""

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ১৮তম কাউন্সিল সম্পন্ন

মিটন চাকমা সভাপতি, সোহেল চাকমা সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত


চবি প্রতিনিধি ।। ‘আসুন, অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে উন্নত ও অগ্রসর মতাদর্শে সুসজ্জিত হয়ে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে বেগবান করি’ এই স্লোগানে আজ শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর ২০২১) চট্টগ্রাম নগরীর সুপ্রভাত হলে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ১৮তম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে মিটন চাকমা সভাপতি, সোহেল চাকমা সাধারণ সম্পাদক ও রোনাল চাকমা সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।

দলীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুনয়ন চাকমা এবং দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন চবি কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক মিটন চাকমা।

কাউন্সিলের ১ম অধিবেশন শোক প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির অন্যতম সদস্য সুদেব চাকমা এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রস্তুতি কমিটির অন্যতম সদস্য রোনাল চাকমা।

এতে প্রধান অতিথি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সভাপতি সুনয়ন চাকমা, বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের নেতা ডা. সুশান্ত বড়ুয়া এবং গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জিকো ত্রিপুরা বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব সোহেল চাকমা এবং সভাপতিত্ব করেন আহ্বায়ক মিটন চাকমা ।

স্বাগত বক্তব্যে রোনাল চাকমা বলেন,‘দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভৌগোলিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের খুব কাছে হওয়ায় নিপীড়িত-নির্যাতিত জুম্ম জনগণের কাছে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ঐতিহাসিকভাবেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জুম্ম শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের ভূমিকা ঈর্ষনীয়। ১৯৮৮ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রসর পাহাড়ি নারী শিক্ষার্থীরা “হিল উইমেন্স ফেডারেশন” প্রতিষ্ঠা করেছিল। দেশব্যাপী সাড়া জাগানো ম্যাগাজিন রাডার, স্যালভো প্রকাশসহ নব্বই দশকের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিল প্রথম সারিতে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ চবি শাখা একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে রাজপথে থেকেছে অবিচল। এ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত জুম্ম শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জোরদার, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টি লক্ষ্যে নানা সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম আয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয় ফ্রি কোচিং প্রোগ্রাম, এডুকেশন ক্যাম্পেইন, জার্নাল ও ছোট ম্যাগাজিন প্রকাশ করে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও সৃজনশীল উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে।‘

জিকো ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ে পর্যটন সম্প্রসারণের নামে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। সাজেকে মুসলিমশূন্য অঞ্চলে স্কুল-হসপিটাল নির্মাণ না করে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেনাবাহিনী বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড়ের রেঞ্জে ম্রো জাতিসত্তাদের জমি দখল করে শতকোটি টাকা বিনিয়োগে পাঁচ তারকা হোটেল বিতর্কিত সিকদার গ্রুপের সাথে যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে এবং সিন্দুকছড়ি পক্ষীমুড়োতে ত্রিপুরা জাতিসত্তাদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে পর্যটন গড়ে তোলার পাঁয়তারা চলছে। বর্তমানে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সাজেক, নীলাচল, নীলগিরি পর্যটন ব্যবসা থেকে শতকোটি টাকা আয় করছে। এসব টাকা পকেটস্থ করছে কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিবেশ বিরোধী গাছ-বাঁশ বনজের মতন মূল্যবান সম্পদ আহরণ, পাথর উত্তোলন, ইটভাটা, ঠিকাদারি ব্যবসার সাথে সেনাবাহিনী ও সরকারের কিছু কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত। মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

বিশেষ অতিথি ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, রাজনীতি হল উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তি। সরকার ছাত্র যুব সমাজকে উচ্চ আদর্শ ও জনগণের অধিকার অর্জনের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে রাজনীতি বিমুখ করে তোলে। তাই আত্নকেন্দ্রিক এবং সুবিধাবাদী ধারা থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্র-যুবকদের সৎ সাহস নিয়ে নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষকে ভালবাসার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত। বর্তমান ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের জনগণের অধিকার হরণ করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় বসে দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। তাই পাহাড় ও সমতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণের সরকার গঠনের সংগ্রামে শামিল হতে হবে ।

প্রধান অতিথি সুনয়ন চাকমা বলেন, অধিকার ভিক্ষাই মিলে না এবং এটি কোন পণ্যও নই। অনেক ত্যাগ এবং সংগ্রামের মাধ্যমে আদায় করে নিতে হয়। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ নিছক কোনো সংগঠনের নাম নয়, এটি শত শহীদের আত্নবলিদানে গড়া একটি নাম । জনগণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম করতে গিয়ে দেশের অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনকে আর শাসকের রোষানলে বারবার পড়তে হয়নি। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অগ্রযাত্রাকে থামানোর জন্য সম্ভাবনাময়ী তরুণ ছাত্রনেতাদের হত্যা, মিথ্যা মামলা দিয়ে কারা অন্তরীন এবং করে রাখা হয়েছে। তাই এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া গৌরবের এবং সম্মানের। উপযুক্ত সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সংকটকে চিহ্নিত করে এর থেকে উত্তরণের জন্য সংঘটিত হয়ে ঐক্যৈবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের ফাদে পা না দিয়ে সাহসিকতার সাথে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে।’

সভাপতির বক্তব্য মিটন চাকমা বলেন, পাহাড়ে সেনা ও প্রশাসন কতৃক নিপীড়নের মাত্রা আগের চেয়ে বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এখনো কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি বন্ধ হয়নি। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প, সেনা শিবির-ছাউনি প্রত্যাহার করে ব্যারাকে ফিরে নেওয়ার কথা থাকলে সেগুলো এখনো পূনর্বহাল রয়েছে এবং ইতিমধ্যে নতুন করে ২০টি`র অধিক সেনা ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছে। চুক্তি পরবর্তী পাহাড়িদের উপর ১৭টির অধিক সাম্প্রদায়িক হামলা ও ভূমি বেদখলে সেনারা সরাসরি জড়িত ছিল। ইতিমধ্যে নতুন করে ২০ টি’র অধিক সেনা ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছে। সর্বশেষ, ২০১৫ সালে ১১ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কতৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১দফা নিদের্শনা জারি করেছে যা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে। এবং এ নির্দেশনা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে ।সামরিক বাহিনী কতৃক ব্যাপকভাবে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতা কর্মীদের পাশাপাশি ব্যাপক সাধারণ জনগণ, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষকদের গণহারে গ্রেফতার-নির্যাতন ,হত্যা এবং গুমের মতন ঘটনার সাথে জড়িত। সেনাবাহিনী নতুনভাবে ঠ্যাঙারে বাহিনী তৈরি করে জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুনভাবে দেশে বিদেশে বিতর্কিত র‌্যাবের পার্বত্য ব্যাটেলিয়ন র‌্যাব-১৫ নামে (৬৭৭ জন সদস্য) মোতায়েন সিদ্ধান্ত  নিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, শাসক শ্রেণির সকল অপশক্তিকে প্রতিরোধ করতে হলে ছাত্র সমাজকে আরো দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রামের জন্য মনোনিবেশ করতে হবে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ছাত্র সংগঠন ও প্রগতিশীল শক্তিকে ন্যুনতম কর্মসূচি জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষা, ভূমি রক্ষা, শিক্ষার্থীদের যৌক্তক অধিকার আদায়ে যৌথ আন্দোলনের আহ্বান জানান ।


১ম অধিবেশন সমাপ্ত হওয়ার পরে ২য় অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি ঘোষণা এবং শপথনামা পাঠ করান পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সহ-সভাপতি অংকন চাকমা। নতুন কমিটিতে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন মিটন চাকমা, সাধারণ সম্পাদক সোহেল চাকমা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে রোনাল চাকমা নির্বাচিত হয়েছেন।

এছাড়া কাউন্সিল উপলক্ষে প্রচারিত লিফলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ছাত্র সমাজের প্রতি নিম্নোক্ত আহ্বান জানানো হয়:

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট উত্থাপিত দাবিগুলোর হচ্ছে-

* সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের  বিকাশের লক্ষ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম গবেষণা কেন্দ্র, ভাষা ও সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট‘ চালু করতে হবে!

* চবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক “দুষ্প্রাপ্য ও তথ্য সম্বলিত গ্রন্থ” সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে!

* চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণামূলক জার্নালে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের বিষয়ে গবেষণা  প্রবন্ধ প্রচার ও প্রকাশনা নিশ্চিতকরণ এবং  শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান ও পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে!

* চাকসু নির্বাচন দাও! শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক বিকাশ কেন্দ্র নিশ্চিত কর!

লিফলেটে ছাত্র সমাজের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, শাসকগোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিই, অস্তিত্ব রক্ষার্থে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলি; শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হোন এবং পিসিপি’র শিক্ষাসংক্রান্ত ৫দফা দাবির বাস্তবায়নে আওয়াজ তুলুন!





0/Post a Comment/Comments