আগর চাকমা
দুই যুগ আগে ‘No Autonomy, No Rest’ সংবলিত ব্যানার ১৯৯৮ সালে ১০ই ফেব্রুয়ারি শাসকগোষ্ঠীর অভেদ্য নিরাপত্তার ছাউনি ভেদ করে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে উড়েছিল। কয়েক হাজার লোকের সামনে সেদিন প্রখর রোদে যখন শান্তিবাহিনীর সদস্যদের আপাদমস্তক অপমান করে মাঠে বসে রাখা হয়েছিল, সেদিনই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতা কর্মীরা সেই ঐতিহাসিক ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসনই পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র সমাধান’ ব্যানার উঁচিয়ে ধরেছিল, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ আজ আপন করে নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে পাহাড়ে রাষ্ট্র এবং শাসকগোষ্ঠীদের অব্যাহত দমন-পীড়ন, অত্যাচার, ভূমি-বেদখল, ধর্ষণ এবং ধর্মান্তরিতকরণসহ সকল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৯৭২ সাল থেকে সশস্ত্র এবং ৯০ দশকের শুরুর দিক থেকে গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজপথে লড়াই শুরু হয়। কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে জনগণের এই লড়াই তা ৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর জেএসএসের চুক্তির মাধ্যমে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
এই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে পাহাড়ের প্রাণের দাবি পূর্ণস্বায়ত্তশাসন কায়েমের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর গঠন করা হয় নতুন যুগের নয়া পার্টি ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ইউপিডিএফের এই দাবি সম্পর্কে সন্তু লারমা সেদিন খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, ‘তারা (ইউপিডিএফ) পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। যে অধিকার চুক্তিতেই রয়েছে।’ (আজকের কাগজ, ১১ ফেব্রুয়ারী,৯৮') কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই সন্তু বাবু তার নিজের এই কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে অন্য একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “তাদের (ইউপিডিএফ'এর) পূর্নাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের ব্যাখা সেটা ঠিক নয়। পূর্নাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন বলতে কোনো স্বায়ত্তশাসন পৃথিবীতে নেই। এমন কিছু পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমি কোনোদিন শুনিনি। কোনো রাজনৈতিক বইয়েও আমি দেখিনি। (সাপ্তাহিক ২০০০, ২৬ শে নভেম্বর ৯৯',পৃষ্ঠা ৩০)
১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে সন্তু লারমার নেতৃত্বে শান্তিবাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে
পিসিপি-পিজিপি-এইচডব্লিউএফ নেতা-কর্মীরা No Full Autonomy No Rest লেখা ব্যানার প্রদর্শন করেন।
এরপর থেকেই সন্তু বাবু বলে বেড়াচ্ছেন ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’ শব্দ নাকি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। শুধু সন্তু লারমা নয়, জেএসএসের প্রায় সকল নেতা-কর্মী এখনও একই বুলি আওড়ে বেড়াচ্ছেন। জেএসএসের নেতা-কর্মিদের পূর্ণস্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে যে ধারণা তা তাদের রাজনৈতিক তত্ত্ব ও পড়াশোনার অভাবকেই নির্দেশ করে।
তাদের জ্ঞাতার্থে বলা দরকার, পূর্ণস্বায়ত্তশাসন শব্দটি বহু আগে থেকেই রাজনীতিতে প্রচলিত রয়েছে। এখানে তার কয়েকটি উদাহারণ দেয়া যেতে পারে।
উদাহরণ: ১। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মাওলানা আব্দুল কালাম আজাদ তার ‘India Wins Freedom’ গ্রন্থে ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’ বা ‘Full Autonomy’ কথার উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন- “The Muslim League demanded that the Muslim majority province's should have full autonomy.(Page-153).
উদাহরণ: ২। বাংলাদশের স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে ১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্ট যে ২১ দফা পেশ করেছিল তার মধ্যে ১৯ নং দফাতে বলা হয় যে, “লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বংগকে পূর্ণ-স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও সার্বভৌমিক করা হবে।”
উদাহরণ: ৩। ১৯৬৬ সালের ৪-৭ জুন ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় “জাতীয় মুক্তির কর্মসূচি” শিরোনামে গৃহিত কর্মসূচির ১নং ধারার (ক) উপধারায় বলা হয়েছে যে- “ফেডারেল শাসন ব্যবস্থার অধীনে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের ‘পূর্ণ-স্বায়ত্তশাসনের’ অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান।”
উদাহরণ: ৪। দুই বছর পর ১৯৬৯ সালের ১৪ই জানুয়ারী আবার সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ১১ দফার ৩নং দফায় উল্লেখ করা হয় যে- “ নিম্নলিখিত দাবিসমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবেঃ
(ক) দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হইবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম।
(খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ।
উদাহরণ: ৫। গত ২৩ শে ফেব্রুয়ারী ২০২২ দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো'তে “পুতিনের কাছে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়া দোনেৎস্ক–লুহানস্কের নেতৃত্বে যাঁরা” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয় যে-
‘২০১৪ সালে কিয়েভে বিক্ষোভের মুখে ইউক্রেনের মস্কোপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন। সে সময়ই ক্রিমিয়ার পাশাপাশি এই দুই অঞ্চলের রুশপন্থীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন ক্রিমিয়াকে রাশিয়া দখল করে নেয়। আর দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের নেতারা ইউক্রেন থেকে নিজেদের “পূর্ণ-সায়ত্তশাসন” দাবি করেন।’
উদাহরণ: ৬। রিসোর্স সেন্টার এবং ডাটাবেইজ ভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘ Law insider’-এ বলা হয়েছে:
Full autonomy comprises the following five aspects of autonomy: institutional, political, administrative, local finance and National economic autonomy. Full autonomy would allow realising the benefits of fiscal federalism.
অর্থাৎ পূর্ণস্বায়ত্তশাসন পাঁচটি বিষয় নিয়ে গঠিত। সেগুলো হল:
(১) প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার
(২) রাজনৈতিক অধিকার
(৩) প্রশাসনিক অধিকার
(৪) স্থানীয় অর্থনৈতিক অধিকারএবং
(৫) জাতীয় অর্থনৈতিক অধিকার
সুতরাং এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, ‘পূর্ণ-স্বায়ত্তশাসন’ শব্দটির অস্তিত্ব নেই বলে সন্তু লারমা ও জেএসএসের নেতা-কর্মীদের বক্তব্য সত্য নয়। পূর্ণস্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে এই বক্তব্য দিয়ে তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেও, এতে তারা নিজেদের অজ্ঞতা ও মূর্খতাকেই সবার কাছে প্রকাশ করছেন। তারা এভাবে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে শাসকগোষ্ঠীর সাথে একই সুরে ইউপিডিএফের লড়াই তথা জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে নসাৎ করার পায়তারা করছে।
এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলোর একমাত্র সমাধান হলো পূর্ণস্বায়ত্তসাশন। পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের মাত্রা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। তবে এই অধিকারটি নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমেই কেবল পাহাড়ের জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটতে পারে। কিন্তু সরকারের ক্ষমতালিপ্সু কিছু দালাল এই পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের লড়াইকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করার পাঁয়তারা করে চলেছে। তাই, এসব দালাল, লেজুড়, সরকারপন্থীদের প্রতিহত করে আমাদের সকলকে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আপোষহীন লড়াইয়ে সামিল হয়ে অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে।
অধিকারের এই লড়াইয়ে আমাদের বিজয় অনিবার্য। #
তথ্যসূত্রঃ
১.Ghai, Yash; Woodman,
Sophia (২০১৩)। Practicing Self-Government: A Comparative Study of Autonomous
Regions.
২.https://www.lawinsider.com/dictionary/full-autonomy
৩.D.V jemna,M.Onforei,
Elena Cigu: Demographic and social economic determinants of local finance
autonomy in Romania
৪.১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও
১১ দফা আন্দোলন, বাংলা ট্রিবিউন
৫. বাাংলাদেশ : স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা, মো: নাছির
উদ্দিন, শাহ শ্যামুয়েল কায়জার, ড.খুদরতই খুদা(বাবু), International Journal
of Humanities & Social Science Studies (IJHSSS).
* লেখক পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
শাখার সদস্য।
[মুক্তমত বিভাগে
প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত ]
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।