শহীদ ভরদ্বাজ মুনি’র মরদেহ
সিএইচটি নিউজ ডেস্ক ।। আজ ১৩ অক্টোবর ২০২১ পার্বত্য চট্টগ্রামে
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ভরদ্বাজ মুনি’র আত্মবলিদানের ২৯ বছর পূর্ণ হল।
নব্বইয়ের দশকে সূচিত গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামে “১৩ অক্টোবর” রক্তে লেখা একটি দিন!
১৯৯২ সালের এই দিনে দীঘিনালা সদরে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আহুত ছাত্র- গণসমাবেশে যোগ
দিতে এসে মাইনি ব্রীজের সন্নিকটে সেনা মদদে সেটলারদের হামলায় শহীদ হন ভরদ্বাজ মুনি
চাকমা। এ হামলায় প্রায় অর্ধশত
নারী-পুরুষ আহত হয়েছিলেন।
দীঘিনালা তখন ছিল নরকতুল্য ফৌজী শাসনে পিষ্ট, স্থানীয় দালাল-প্রতিক্রিয়াশীল-সেনা চর আর সেটলারদের দৌরাত্ম্যে জনজীবন হয়ে পড়েছিল দুর্বিসহ। এমনি সময়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ছাত্র-গণসমাবেশের আহ্বান করে। যা আক্ষরিক অর্থে মাইনি উপত্যকায় দীর্ঘদিনের নিষ্পেষিত ছাত্র-জনতার চেতনায় বিদ্যুতস্পৃষ্ট করে প্রতিবাদী জোয়ার বইয়ে দেয়। মাইনি উপত্যকায় ছাত্র জনতার ঢল নামে। শত শত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা আহূত ছাত্র-গণসমাবেশে যোগ দিতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। সমাবেশে অংশ নিতে এমনি একটি দলের সহযাত্রী হয়ে সেদিন ৭০ বছরের বয়োবৃদ্ধ ভরদ্বাজ মুনিও রাজপথে নেমেছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর মদদে সেটলাররা মিছিলকারী জনতার উপর হামলা চালালে মাইনি ব্রিজের সন্নিকটে শহীদ হন ভরদ্বাজ মুনি চাকমা। হামলায় গুরুতর জখম হয়েছিলেন বয়স্ক নারীসহ আরও অর্ধ শতাধিক লোক। বিশেষ করে দৌঁড়াতে না পারার কারণে বয়স্করাই বেশি হামলার শিকার হয়েছিলেন। হামলা থেকে বাঁচতে অনেকে স্রোতস্বিনী মাইনি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন।
সেদিন
যা ঘটেছিল:
সমাবেশের একদিন আগে অর্থাৎ১২ই অক্টোবর
’৯২ দীঘিনালা থানা বিএনপি হঠাৎ মিছিল করে পিসিপি’র আহুত সমাবেশের দিন
(১৩ অক্টোবর) হরতাল আহ্বান করে। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীর সৃষ্ট কথিত ‘একক বাংলা ত্রিপুরা-গণ
পরিষদ’ নামে অপর একটি ভুঁইফোড় সংগঠনও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচির
বিরোধিতা করতে শুরু করে।
১৩ই অক্টোবর সকাল থেকে স্থানীয় কিছু বাঙালি নেতা থানা বাজারে দোকানপাট
বন্ধ করার চেষ্টা করে। ক্ষেত খামারে যে বাঙালিরা কাজে নেমেছিল তাদেরও কাজ বন্ধ করে
লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত হতে বলে। তারা বাস চালকদেরও হুমকি দিয়ে যানবাহন না চালাতে বাধ্য
করতে থাকে। থানা বাজার সেদিন হাটেরি দিন। স্বাভাবিকভাবে যে লোকজন বাজার অভিমুখে আসছিল
তারা যাতে আসতে না পারে তার জন্য ফেরীঘাট বন্ধসহ রাস্তার মোড়ে মোড়ে ধারালো অস্ত্রশস্ত্র
নিয়ে পথ রোধ করে রেখেছিল। অন্যদিকে বাবুছড়া থেকে থানা বাজারে আসার পথে প্রত্যেক আর্মি
চেকপোষ্টে পাহাড়িদের আটকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিল, যাতে করে সাধারণ মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত
হয়ে সমাবেশে যোগ দিতে না পারে। সকাল সাড়ে ৮টায় খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে এডিএম ও এএসপি
একটি বিশেষ পুলিশ বাহিনী নিয়ে দীঘিনালায় আসেন। উদ্দেশ্যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সামাল
দেয়া।
সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা এবং গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। ফেরীঘাট বন্ধ থাকাতে
মাইনী নদীর পূর্ব পাড়ে প্রায় হাজার তিনেক আবাল বৃদ্ধ বনিতা জড়ো হয়ে যায়।
এরই মধ্যে হাজার হাজার বাঙালি দা, খন্তা, বল্লম, লাঠি, সাইকেলের চেইনসহ
আরও বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র নিয়ে ভাঙা বিল্ডিং নামক আর্মি চেকপোষ্টে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে
অবস্থান নেয়। এ অবস্থায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কয়েকজন নেতা থানায় গিযে ব্যাপারটি এএসপিকে
জানান এবং তার সহায়তা কামনা করেন। এএসপি তাৎক্ষণিকভাবে ওসি
এবং টিএনওকে ভাঙ্গা বিল্ডিং চেকপোষ্টের দিকে পাঠিয়ে দেন। টিএনও বাঙালিদের জটলায় গিয়ে
তাদের শান্ত থাকতে বলেন। তিনি তাদের আরও বোঝাতে থাকেন যে “পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কোন শান্তিবাহিনী
নয়। তারা গণতান্ত্রিকভাবে এখানে সমাবেশ করছে। এতে কারোর ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। তাদের
শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে দিন”।
প্রথম দিকে বাঙালিরা রাজিও হয়ে যায় টিএনও’র বক্তব্যে। কিছুক্ষণ পর বাঙালিদের
মধ্যে আরও উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তারা উস্কানিমূলক শ্লোগান দিতে থাকে। বাঙালিদের মধ্যে
থেকে কিছু গুজব ছড়ানো হতে থাকে। এমন সময় সমাবেশে যোগ দিতে আসা পাহাড়িদের একটি মিছিল
মাইনি ব্রীজ অতিক্রম করলে সাথে সাথে আর্মি চেক পোষ্টের দায়িত্বরত সেনা সদস্যরা রাস্তাটি
ব্লক করেন। অন্যদিকে, বিএনপি নেতা জাকির আহম্মেদ, ছাত্রলীগ নেতা ইলিয়াস, তরুণ বিশ্বাস
সহ আরও কিছু বাঙালি পাহাড়িদের দিকে এগুতে থাকলে পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হয়ে উঠে। এ সময়
ঘটনাস্থলের পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলেন লে. কর্ণেল ফরিদ। আক্রমণ শুরু হবার ঠিক পূর্ব
মুহুর্তে তিনি মেজর হায়দারকে অন্যত্র সরে যেতে ইঙ্গিত দেন। এর পরপরই আর্মি চেক পোষ্ট
থেকে একটি হুইসেল বেজে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার বাঙালি পাহাড়িদের উপর ঝাঁপিয়ে
পড়ে। প্রথম দিকে পাহাড়িরা আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। অবস্থা নাজুক আকার নিলে
টিএনও পুলিশকে ফাঁকা গুলি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেন। এদিকে গুলি শব্দ
হওয়ার সাথে সাথে পাহাড়িরা দৌঁড়ে পালাতে থাকে। এ সময় বাঙালিরা পাহাড়িদের ধাওয়া করে ব্যাপকভাবে
আক্রমণ করতে থাকে। আর এ হামলায় ঘটনাস্থলে ৭০ বছরের বয়োবৃদ্ধ ভরদ্বাজ মুনি চাকমা নিহত
হন। এছাড়া আহত হন আরো অর্ধশতাধিক লোক।
পরিকল্পনামাফিক হামলা শেষ হওয়ার পর পরই সেনা সদস্যরা সামরিক ভ্যান নিয়ে
উদ্ধারকারির ভূমিকায় হাজির হয়। তারা নিহত, আহতদের তাদের সেনানিবাসের হাসপাতালে নিয়ে
যেতে অধিকতর তৎপর হয়ে উঠে।
অপরদিকে, ঘটনার অল্পক্ষণ পরেই সেনা সৃষ্ট তথাকথিত ‘একক বাংলা ত্রিপুরা
গণপরিষদ’র ব্যানারে একদল লোক মিছিল নিয়ে থানার দিকে যায়। আর সেই মিছিলের আগে আগে মেজর
হায়দারকেও উৎফুল্লভাবে দেখা যায়। তিনি কিছুদূর এগিযে এসে মিছিলের
গতি রোধ করেন। এরপর সেনাদের পোষ্য কিছু ফটোগ্রাফার সেই মিছিলের ছবি ধারণ করেন। পরে
মিছিল শেষে তাদেরকে ভাঙ্গা বিল্ডিং আর্মি চেক পোষ্টে নিয়ে গিয়ে মিছিলে অংশগ্রহণকারী
প্রত্যেককে ৫০ টাকা করে দেওয়া হয় বলে জানা যায়।
১৩ অক্টোবর গভীর রাতে দীঘিনালা সেনানিবাসের হাসপাতাল থেকে জলপাই রঙের
পিকআপে করে ভরদ্বাজ মুনির মরদেহ দীঘিনালা থানায় নেওয়া হয়। পরদিন (১৪ অক্টোবর) মরদেহ
শনাক্তকরণ শেষে পিসিপি নেতা-কর্মীরা মিছিল সহকারে ভরদ্বাজ মুনির মরদেহ কাঁধে বহন করে
মাইনি নদীর ধারে দাহক্রিয়া সম্পন্ন করেন।
মুলত ৯ অক্টোবর থেকে সমাবেশ বানচাল করে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। পাহাড়ি
ছাত্র পরিষদের গণসমাবেশের খবর পাওয়ার পর পরই স্থানীয় কিছু নেতৃবৃন্দকে ক্যান্টনমেন্ট-এ
ডেকে আলাদা আলাদাভাবে সমাবেশের বিষয়ে আলোচনা করা হয়। সমাবেশ বানচাল করে দেয়ার জন্য
করণীয় সম্পর্কে অনেকে কাছ থেকে বিশেষ পরামর্শ চাওয়া হয়। এসব তৎপরতার সাথে যুক্ত
ছিলেন তৎকালীন দীঘিনালা
সেনানিবাসের লে. কর্ণেল ফরিদ, দীঘিনালা থানার সেকেন্ড অফিসার আব্দুল হাই, বিএনপির দীঘিনালা
থানা শাখার সভাপতি জাফর আহম্মদ, শাপলা স্টুডিওর মালিক ও বিএনপি’র সাধারণ সম্পদাক মাসুদ
রানা, ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ইলিয়াস চৌধুরী, পাক্ষিক মাইনির বার্তাবাহক জাহাঙ্গীর আলম,
৩নং মেরুং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সোনামিয়া ও তরুণ বিশ্বাস প্রমুখ ব্যক্তিগণ।
ঘটনার পর পাল্টে যায় দীঘিনালার পরিস্থিতি:
উক্ত ঘটনার পর দীঘিনালা আর আগের মত থাকেনি।
কায়েমী স্বার্থবাদী সেনাচক্র, দালাল-প্রতিক্রিয়াশীল বেঈমান ও সেটলার সর্দারদের সকল
ষড়যন্ত্র চক্রান্ত ভণ্ডুল হয়ে যায়। গণজোয়ারের মুখে দুর্বৃত্ত দালালরা পিছু হটে।
দীঘিনালা এক শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসে। ভরদ্বাজ মুনি’কে খুন করে সেনাচক্র প্রকারান্তরে আন্দোলনের আগুনে ঘি
ঢেলে দেয়ার কাজই করেছিল, দাবানলের মত নবচেতনায় জ্বলে উঠেছিল মুক্তিকামী
ছাত্র-জনতা।শহীদের রক্তে দীঘিনালায় রচিত হয় শক্ত আন্দোলনের ভিত্তি।
পিসিপি নেতা-কর্মীরা দীঘিনালায় গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, সেনা ও
দুর্বৃত্তদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে পাড়ায় পাড়ায় মিটিঙ করে জনমত সংগঠিত করতে থাকে। প্রত্যন্ত
অঞ্চলে দ্বিগুণ উৎসাহে পিসিপি সংগঠন গড়তে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে সেনা দালাল
প্রতিক্রিয়াশীলরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
নব্বইয়ের দশকে সূচিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভরদ্বাজ মুণি’র
আত্মবলিদান প্রতিরোধের চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে!
আজকের
এই দিনটিতে আমরা শহীদ ভরদ্বাজ মুনির প্রতি গভীর সম্মান জানাই! তাঁর আত্মবলিদানের
ফলে সে সময় দীঘিনালায় সেনাচক্র-দালাল-বেঈমানদের পরাস্ত করা সম্ভব হয়েছিল।
দুর্দশাগ্রস্ত জাতিকে মুক্ত করতে আজ প্রয়োজন ভরদ্বাজ মুনির চেতনায় উজ্জীবিত
আত্মবলিদানে নির্ভীক শত শত তরুণের। ৭০ বছরের বৃদ্ধ যে সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন
করেছেন, সময়ের প্রয়োজনে বীরত্বের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে বর্তমান তরুণ-যুবা থেকেও
আবির্ভূত হবে অনেক দেশপ্রেমিক।