মিটন চাকমা বিপ্লবী হিসেবে আমাদের পাঠেয় ও অনুকরণীয়- স্মরণসভায় বক্তারা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি এবং ইউপিডিএফ সংগঠক শহীদ মিটন চাকমার স্মরণসভা ও তাঁর সংগ্রামী জীবনের উপর চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আজ শনিবার (১৬ নভেম্বর ২০২৪) বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে লাইব্রেরি প্রাঙ্গনে বেলা ২.৩০টায় এ স্মরণসভা
অনুষ্ঠিত হয়।
স্মরণসভায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের চবি শাখার সাধারণ সম্পাদক ভূবন চাকমার সঞ্চালনায়
শহীদ মিটন চাকমার সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং ইউপিডিএফের সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমার শহীদ
মিটনকে নিয়ে লেখা পাঠ করেন সুমেন্টু চাকমা। এরপর শহীদ মিটন চাকমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
মিটন চাকমাসহ শহীদদের সম্মানে নিরবতা পালন করা হচ্ছে। |
স্মরণসভায় বক্তব্য দেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি সহ-সাধারন সম্পাদক সমর চাকমা, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগঠক আহমেদ মুগ্ধ, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল সংগঠক ধ্রুব বড়ুয়া, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের চট্টগ্রাম নগর সম্পাদক অমিত চাকমা। সভাপতিত্ব করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রোনাল চাকমা।
পিসিপি'র কেন্দ্রীয় নেতা সমর চাকমা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে অনেকে
নিজের চিন্তায় মশগুল থাকেন। মিটন চাকমা এই সময়ে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মানুষের কল্যাণার্থে
কাজ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। একটি জাতিতে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম জারি রাখতে হয়। মিটন চাকমা
আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে যায়। মিটন চাকমাকে অনুসরণ করে আগামী দিনে আপোষহীন লড়াই সংগ্রামে
আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি আরো বলেন, জেএসএস (সন্তু) সন্ত্রাসীরা শুধু মিটন চাকমাকে হত্যা করেনি।
তারা অনিমেষ, তৎকালীন পিসিপির সভাপতি রূপক চাকমাসহ অনেক সহযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা
করেছে। আপনারা জানেন, এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুনীল ত্রিপুরা ও বিপুল-লিটন
চাকমাকে গত বছর ১১ ডিসেম্বর পানছড়িতে সেনাবাহিনী সৃষ্ট ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী কর্তৃক হত্যা
করা হয়। পাহাড়ের যে সংঘাত এটা শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া। জেএসএস শাসকগোষ্ঠী ফাঁদে পা
দিয়ে সংঘাত বাঁধাচ্ছে। এতে তাঁরা শাসকগোষ্ঠীকে লাভবান করছে। আমরা জেএসএসকে শত্রু মনে
করি না। আমাদের প্রধান শত্রু শাসকগোষ্ঠী। জেএসএস আপামর পাহাড়ি জনগণের ঐক্যর ডাক পরিহার
করে ভাতৃঘাতী সংঘাতে নিজের জাতভাইকে হত্যা করছে। এতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, জেএসএস
পাহাড়ি জন-মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজেদের গদি রক্ষার জন্য শাসকগোষ্ঠী
তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করছে। গত জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনার সাথে সুর মিলিয়ে জেএসএসের
কেন্দ্রীয় নেতা ঊষাতন তালুকদার আন্দোলনকারীদের ‘নব্য রাজাকার’ অ্যাখ্যা দিয়ে আইনি ব্যবস্থা
গ্রহণের জন্য প্ররোচিত করেছিল৷ হাসিনার পতন হলেও তাঁরা এখনো পাহাড়ে ফ্যাসিস্টদের দোসরের
ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
স্মরণসভায় বক্তব্য রাখছেন ধ্রুব বড়ুয়া। |
ধ্রুব বড়ুয়া শহীদ মিটনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, করোনা পরবর্তী সময়ে পরিবহন চালু, ক্যাম্পাসে নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধে রাজেশ দাশগুপ্ত, আশরাফি নিতুর সঙ্গে মিটন চাকমাও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে ছিলেন। মিটন চাকমা পাহাড়ের লড়াই-সংগ্রাম আদর্শের প্রতীক। পৃথিবীতে অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁর মধ্যে মিটন চাকমা অন্যতম হিসেবে থাকবেন। ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে মিটন চাকমা'র নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নিপীড়িত মানুষের লড়াই সংগ্রামের জন্য তিনি মাঠ পর্যায়ে গণমানুষের সাথে মিশে যেতে পেরেছেন। পুঁজিবাদী সমাজের খোলস ছুঁড়ে দিয়ে সেটা থেকে বেড়িয়ে আসতে পেরেছিলেন। মিটন চাকমা বিপ্লবী হিসেবে আমাদের পাঠেয় ও অনুকরণীয়।
পিসিপি নেতা অমিত চাকমা তাঁর বক্তব্য বলেন, ১০ই নভেম্বর ছিল এম এন লার্মার
মৃত্যুবার্ষিকী। মিটন চাকমাকে এই দিনে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে জেএসএস সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
প্রতিবছর যখন লার্মার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হবে, সে সাথে মিটন চাকমাকেও শ্রদ্ধাভরে
স্মরণ করা হবে। আজকের এইসময়ে মিটনরা তরুণ সমাজের আদর্শ। আত্মপ্রতিষ্ঠার দিকে না গিয়ে
জাতির অধিকার অর্জনে মিটন সামিল হয়েছিল। মিটনকে হত্যা করা গেলেও, তার আদর্শকে হত্যা
করে সম্ভব হয়নি। তরুণ ছাত্র সমাজ তার আদর্শে বলীয়ান হয়ে আরো হাজার হাজার মিটন হিসেবে
নিজেকে তৈরী করবে। হত্যা করে কোনদিন লড়াই-সংগ্রাম থামিয়ে দেওয়ার নজীর ইতিহাসে নেই,পার্বত্য
চট্টগ্রামের লড়াই সংগ্রামও থামিয়ে দিতে পারবেন না।
স্মরণসভায় বক্তব্য রাখছেন আহমেদ মুগ্ধ। |
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী সংগঠক আহমেদ মুগ্ধ তার বক্তব্য বলেন, আমি যখন ক্যাম্পাসে পদার্পন করি ব্যক্তিগতভাবে মিটন চাকমা সাথে পরিচয় ছিল না। আমি মিটন চাকমার সম্পর্কে জেনেছি কমরেড রোনাল, কমরেড আশরাফি নিতু থেকে। ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে মিটন চাকমা সামনের সারিতে ছিলেন। তাঁর সংগ্রামমুখর জীবন আমাদের উজ্জীবিত করে। পাহাড় জনজাতি মানুষের অধিকার আদায়ে লড়াই সংগ্রাম করতে গিয়ে মিটন চাকমা শহীদ হন। ভাগ কর, শাসন কর নীতি শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ে সুকৌশলে জিইয়ে রেখেছে। পাহাড়ের সংঘাত পাহাড়ি মানুষের মুক্তি এনে দিতে পারবে না। পাহাড়ের মুক্তির জন্য সংঘাত বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করাটা জরুরী।
স্মরণসভায় বক্তব্য রাখছেন রোনাল চাকমা। |
সভাপতি রোনাল চাকমা বলেন, পাহাড় আর তাঁর সবচেয়ে মেধাবী, যোগ্য পুত্র হারানোর
শোক নিতে পারছে না। পাহাড়ে আর কত মৃত্যু দেখতে হবে। মিটন চাকমা'র মৃত্যু আলুটিলা পাহাড়ের
চেয়েও ভারী। পাহাড়ে সম্ভাবনাময়ী তরুণ নেতৃত্বকে ধরে ধরে টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে।
যাতে পাহাড়ে ভবিষ্যতে লড়াই সংগ্রাম পরিচালনা না করা যায়। লড়াই সংগ্রাম সহজ কোনো পথ
নয়। শত প্রতিবন্ধকতা, শত ত্যাগ করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। শহীদ মিটন, রূপক, সুনীল ও
বিপুলদের মৃত্যু সেটা মনে করিয়ে দেয়। সঠিক আদর্শে লড়াই সংগ্রাম করতে গিয়ে অনেক সময়
মৃত্যু দিয়ে প্রমাণ করে যেতে হয়। মৃত্যুর শেষ মুহূর্তেও মিটন চাকমা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার
জন্য আহ্বান করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মুক্তির জন্য যদি মিটন হতে হয় আমরা
প্রস্তুত আছি। বীর মিটন আমাদের গর্ব ও প্রেরণার উৎস।
স্মরণসভা স্থলে মিটন চাকমার সংগ্রামী জীবনের উপর বেশ কিছু আলোকচিত্র প্রদর্শন
করা হয়।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।