনের সময় এমন প্রশ্ন অবান্তর মনে হলেও প্রকৃত ঘটনা উপরে বিবৃত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান হল রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন। এটা জনগণের ঐতিহাসিক অধিকার। কার্পাস মহল থেকে পার্বত্য চুক্তি পর্যন্ত পার্বত্য জনগণ স্বশাসন ও স্বাতন্ত্র্যতা নিয়ে থাকতে চেয়েছে। যেহেতু পার্বত্য চুক্তির মধ্যে দিয়ে স্বায়ত্তশাসন অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, তাই সরকারসহ সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচার-প্রোপাগান্ডায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন মুখরোচক গল্পে, কৌশলে বিভ্রান্ত হবেন না। শাসক ও শাসকের সহযোগী রাজনৈতিক দল, ব্যাক্তিবর্গ, এনজিও সংস্থাকে স্মরণ রাখা উচিত ‘জনগণকে চিরকাল ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় না। তাঁরা একদিন জেগে উঠবেই।’ ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই জনগণ নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগঠিত হবে, লড়াই চালাবে, সফল হবে। সত্য ও ন্যায়ের জয় চিরকালীন অনিবার্য।