""

রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা হামলা: এ জান্তব হিংস্রতা কেন?

।। মন্তব্য প্রতিবেদন ।।

দীঘিনালায় বিনা উস্কানিতে পাহাড়ি বসতিতে সাম্প্রদায়িক অগ্নিহামলা (১৯ সেপ্টেম্বর, বিকেল ৪:৩০টা), তার প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে গুলি (১৯ সেপ্টে: রাত ১০-১২টা) এবং এই দুই ঘটনার প্রতিবাদে রাঙ্গামাটি শহরে “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের” আয়োজিত শান্তিপূর্ণ মিছিলে সেটলারদের সংগঠিত হামলার নেপথ্যে কারণ কী?

ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে দীঘিনালায় বাঙালি ছাত্র পরিষদের একটি মিছিল থেকে। তাদের ভাষায় তারা ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মামুন নামে এক মোটর সাইকেল চোরের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল করছিলেন। মামুনের মৃত্যু সম্পর্কে খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আব্দুল বাতেন মৃধার ভাষ্য হলো, ‘মোটর সাইকেল চুরি করে পালানোর সময় বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা লেগে মামুন আহত হন।’ বাঙালি ছাত্র পরিষদ তার মৃত্যুর কারণ গণপিটুনি বলে উল্লেখ করলেও, আব্দুল বাতেন সাহেব জানান, ‘গণপিটুনির বিষয়টি তার জানা নেই।’

রাঙামাটি শহরে সেটলারদের হামলায় আহত এক শিক্ষার্থী

তবে যেভাবেই হোক মামুনের মৃত্যুর ঘটনাটি দুঃখজনক। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হল, বাঙালি ছাত্র পরিষদ তার মৃত্যুকে পুঁজি করে প্রতিবাদের নামে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা করতে গেল কেন? যদি যুক্তির খাটিরে ধরেও নেয়া হয় যে, গণপিটুনিতে মামুনের মৃত্যু হয়েছে; তার জন্য কি আইন আদালত নেই? প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাসহ অনেকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য বার বার অনুরোধ ও আহ্বান জানিয়ে আসছেন। উনাদের আবেদনের প্রতি বাঙালি ছাত্র পরিষদ কেন ন্যুনতম সম্মান পর্যন্ত দেখাতে ব্যর্থ হলো?

অতীতেও আমরা নানা মিথ্যা অজুহাতে পাহাড়িদের ওপর হামলা চালাতে দেখেছি। সে সম্পর্কে বলতে গেলে কয়েক খণ্ডে বই লেখা যাবে। এই মুহূর্তে শুধু একটি ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাই, ২০১২ সালে রাঙ্গামাটি শহরে একই কায়দায় যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছিল, তার পটভূমি হিসেবেও ছিল রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজ বাসের সিটে বসাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ছাত্রদের সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধানো।

আসলে এক শ্রেণীর সেটলারদের দাঙ্গা-প্রীতি দেখলে অবাক হতে হয়। কারণ-অকারণে পাহাড়িদের বসতিতে-উপসনালয়ে হামলা চালানো, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, তাদের ধনসম্পদ লুটপাট করা এদের একটি বদঅভ্যাস বা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারে পরিণত হয়েছে। তবে এটাও সত্য যে, এই মনুষ্যত্বহীনতা ও অসভ্যতা সব সেটলারের বৈশিষ্ট্য নয়। অনেক সেটলার এ ধরনের বিবেকবর্জিত গর্হিত কাজ সমর্থন করেন না। কিন্তু তা সত্বেও দশকের পর দশক ধরে সভ্য সমাজে নিন্দনীয় এই ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে।

রাঙামাটিতে লাঠিসোটা হাতে হামলাকারী সেটলার বাঙালিরা। ছবি: সংগৃহিত

এর নেপথ্যে কারণ কী? কারণ হলো একটাই: পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-সেটলারদের একটি অংশের মধ্যে দীর্ঘ কয়েক দশকে যে কায়েমী স্বার্থ সৃষ্টি হয়েছে তাকে রক্তপাত ঘটিয়ে হলেও টিকিয়ে রাখা। ১৯৯০ দশকে প্রবল ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর প্রথম বার পার্বত্য চট্টগ্রামে এই কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীটির ভিত টলমল হয়েছিল। সে সময় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অভূতপূর্ব ছাত্র-গণআন্দোলন মোকাবিলার জন্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ ও পার্বত্য গণ পরিষদের মতো চরম প্রতিক্রিয়াশীল উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটলার সংগঠন সৃষ্টি করে মাঠে নামানো হয়েছিল। আর তার বিষময় ফল হয় পাহাড়িদের ওপর একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা ও গণহত্যা। যেমন ১৯৯২ সালের ২০ মে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ভণ্ডুল করে দিতে রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়েছিল। বনরূপা ও কাটা পাহাড়ে পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছিল। সেই ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে ত
কালীন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান পদত্যাগ করে নজীর স্থাপন করেছিলেন।

বর্তমানেও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সৃষ্ট ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন” এর নেতৃত্বে এখন জুম্মরা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছে। দীঘিনালা হামলার একদিন আগে ১৮ সেপ্টেম্বর তারা খাগড়াছড়িতে হাজার হাজার ছাত্র জমায়েত করে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছে, সমতলের মতো পাহাড়েও মুক্ত হাওয়া দাবি করছে, এমনকি সংঘাত বন্ধের জন্য সকল পক্ষকে চাপ দিচ্ছে।

খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত রুবেল ত্রিপুরা

কিন্তু পাহাড়ি ছাত্রদের এই ঐতিহাসিক উত্থান ও আন্দোলন কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীটি মেনে নিতে পারছে না। তার চায় না পাহাড়িরা ঐক্যবদ্ধ হোক, তাদের মধ্যে সংঘাত বন্ধ হোক, তারা চায় না তাদের কায়েমী স্বার্থে আঘাত আসুক। সে কারণে তারা সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা চলমান আন্দোলনকে অঙ্কুরে বিনাশ করে দিতে আগের মতো একই কৌশল গ্রহণ করেছে এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোকে মাঠে নামিয়েছে। এই উগ্র ফ্যাসিস্ট সেটলার সংগঠনগুলো যদি এতই বাঙালি স্বার্থের ধ্বজাধারী হয়, তাহলে তারা সাজেকের বাঘাইহাটে গত ১৮ জুন সেনা ক্যাম্পের পাশে ঠ্যাঙাড়েদের গুলিতে মো: নাঈম নামে এক নিরীহ বাস হেলপার নিহত হলে তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিবাদ না করে নীরব ছিল কেন?

যদি কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীটি তাদের নীতি পরিবর্তন না করে বা পরিবর্তনের জন্য তাদেরকে বাধ্য করা না হয়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের আরও হামলার জন্য সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে প্রস্তুত থাকতে হবে। (সমাপ্ত)



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments