""

পার্বত্য চট্টগ্রাম: বাঙালি সংগ্রামী বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল


।।
মিনার চাকমা ।।


পার্বত্য চট্টগ্রাম বাঙালিদের কাছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে হাজির হয়েছে। এক সময় কার্পাস মহল নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি ছিল তাদের কাছে অজানা রহস্য এবং ভয় ও আতঙ্কের উস। ম্যালেরিয়ার কারণে তারা সেখানে যেতে ভয় পেতেন। অপরদিকে অনেক বাঙালি ব্যবসায়ীর কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো শোষণের মৃগয়া ক্ষেত্র। শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রাম চলাকালে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এখানে শাস্তিস্বরূপ বদলী করা হতো। তবে ইদানিং সবুজ পাহাড় বেষ্টিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বাঙালি প্রকৃতিপ্রেমী সৌন্দর্য্য পিপাসু ভ্রমনবিলাসী পর্যটকদের কাছে অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি।

কিন্তু অনেকে হয়তো জানেন না, পার্বত্য চট্টগ্রাম এক সময় ছিল বাঙালি সংগ্রামী বিপ্লবীদের কাছে ছিল এক বড় আশ্রয় স্থল। বৃটিশ আমলে অনেক বিপ্লবী এখানে এসে আত্মগোপন করে থাকতেন। সিপাহী বিদ্রোহের পর অনেক বাঙালি বিপ্লবী এখানে লুকিয়ে ছিলেন। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, রাণী কালিন্দী তাদের অনেককে বৃটিশ শাসকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার আর. এইচ. এস. হাসিনচনের লেখায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি তার Eastern Bengal and Assam District Gazetteer: Chittagong Hill Tracts বইয়ে লিখেছেন: 'In 1857 the Kalindi Rani delivered up some of the sepoys of the native regiment that mutinied at Chittagong and had betaken themselves tot the hills to avoid retribution.' (পৃ: ২৫)

শেখ মুজিবুর রহমান


বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় কক্সবাজারের উখিয়ায় এক চাকমা পরিবারের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মনে রাখা দরকার এক সময় কক্সবাজার পার্বত্য চট্টগ্রামের অংশ ছিল। উখিয়া উপজেলার চেনছড়ি গ্রামে তাকে যিনি আশ্রয় দেন তার নাম হলো ফেলারাম চাকমা। ১৯৫৮ সালে ত
কালীন পাকিস্তানের আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় শেখ মুজিব সেখানে বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি যে বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন বর্তমানে সেটা স্থানীয় জেলা প্রশাসন সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।[1]

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের আরেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালি জনগণের উপর পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমন শুরু হলে মেজর জিয়া চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করে সেনাবাহিনীতে তার ইউনিটের বাঙালি সৈন্যদের নিয়ে রাঙামাটির বন্দুকভাঙা মৌজায় তকালীন ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যান ধর্ম মোহন কার্বারীর পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে একদিন সকালে তারা পাকিস্তানী বাহিনী ও ভারতের মিজো বিদ্রোহীদের যৌথ আক্রমনের শিকার হন। এ ঘটনার পর তিনি ও তার ১০১ জন সৈন্য খাগড়াছড়ির রামগড় সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় চলে যান। এ সময় কান্তি নামে এক চাকমা তাকে পিঠে বহন করে কমলছড়ি নদী পার করে দিয়েছিলেন। জিয়া রামগড় সীমান্তের দিকে যাওয়ার সময় খাগড়াছড়িতে এক চাকমা দোকানদারের কাছ থেকে বাকিতে কিছু জিনিস কিনে নেন।[2]

জিয়াউর রহমান


পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির চেয়ারম্যান কমিউনিস্ট বিপ্লবী সিরাজ সিকদার পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি নিজে বান্দরবানের ম্রো গ্রামে অবস্থান করতেন। এ সময় তিনি ‘চিম্বুক পাহাড়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন, যেখানে তিনি পাহাড়ি নারীদের বিপ্লবী ভূমিকা আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন। কবিতাটির কয়েকটি চরণ এই:

 

পাহাড়ের

ঢাল বেয়ে

নেমে যায়

মুরং মেয়ে।

অঙ্গে তার ছোট্ট আবরণী!

কী নিটোল স্বাস্থ্যবতী!

কবে তার কাঁধে-

শোভা পাবে

রাইফেল একখানি![3]

 

সিরাজ সিকদার


সিরাজ সিকদার ১৯৭৫ সালের ১লা জানুয়ারী গ্রেফতার হন এবং পরদিন ঢাকার সাভারে পুলিশের গুলিতে মারা যান। তার বোন শামীম সিকদার সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর জন্য শেখ মুজিবকে দায়ী করেন। তার মৃত্যুর সাড়ে সাত মাসের মধ্যে শেখ মুজিব নিজে এক সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে প্রাণ হারান।

 

১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল সেনা অফিসার কর্তৃক অভ্যুত্থানে নিহত হন। এই ঘটনার পর মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত-সংলগ্ন ফটিকছড়ি চা বাগানে আত্মগোপন করেন। জানা যায় এ সময় তিনি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তারই শত্রু অধুনালুপ্ত শান্তিবাহিনী গেরিলাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শান্তিবাহিনীর হাইকমান্ডের কাছ থেকে বার্তা পৌঁছার আগেই তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পরে তাকে অপর সেনানায়ক এরশাদের নির্দেশে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম তার ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের বিপ্লবী সংগ্রামে, স্বাধীনতা যুদ্ধে ও বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে এভাবে অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।



[1] https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/%E0%A6%89%E0%A6%96%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A6%9B%E0%A6%A1%E0%A6%BC%E0%A6%BF-%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%81

[2] রাজা ত্রিদিব রায়, দি ডিপার্টেড মেলোডি, পৃ: ২১৫

[3] https://lalshongbad.wordpress.com/2015/12/24/%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE/





0/Post a Comment/Comments