""

জুরাছড়ি-বিলাইছড়ি সীমান্তে পর্যটনের নামে পাহাড়ি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে

গাছবাগান পাড়ার একটি অংশ। এই গ্রামের বাসিন্দাদেরকে সেনাবাহিনী উচ্ছেদের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। ছবি: সংগৃহিত 

মন্তব্য প্রতিবেদন, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ৩ এপ্রিল ২০২৪

সম্প্রতি রাঙামাটির জুরাছড়ি-বিলাইছড়ি সীমান্তবর্তী গাছবাগান পাড়া ও থুমপাড়া নামের দুটি গ্রামের মধ্যবর্তী পিলার চুগ ও লাঙেল টিলা নামক স্থানে সেনাবাহিনী একটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়ার বাসিন্দাদের গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছে ও ভরা মৌসুমে জুমচাষে বাধা দিচ্ছে। সেনাবাহিনীর ২৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীর জুম খেত ধ্বংস করে দিয়েছে। ভুক্তভোগী গ্রামবাসীরা এসব অভিযোগ করেছেন।

সেনাবাহিনীর এই অন্যায় ভূমি জবরদখলের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী গ্রামবাসীরা গত ১৯ মার্চ রাঙামাটিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি দেন।

স্মারকলিপিতে তারা অভিযোগ করে বলেন, “গত ৯ মার্চ ২০২৪ সেনাবাহিনীর চাইচাল সেনা ক্যাম্পের সুবেদার প্রিয় রঞ্জন চাকমার নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল গাড়িযোগে গাছবাগান পাড়া গ্রামে উপস্থিত হয়ে গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়া গ্রামবাসীদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে ডেকে একটি সভা করে। এসময় সুবেদার প্রিয় রঞ্জন চাকমা গাছবাগান পাড়া গ্রামের ১২ পরিবারকে অচিরেই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং তা না হলে আগামীতে খারাপ সময়ের সম্মুখীন হতে বলে হুমকি প্রদান করেন। এসময় সেনা সদস্যরা আরো জানিয়ে দেয় যে, তারা থুম পাড়া ও গাছবাগান পাড়ার মধ্যবর্তী পিলার চুগ ও লাঙেল টিলাতে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করবে, তাই সেখানে ও আশেপাশের এলাকায় জুম কাটা যাবে না এবং ইতোমধ্যে কাটা জুমগুলোতে আগুন দেওয়া যাবে না। অর্থা এই দুই গ্রামে ও আশেপাশের এলাকায় জুমচাষ করা যাবে না।

গাছবাগান পাড়া ও থুমপাড়া গ্রামবাসীদের প্রধানমন্ত্রী বরাবরে দেওয়া স্মারকলিপি 

”এরপর গত ১১ মার্চ সেনাবাহিনী এক্সকেভেটর দিয়ে পিলার চুগ ও লাঙেল টিলায় মাটি কাটা শুরু করে এবং বুদ্ধলীলা চাকমার কাটা জুম ধুলিসা করে দেয়। এর পূর্বে গত ৬ মার্চ সেনাবাহিনী বীরসেন তঞ্চঙ্গ্যার কাটা জুম এক্সকেভেটর দিয়ে ধ্বংস করে দেয়।

”সর্বশেষ গত ১২ মার্চ ২০২৪ চাইচাল সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন কবির ও সুবেদার প্রিয় রঞ্জন চাকমা গাছবাগান পাড়া গ্রামের কার্বারি (গ্রাম প্রধান) থুদো চাকমার কাছ থেকে জুমের তালিকা চেয়েছেন। এসময় ক্যাপ্টেন কবির কার্বারি থুদো চাকমাকে বলেন, ‘তালিকা দিলেও পাড়া ছাড়তে হবে, না দিলেও পাড়া ছাড়তে হবে। সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে কারো কখনও লাভ হয়নি। অতএব, সরকারের বিরুদ্ধে না গিয়ে জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাও।’ এসময় ক্যাপ্টেন কবির রাতের মধ্যে জুমের তালিকা ক্যাম্পে গিয়ে জমা দিতে নির্দেশ দিয়ে যান।”

সেনাবাহিনীর সাইচল প্রকল্প ক্যাম্প, যে ক্যাম্প থেকে গাছবাগান পাড়া ও থুমপাড়া গ্রামবাসীদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে।
 ছবি: সংগৃহিত

উল্লেখ্য, গ্রামবাসীদের চলে যাওয়ার হুমকি দেয়ার আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল সাইফুদ্দিন আহমেদ চাইচাল আর্মি ক্যাম্পে যান। ধারণা করা হয় এ সময় তিনি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জুমচাষীদের জমি জবরদখলের চূড়ান্ত নির্দেশ দেন। স্মারকলিপিতে গ্রামবাসীরা উল্লেখ করেন, “গত ৮ মার্চ বিকাল আনুমানিক ৩ টায় হেলিকপ্টার যোগে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল সাইফুদ্দিন আহমেদ চাইচাল সেনা ক্যাম্পে সফর করেন। এর পরের দিনই (৯ মার্চ) চাইচাল ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা গ্রামে গিয়ে গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়ার জুম্ম গ্রামবাসীদের এই মর্মে জানিয়ে দেন যে, সেনা প্রধানের নির্দেশ জুমচাষ বন্ধ করতে হবে এবং গাছবাগান পাড়ার ১২ পরিবারকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।”

১২ পরিবারকে অন্যত্র চলে যাওয়ার নির্দেশ ছাড়াও অতিরিক্ত আরো ১৭ পরিবারকে জুমচাষে বাধা দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে স্মারকলিপিতে।

গ্রামবাসীরা তাদের স্মারকলিপিতে আরো বলেছেন, তাদের প্রধান জীবিকা জুমচাষ। বিগত ২৪/২৫ বছরে তাদের অনেকেই কলাবাগান, আম-কাঠাল বাগান, ঝাড়ু–ফলের বাগান গড়ে তুলেছে। জুমে অনেকে ধানচাষের পাশাপাশি আদা, হলুদ, তিল, মরিচ ইত্যাদি চাষও করেছেন।

স্মারকলিপিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, উক্ত স্থানে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হলে এবং উক্ত দুই গ্রাম উচ্ছেদ হলে, এর সাথে সাথে শুক্করছড়ি, চঙরাছড়ি, দুলুবাগান, বিলাইছড়ির মন্দিরাছড়া ও জুরাছড়ির মন্দিরাছড়া ইত্যাদি পাহাড়ি গ্রামগুলিও উচ্ছেদের শিকার হবে।

ভুক্তভোগীরা চারটি দাবি জানয়েছেন: গ্রাম ত্যাগ করার নির্দেশ প্রত্যাহার করা, গ্রাম সংলগ্ন পর্যটন স্থাপন না করা, জুম চাষে কোর বাধা প্রদান না করা এবং বাগান-বাগিচা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা।

সর্বশেষ জানা গেছে, গ্রামবাসীদের মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদানের পর সেনাবাহিনী তাদেরকে জুম চাষ করা ও কাটা জুমে আগুন দেয়ার অনুমতি দিয়েছে। তবে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার নির্দেশ এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি।

সেনাবাহিনী কর্তৃক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের নামে উচ্ছেদ বন্ধের দাবিতে গাছবাগান পাড়া ও থুমপাড়া গ্রামবাসীরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। ১৯ মার্চ ২০২৪, রাঙামাটি। ছবি: সংগৃহিত

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের নামে যেভাবে নিরীহ জুমচাষীদের জমি কেড়ে নিচ্ছে তা চরম অন্যায় ও অমানবিক। এটা কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। তারা কেবল পেশী শক্তির জোরে এমন কাজ করতে সক্ষম হচ্ছে, যা সবার কাছে স্পষ্ট।

আমরা মনে করি সেনাবাহিনীর অবিলম্বে তাদের গণবিরোধী এই প্রকল্প বন্ধ করা উচিত। সাধারণ মানুষের জীবিকা ধ্বংস করে, তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে বিত্তবান কিছু লোকের চিত্তবিনোদনের জন্য পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ কোন কাম্য প্রকল্প হতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জায়গায় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু এর ফলে সাধারণ মানুষের কোন উপকার হয়েছে বলে জানা যায় না। বরং অনেক পাহাড়িকে এর জন্য উচ্ছেদ ও সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে। পর্যটনের বলি হতে হয়েছে।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের জন্য এমন জায়গা বেছে নেয়া হয়, যা পাহাড়ি অধ্যুষিত বা যেখানে পাহাড়িদের বসবাস রয়েছে। আজ পর্যন্ত এমন জমি পর্যটনের জন্য নির্বাচন করা হয়নি, যেখানে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বা যেখানে সেনা ক্যাম্প রয়েছে। বলা হয় বাঘাইহাট সেনা ক্যাম্প থেকে যে দৃশ্য দেখা যায়, তা সুইজারল্যাণ্ডের মতো। তাহলে আমাদের প্রশ্ন হলো সেই ক্যাম্পকে কেন পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয় না? মোট কথা, তথাকথিত পর্যটনের জন্য পাহাড়িদের জমি বেছে নেয়ার কারণ হলো তাদেরকে উচ্ছেদ করা। জমি বেদখলের অন্য এক কৌশলের নাম হলো এখন পর্যটন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মুনাফাখোরদের পর্যটন পাহাড়িদের কীভাবে উচ্ছেদ করছে, কীভাবে তাদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে জুরাছড়ি-বিলাইছড়ির উক্ত ঘটনা একটি উদাহরণ মাত্র। ইতোপূর্বেও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার নামে পাহাড়িদেরকে ঐতিহ্যগত জুম চাষের জমি ও ভিটেমাটি থেকে উখাত করা হয়েছে।

বান্দরবানে নীলগিরি নামে একটি পর্যটন রিসোর্ট নির্মাণের জন্য ম্রোদের জমি দখল ও তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছে। চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণের নামে স্থানীয় ম্রোদের জমি বেদখল করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে ম্রো জাতিসত্তার জনগণ ব্যাপক প্রতিবাদ সত্ত্বেও প্রকল্পটি বাতিল করা হয়নি।

সাজেকের রুইলুই পাহাড়ে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের ফলে সেখানে বসবাসরত পাহাড়ি বিশেষত পাংখোয়া জাতিসত্তার জনগণকে উচ্ছেদের শিকার হতে হয়েছে এবং এখনও অনেকে উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছে। সম্প্রতি সেখানে এক রিসোর্ট মালিক অবাধে পাহাড় কেটে সুইমিং পুল নির্মাণ করছে বলে খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এই যে “পর্যটন ও উন্নয়নের” মহোসব চলছে তা পাহাড়িদের জন্য কোন সুফল বয়ে আনছে না, বরং এর ফলে তারা প্রান্তিক থেকে অধিকরতর প্রান্তিক অবস্থানে নেমে যাচ্ছে। অপরদিকে পর্যটনের কারণে লাভবান হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা-আমলা ও পুঁজিপতি বাঙালি ব্যবসায়ীরা। এক কথায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন হলো এদের জন্য পরম আশির্বাদ, আর পাহাড়িদের জন্য মহা অভিশাপ।

পাহাড়িরা পর্যটনের সুফল না পাবার কারণ হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের রাজনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষমতা না থাকা, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অনুপস্থিতি এবং পর্যটন যেভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে তাতে তাদের কোন মতামত ও নিয়ন্ত্রণ না থাকা। বর্তমান আইন মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় পর্যটন জেলা পরিষদের এক্তিয়ারভুক্ত হলেও তা কেবলমাত্র কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। উপরন্তু জেলা পরিষদ নিজেই সরকার ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের এ ধরনের পাহাড়ি স্বার্থ বিরোধী সকল প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। কারণ জেলা পরিষদের যারা কর্ণধার তারা হলো সরকারেরই মনোনীত ব্যক্তি, তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নন।

পর্যটনের সাথে সাধারণত আরও অনেক বিষয় জড়িত থাকে। তার মধ্যে একটি হলো প্রাকৃতিক পরিবেশ। অবাধে পর্যটন নির্মাণের ফলে কেবল যে পাহাড়িরা উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে তা নয়, একই সাথে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পর্যটনের কারণে যত্রতত্র পাহাড়-বন কেটে রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলে উজার হয়ে যাচ্ছে বন। এতে পরিবেশের উপর মারাত্মক কুপ্রভাব পড়ছে। পানীয় জলের সংকটসহ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে পাহাড়িদের। 

সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখলের হাতিয়ার হিসেবে পর্যটনকে ব্যবহার করে পাহাড়িদের উচ্ছেদপূর্বক কায়েমী স্বার্থ হাসিল করতে চায়। এ জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ও নিয়ন্ত্রণের ভার সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। ফলে সেনাবাহিনী যা খুশি তাই করে যাচ্ছে। এ নিয়ে কেউ প্রতিবাদ কিংবা আন্দোলন করতে চাইলে তাদেরকে ‘সন্ত্রাসী বা উন্নয়ন বিরোধী” আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, খুন, গুম করছে।

এ অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না। এ নিয়ে সবাইকে সোচ্চার হবার সময় এসেছে। জুরাছড়ি-বিলাইছড়ি সীমান্তের দুই গ্রামের বাসিন্দাদের উচ্ছেদের পাঁয়তারাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি উচ্ছেদের সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া আর অন্য কোন পথ খোলা নেই।#



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments