""

সংবিধানে ‘বাঙালি জাতীয়তা’ চাপিয়ে দেয়া ‘পঞ্চদশ সংশোধনী’ বাতিল হয়নি ১৩ বছরেও!


সিএইচটি নিউজ ডেস্ক
রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪

সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয় ২০১১ সালের ৩০ জুন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের ভিন্ন ভাষাভাষী সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় বাঙালি জাতীয়তা। আওয়ামী লীগ সরকার সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে তড়িঘড়ি করে সংসদে উক্ত ‌পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি পাস করে নেয়। এতে ৬ অনুচ্ছেদের (২)-এ বলা হয়েছে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিতি হইবেন”। যদিও কারা জনগণ আর কারা নাগরিক কিংবা জনগণ ও নাগরিকের মধ্যে পার্থক্য কী তার কোন ব্যাখ্যা সরকার দেয়নি।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কার্যত দেশে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খিয়াং, ম্রো, খুমি, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, পাংখো, রাখাইন, সান্তাল, গারো, মনিপুরি, ওঁরাওসহ দেশে বসবাসরত ৪৫টির অধিক জাতিসত্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে।

উক্ত বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হয়েছে। এখনো প্রতিবাদ চলমান রয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘু দরদী ভাণ করা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৩ বছরেও এ সংশোধনী বাতিল বা সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

স্মর্তব্য যে, সংবিধানের এই পঞ্চদশ সংশোধনী আনয়নের জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। সংসদে আইনটি পাসের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করে ইউপিডিএফ ২০১০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সংবিধান সংশোধনী কমিটির নিকট দেশের সকল জাতিসত্তার স্ব স্ব পরিচয়ে সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’ ঘোষণাসহ ৬ দফা সংশোধনী প্রস্তাবনা দিয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন ও দেশে বসবাসরত জাতিসত্তাসমূহের পক্ষ থেকেও নানা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার এসব দাবি-দাওয়ার কোন গুরুত্ব না দিয়ে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করে।

এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মুলত বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ এদেশে বসবাসরত বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিগুলোকে বাঙালি বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। যার কারণে ১৯৭২ সালের সংবিধানেও বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে “বাঙালি” হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ এর বিরুদ্ধে সে সময় সংসদের ভেতরে ও বাইরে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।

’৭২ সালের ৩১ অক্টোবর সংসদে খসড়া সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বাঙালি জাতীয়তা অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “মাননীয় স্পীকার, আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষা বাঙালিদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সংগে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবদিক দিয়েই আমরা একসঙ্গে একযোগে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দ পুরুষ-- কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি। ...আমি জানি না, আজ আমাদের এই সংবিধানে আমাদেরকে কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চায়’’।

এরপর স্পিকার তাঁকে ‘আপনি কি বাঙালি হতে চান না’? এমন প্রশ্ন করলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমাদেরকে বাঙালি জাতি বলে কখনও বলা হয় নাই। আমরা কোনো দিনই নিজেদেরকে বাঙালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশী বলে মনে করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়”।

কিন্তু সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে সেদিন সংসদে “বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন’ এই প্রস্তাবটি সংসদে পাস করা হলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তা প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদস্বরূপ সংসদ কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে তিনি ’৭২-এ সংসদে গৃহিত সংবিধান আইনে স্বাক্ষর করেননি বলেও জানা যায়।

তবে পরবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রহিত করে তার পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করে।

কিন্তু ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ ’৭২ এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলে সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে সংসদে ‘পঞ্চদশ সংশোধনী’ বিল পাস করে পূনরায় সংবিধানে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করে। এতে দেখা গেল, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এর প্রতিবাদ তো করেনই নি, বরং টেবিল চাপড়িয়ে এর সমর্থন দিয়েছেন। যে দলিলে তাদেরকে ও তাদের নিজ নিজ জাতির জনগণকে বাঙালি বলে হেয় ও অবজ্ঞা করা হয়েছে সে দলিলে তারা বিনা দ্বিধায় স্বাক্ষর করেছেন! এটা জাতির জন্য বড়ই লজ্জার।

উগ্রবাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেওয়া এই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবি জানিয়ে ইউপিডিএফের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ লাল পতাকা মিছিল, তিন জেলা জুড়ে সর্ববৃহ ও দীর্ঘ গণ-মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, লাল কার্ড প্রদর্শন--ইত্যাদি নানা কর্মসূচি পালন করেছে এবং এখনো এ দাবিতে সোচ্চার রয়েছে। কিন্তু ১৩ বছরেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এই সংশোধনী বাতিল বা সংশোধন করেনি। উপরন্তু সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে আগের চাইতেও নিপীড়ন-নির্যাতনের মাত্রা আরো বৃদ্ধি করেছে।

বিতর্কিত এই পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষমতাবলে সরকার সংখ্যালঘু ভিন্ন ভাষাভাষী ও ধর্মীয় জাতিসত্তাগুলোকে বাঙালি বানানোর প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি চিঠিপত্র ও দলিলে জাতিসত্তার প্রতিনিধিদেরকে ‘জনাব’, ‘বেগম’ এমনকি ২০২২ সালে রাঙামাটির লংগদু থানা পুলিশের এক এএসআই কর্তৃক চাকমা সম্প্রদায়ের এক বাদিকে ”মো.” সম্বোধন করে নোটিশ জারি করা হয়েছিল। যদিও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আপত্তির মুখে তিনি এর জন্য ভুল স্বীকার করেছিলেন।

শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গার নামেও আনা হচ্ছে পরিবর্তন। পাহাড়িদের আদি নাম বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে ইসলামী নাম বসিয়ে সাইনবোর্ড লাগানো হচ্ছে। বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বহাল থাকলে ভবিষ্যতে এই বাঙালি বানানোর প্রক্রিয়া যে আরো জোরদার করা হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

কাজেই, সংবিধানের এই বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সকল জাতিসত্তাসমূহের ওপর চাপিয়ে দেওয়া উগ্রবাঙালি জাতীয়তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments