রবি শংকর চাকমা, সাধারণ সম্পাদক, ইউপিডিএফ
মিটন চাকমার সাথে আমার প্রথম কখন দেখা হয় তার সন তারিখ আজ আর মনে নেই।
সে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কাজের সাথে
জড়িয়ে পড়ে তখন চট্টগ্রামের কোন এক বাসায় তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাত ও পরিচয়
হয়। এটা খুব সম্ভব ২০১৬ সালের দিকে হতে পারে। এরপর আমরা সাংগঠনিক কাজের জন্য ঘন ঘন
বসতাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি, রাজনীতি ও কাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা
করতাম। তার সাথে পিসিপির আরও অনেকে থাকতো।
আমার দেখায় মিটন একজন আদর্শবান ও একনিষ্ঠ সংগঠক। ব্যক্তি হিসেবে সে সৎ,
মিতভাষী, ভদ্র ও অমায়িক স্বভাবের। তার জীবন যাপন ছিল সাদাসিধা, আচরণ ছিল সরল ও অকপট।
কোন ধরনের ভণিতা তার মধ্যে ছিল না। নিজ দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সে ছিল সব সময় সচেতন।
মিটন চাকমা। সংগৃহিত ছবি |
ইউপিডিএফের নীতি আদর্শের প্রতি তার বিশ্বাস ছিল প্রগাঢ় ও অবিচল। এজন্য পালি বিভাগ থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করতে না করতেই সে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সরাসরি পার্টিতে যোগ দেয় এবং পানছড়ি ইউনিটে দায়িত্ব নেয়। যেখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা শেষ করার আগেই অনেকে চাকুরী ও অন্যান্য ব্যক্তিস্বার্থের ধান্দায় ঘুরে বেড়ায়, মিটন তাদের মতো ছিল না। হীন ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তায় সে মশুগুল থাকেনি। ত্যাগের মহান ও সুউচ্চ আদর্শ ধারণ করে সে জনগণের কল্যাণে নিজের জীবন সঁপে দেয়। সমাজে তার মতো এমন মহৎ মানুষের সংখ্যা খুব বেশি থাকে না। এজন্য বলা হয় যে জীবন নিজ স্বার্থে নয়, অন্যের জন্য, সমাজ জাতি ও জনগণের সেবায় নিবেদিত, সে জীবনই শ্রেষ্ঠ জীবন। মিটন এই শ্রেষ্ঠ জীবনই লাভ করেছে। তার বীরোচিত শহীদান তার জীবনকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে।
পার্টিতে তার কর্মজীবন বেশি দিন হয়নি। পার্টিকে ও সমাজ-জাতিকে তার আরও
অনেক কিছু দেয়ার সময় ছিল। সে সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করছিল। কিন্তু নরাধম ঘাতকের
বুলেট তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে জাতিকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছে।
যে ক’দিন মিটন পার্টিতে কাজ করেছে, আন্তরিকভাবেই সে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব
পালন করেছে। তার মধ্যে কোন ধরনের অবহেলা ও গাফিলতি ছিল না। সে কোনদিন পার্টি শৃঙ্খলা
লঙ্ঘন করেছে, অনিয়ম করেছে – এমন কোন অভিযোগ শোনা যায়নি। সে মনপ্রাণ দিয়েই পার্টিতে
কাজ করেছে। তবে ছাত্র সংগঠনের কাজের সাথে সার্বক্ষণিক পার্টি কাজের যে পার্থক্য, তা
সে জানতো এবং নতুন কর্মস্থলে ও পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে দৃঢ় মনোবল নিয়ে সংগ্রাম
করতো। এই সংগ্রামে সে নিশ্চয়ই জয়ী হয়েছে। অনেক বাধা ও ঝুঁকি সত্বেও সে পার্টির দায়িত্ব
থেকে সরে যায়নি। জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে সে পার্টি ও আন্দোলনকে রক্ষা করেছে।
ঘাতকরা মিটনের জীবন-বায়ু নিঃশেষ করে দিতে সক্ষম হয়েছে সত্য, কিন্তু তার মহান আদর্শ ও চেতনার প্রজ্জ্বলিত শিখা নিভিয়ে দিতে পারেনি। পৃথিবীতে কেউ চিরকাল বেঁচে থাকে না। কবির ভাষায় ”জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?”। ঘাতকদেরও একদিন মৃত্যু হবে। তারা যদি শত বছরও বেঁচে থাকে, মহাকালের বিচারে তা কিছুই নয়। কিন্তু মিটনের জীবন ও ঘাতকদের জীবন, মিটনের মৃত্যু ও ঘাতকদের মৃত্যুর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য অনন্তকাল থেকে যাবে। একজন নিঃস্বার্থ বিপ্লবী হিসেবে মিটন ইতিহাসে, গণমানুষের শ্রদ্ধার আসনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অন্যদিকে ইতিহাসে তার ঘাতকদের স্থান হবে নোংরা ভাগাড়ে। পুঁতিগন্ধময় দূষিত কলঙ্কের ক্ষত নিয়ে তাদেরকে চিরকাল নিন্দা ও ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকতে হবে। তারা কেন মিটন চাকমাকে খুন করেছে? - ইতিহাসের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নের তারা কী জবাব দেবে?
কিন্তু মিটন চাকমা মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে: ”আমি ব্যক্তি
স্বার্থ ত্যাগ করে অধিকারহারা জাতির মুক্তির জন্য লড়াই করেছি। আমি সুবিধাবাদী, আপোষকামী
ও পরাজয়বাদীদের দলে যাইনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি সুমহান আদর্শে অবিচল থেকেছি।”
তাই ইতিহাসের রায়ে মিটন চাকমা একজন আদর্শবাদী নিঃস্বার্থ বিপ্লবী বীর হিসেবে, অন্যদিকে
তার ঘাতকরা প্রতিক্রিয়াশীল খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
উদয়ের পথে শুন কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই।
নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।
বিপ্লবী মিটন চাকমার দান করা জীবনেরও কোন ক্ষয় হবে না। তার শেষ উক্তি ছিল:
“আমি আর বাঁচব না, তোমরা লড়াই চালিয়ে যাও।” তার মতো বীর শহীদের নির্দেশ শিরোধার্য
করে আজ শত শত বীর যোদ্ধা লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। মিটনদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে
না, বিজয় আমাদের অনিবার্য। (সমাপ্ত)
১৬ নভেম্বর ২০২৪
* লেখাটি ইউপিডিএফের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহিত।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।