""

রামগড়ে যুব ও নারী সমাজের যৌথ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত

রামগড় প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩


“লড়াই জোরদার করতে দালাল-বেঈমানদের মুখোশ খুলে দিন” এই শ্লোগানে নারীর সম্ভ্রম, বাস্তুভিটা ও জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে খাগড়াছড়ির রামগড়ে যুব ও নারী সমাজের যৌথ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।

আজ রবিবার (১০ ডিসেম্বর ২০২৩) সকাল ১১টায় গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ ও ভূমি রক্ষা কমিটির যৌথ ব্যানারে এই কাউন্সিলের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠান শুরুতে “মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে...” গানটি পরিবেশন করা হয়। এরপর আলোচনা পর্ব শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের রামগড় উপজেলা শাখার সভাপতি জার্মেন্ট ত্রিপুরা।

গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের রামগড় উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক লিটন চাকমার সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে সভায় আরো বক্তব্য রাখেন, ইউপিডিএফের অন্যতম সংগঠক জিরান চাকমা, রামগড় ইউনিটের সমন্বয়ক এডিসন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সদস্য পিংকি চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বরুণ চাকমা ও খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি ক্যামেরন দেওয়ান, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রামগড় উপজেলা শাখা সহ-সভাপতি রাজু ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা শাখা সাংগঠনিক সম্পাদক এলিনা চাকমা ও নারী আত্মরক্ষা কমিটি গুইমারা উপজেলা শাখার আহ্বায়ক মায়া মার্মা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের রামগড় উপজেলা শাখা আহ্বায়ক গুলমনি চাকমা।

সভায় ইউপিডিএফের অন্যতম সংগঠক জিরান চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ছাত্র-যুব ও নারী সমাজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমনে শাসকগোষ্ঠি নানা চক্রান্ত জারি রেখেছে। একদিকে ঠ্যাঙারে নব্যমুখোশ বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে খুন-খারাবি করাচ্ছে, অন্যদিকে তাঁবেদার দালালদের নানা সুবিধা দিয়ে পাহাড়ি ছাত্র-যুবক ও সচেতন লোকজনকে জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি কাজে উসাহিত করছে। তাই জাতীয় অস্তিত্ব, ভূমি ও নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে লড়াই-সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই।

এডিসন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত নিপীড়ন নির্যাতন চলছে। রামগড় এলাকায় ধর্ষণসহ নানা ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় সেনা টহলের নামে জনমনে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। সকল অন্যায়-অবিচার ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ইউপিডিএফের নেতৃত্বে ছাত্র-যুব-নারী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।

গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীীয় সাধারণ সম্পাদক বরুণ চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সভা-সমাবেশ ও মত প্রকাশে স্বাধীনতা না থাকায় গণতান্ত্রিক কর্মসূচিগুলো বৃহত্তর পরিসরে করা যাচ্ছে না। ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ ও আন্দোলন করে তাদেরকে দমন করতে সরকার প্রতিক্রিয়াশীল ঠ্যাঙারে বাহিনী গঠন করে। সেনা-সেটলার কর্তৃক পাহাড়ি নারী ধর্ষণের ঘটনায় বিচার পাওয়া যায় না। সরকার জুম্ম দিয়ে জুম্ম ধ্বংসের যে নীলনক্সা বাস্তবায়ন করছে তার বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

 গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের রামগড় উপজেলা শাখার নবগঠিত কমিটির সদস্যদের শপথ গ্রহণ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সদস্য পিংকি চাকমা বলেন, পাহাড়ি নারীরা যুগ যুগ ধরে অধিকার হারা। স্বামী, পরিবার হতে শুরু করে সব জায়গায় নারীরা নির্যাতিত হয়। তাই নারীদেরকে সংসারের কাজকর্মের পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থ নিয়েও কাজ করতে হবে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নিজের জীবন উ
সর্গ করেন। আমরা জুম্ম নারীরাও সচেতন হলে অনেক কিছু করতে পারি। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বৃহত্তর ভূমিকা পালন করতে পারি। তিনি  কল্পনা চাকমা অপহরণসহ সকল নারী নির্যাতনের বিচার দাবি করেন এবং নারী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই সংগ্রামে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।

যুব নেতা ক্যামেরন দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্য সম্পর্কে ভাবতে হবে। কুমিল্লায় একসময় ত্রিপুরাদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। বর্তমানে সেখানে তাদের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সুষ্ঠুভাবে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের পরিবেশ নেই। এখানে সেনাশাসন ও দমনমূলক ১১ নির্দেশনা জারি করে গণতান্ত্রিক অধিকার ভুলুণ্ঠিত করা হয়েছে। তিনি বলেন,  গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করছে। বিগত ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে পাহাড়িদের ওপর বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলন করেছে।

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি লংগদুতে দয়াল চন্দ্র চাকমা নামে রেকর্ডিয় জমিতে সেটলার বাঙালিরা জোর করে ঘর নির্মাণ করেছে। মাইসছড়িতে প্রতিনিয়ত ভূমি বেদখলের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাই নিজেদের ভূমি রক্ষায় এলাকায় এলাকায় ভূমি রক্ষা কমিটি গঠন করে ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের রামগড় উপজেলা শাখার নতুন কমিটির সদস্যদের শপথ গ্রহণ।


পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের রামগড় উপজেলা শাখা আহ্বায়ক গুলমনি চাকমা বলেন, তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ি নারীরা যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত হয়ে আসছে। কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা অনেক বছর হলেও এখনো এ ঘটনার বিচার হয়নি। কিছুদিন আগে মানিকছড়ি লিচু বাগানে তিন সেটলার বাঙালি কর্তৃক মারমা নারী ধর্ষণের শিকার হন। নারীদের ইজ্জত রক্ষার জন্য সংঠগনের সাথে যুক্ত হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের মাধ্যমে নারী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

পিসিপির রামগড় উপজেলা শাখা সহ-সভাপতি রাজু ত্রিপুরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যায় গ্রেফতার, খুন-গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।

হিল উইমেন্স ফেডারেশন লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা শাখা সাংগঠনিক সম্পাদক এলিনা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীদের ওপর যৌন সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে নারীদেরকে সংগঠিত হতে হবে। নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তিনি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের পতাকাতলে সমবেত হয়ে নারী নির্যাতনসহ সকল দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন বেগবান করার জন্য নারী সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।

নারী আত্মরক্ষা কমিটি গুইমারা উপজেলা শাখা আহ্বায়ক মায়া মার্মা বলেন, নারীরা ঘরে-বাইরে, কর্মস্থলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোথাও নিরাপদ নয়। তাই নিজেদেরকে রক্ষা করতে হলে নারীদের প্রস্তুত হতে হবে, গ্রামে গ্রামে নারী আত্মরক্ষা কমিটি গঠন করতে হবে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভয়াবহ পরিস্থিতি জারি রয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় নারী সমাজসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে ডিওয়াইএফ রামগড় উপজেলা শাখা সভাপতি জার্মেন্ট ত্রিপুরা বলেন, আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দীর্ঘ বছর ধরে রামগড় এলাকায় কাজ করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী ধর্ষণ, ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করেছি। এ লড়াই জারি রাখা ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকার কোন বিকল্প নেই। আজকের কাউন্সিলে যারা নতুন নেতৃত্ব আসবেন তাদেরকে দৃঢ়ভাবে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে।

ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্যদর শপথ গ্রহণ।

পরে ২য় পর্বে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের রামগড় উপজেলা শাখার ৬ষ্ঠ কাউন্সিলের মাধ্যমে ২১ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এতে লিটন চাকমাকে সভাপতি, রনি ত্রিপুরাকে সাধারণ সম্পাদক ও নয়ন চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। কমিটির সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান ক্যামেরন দেওয়ান।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের রামগড় উপজেলা শাখার ১ম কাউন্সিলে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটিতে গুলমনি চাকমাকে সভাপতি, ম্রাসাংথোই মারমাকে সাধারণ সম্পাদক ও মিতারাণী চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। কমিটির সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান পিংকি চাকমা।

এছাড়া অনুষ্ঠানে একটি ভূমি রক্ষা কমিটিও গঠন করা হহয়। এতে সুমন কান্তি চাকমাকে সভাপতি, তপরাই কার্বারীকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট রামগড় উপজেলা ভূমি রক্ষা কমিটি গঠন করা হয় এবং কমিটির সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান ইউপিডিএফ সংগঠক জিরান চাকমা।

শেষে সাংস্কৃতিক টিমের নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে যৌথ কাউন্সিলের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







Post a Comment