উষাতন চাকমা
আগস্ট অভ্যুত্থানের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস লেখা হলে তাতে এই সত্যটি লিখতে হবে যে, এই অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ইউপিডিএফের নেতৃত্বে পাহাড়ি জনগণও অংশগ্রহণ করেছে। এটা ঠিক ইউপিডিএফ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ না করলেও ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হতো। সারা দেশের প্রেক্ষিতে বিচার করলে এক্ষেত্রে ইউপিডিএফ অতি ক্ষুদ্র শক্তি; অভ্যুত্থানের ফলাফলে তা কোন পার্থক্য সৃষ্টি করে না। কিন্তু এখানে আলোচনার বিষয়টি সেটা নয়। মুল কথা হলো, ইউপিডিএফের নেতৃত্বে পাহাড়ি জনগণও সারা দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথে সামিল হয়েছে। ইউপিডিএফের এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই হলো গুরুত্বপূর্ণ, যা অভ্যুত্থানে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে এবং অভ্যুত্থানকে পরিপূর্ণতা দানে সাহায্য করেছে। ঊনসত্তর ও নব্বই-এর অভ্যুত্থানের সাথে আগস্ট অভ্যুত্থানের মৌলিক পার্থক্যের এটি হলো একটি দিক।
ফ্যাসিস্ট হাসনা ও দোসর সন্তু লারমা। #সংগৃহিত ছবি |
আগস্ট অভ্যুত্থানে ইউপিডিএফের ঐতিহাসিক ভূমিকা খোদাই হলেও এর পরবর্তী ঘটনা ইতিহাসে কীভাবে লেখা হবে তা এখনও নির্দিষ্ট হয়ে যায়নি। যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে সেই বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান কোথায় হবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। কিছু প্রশ্ন তাই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমরা কি নতুন বাংলাদেশে “পুরাতন পার্বত্য চট্টগ্রাম” চাই? আমরা কি ফ্যাসিস্ট হাসিনার গড়া ও রেখে যাওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চাই? নতুন বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পার্বত্য চট্টগ্রাম কী মানানসই হবে?
ফ্যাসিজম হটানোর জন্য আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ হাজার হাজার ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছেন, অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেছেন, অঙ্গহানির শিকার হয়েছেন। হাসিনার ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পাহাড়ে ইউপিডিএফকেই সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। তার হিসাব দিতে গেলে লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো, পাহাড়ে ও সমতলে অসংখ্য মানুষের এই যে আত্মত্যাগ, তা কি কেবল দেশের একটি অংশকে ফ্যাসিজম মুক্ত করতে? হাসিনার ছত্রছায়ায় পাহাড়ে যে অবাধে ফ্যাসিজম চলেছে এবং এখনও চলছে তার কী হবে? আমাদের খুবই খারাপ লাগে যখন পাহাড়ে হাসিনার দোসররা বর্তমান সরকারের আমলেও আগের মতোই বহাল তবিয়তে রয়েছে এবং দোর্দণ্ড প্রতাপে ফ্যাসিজম কায়েম করে বেড়াচ্ছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে যারা মরণপণ লড়াই করেছে এবং এজন্য চরম নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তাদের ধরে ধরে খুন করে চলেছে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার নেতৃত্বদানকারী সরকারের কাছে আমাদের প্রশ্ন, ইউপিডিএফ অভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েও কেন তার সুফল আজ অন্যের ঘরে যাবে ও ইউপিডিএফ তার সুফল থেকে বঞ্চিত হবে? অভ্যুত্থানে অংশ না নিয়ে বরং অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সমর্থন দেয়ার পরও কেন ফ্যাসিস্ট সন্তু লারমার দল অভ্যুত্থানের সুফল ভোগ করবে? এ কেমন অবিচার?
ফ্যাসিস্ট সন্তু এমন কী জাদু জানেন, এমন কী তার সম্মোহনী শক্তি রয়েছে যে, গত ২৮ বছরে দেশের সব রঙের সরকার তার দলকে বিশেষ সুবিধা দিতে বাধ্য হয়েছে? যে সরকারগুলো তাকে সুবিধা দিয়েছে সেগুলো হলো: ১৯৯৬ – ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার, ২০০১ – ২০০৬ সালে বিএনপি সরকার, ২০০৭ - ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ২০০৯ – ৫ আগস্ট ২০২৪ আবার আওয়ামী লীগ সরকার এবং ৮ আগস্ট ২০২৪ থেকে চলমান অন্তর্বর্তী সরকার, যাকে অনেকে অভ্যুত্থান পরবর্তী বিপ্লবী সরকার বলতে পছন্দ করেন।
অথচ সন্তু লারমাকে ফ্যাসিস্ট বললেও কম
বলা হয়। তার একটি প্রিয় উক্তি হলো এক বনে দুই বাঘ থাকতে পারবে না, অর্থাৎ
পাহাড়ে সন্তু লারমার দল ছাড়া আর অন্য কোন দল এবং বিশেষত ইউপিডিএফ থাকতে পারবে
না। এজন্য তিনি তার দলীয় সম্মেলনে ইউপিডিএফ নির্মূলের কর্মসূচি গ্রহণ করেন এবং
২০০০ সালের ১৩ নভেম্বর যুগান্তর পত্রিকায় সাক্ষাতকার দিয়ে এই কর্মসূচি
বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন:
“ইউপিডিএফ সদস্যদের গলা টিপে হত্যা করতে হবে। যাতে কিছু না
করতে পারে। হাত ভেঙে দিতে হবে, যাতে লিখতে না পারে। ঠ্যাং ভেঙে দিতে হবে, যাতে
হাঁটতে না পারে। চোখ অন্ধ করে দিতে হবে, যাতে দেখতে না পারে। যারা চুক্তির পক্ষে
জনগণের অধিকারের পক্ষে তারাই এ কাজ করবে।”
সন্তু লারমার মতো জঘন্য ফ্যাসিস্ট, যে পাহাড়ে ভিন্ন মতের দল ও সংগঠনকে নির্মূল করতে ২৮ বছর ধরে শত শত মানুষ খুন করেছে, তার শক্তির জোর কোথায়? তিনি তো নিজের বলে আঞ্চলিক পরিষদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হননি। এক কলমের আঁচড়ে তার গদি চলে যেতে পারে। সরকারের এবং বিশেষত ফ্যাসিস্ট হাসিনার সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া পাহাড়ে হত্যার রাজনীতি চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে কখনই সম্ভব ছিল না। নতুন সরকারের আমলেও তার দল আগের মতো ফ্যাসিজম চর্চা করবে ও খুন করে বেড়াবে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। তাকে সেটা করতে দেয়ার অর্থ হলো মুগ্ধ, আবু সাঈদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করা। সমতল ফ্যাসিজম মুক্ত হবে, অথচ পাহাড় ফ্যাসিজম কবলিত থাকবে, তা হতে পারে না। আবু সাঈদরা নিশ্চয়ই এজন্য জীবন উৎসর্গ করেননি।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির সাথে এক
সাক্ষাতকারে সন্তু লারমা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তার নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র গ্রুপ
রয়েছে, যাদেরকে প্রতিপক্ষ দলের সদস্যদের নির্মূলের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত বিশাল নিরাপত্তা বাহিনী তার সশস্ত্র দলের সদস্যদের
হামলা থেকে ইউপিডিএফসহ সাধারণ লোকজনকে রক্ষা করতে পারছে না বা রক্ষা করছে না। ফলে
স্বাভাবিকভাবে পাহাড়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ ও জটিল আকার ধারণ করেছে।
গত ৭ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার অবশেষে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করেছে। আমাদের প্রশ্ন, হাসিনার সহযোগি ও সুবিধাভোগী চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের বাদ দিয়ে তিন জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করা হলে, কেন আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠন করা হবে না? যে আঞ্চলিক পরিষদের জেএসএস নেতারা শেষ দিন পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে গেছেন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিরোধীতা করেছিলেন। এই বৈষম্য ও দ্বিচারিতা কেন? আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠন না করার পেছনের যুক্তি যদি হয় পার্বত্য চুক্তি, তাহলে সেই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হোক। কিন্তু আমরা তো জানি, চুক্তিতে কোথাও লেখা নেই যে, সন্তু লারমাদেরকে আজীবন পরিষদের গদিতে রাখতে হবে। দেশের সমতল অংশের মানুষ ফ্যাসিস্টমুক্ত হবে, আর পাহাড়ের অংশ হাসিনার সহযোগি ও সুবিধাভোগি সন্তু লারমার ফ্যাসিস্ট শাসনে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকবে তা হতে পারে না। সেটা ৫ আগস্ট অভ্যুত্থান চেতনার বিরোধী।
শেখ হাসিনার পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত নীতি ছিল আগাগোড়া ফ্যাসিস্ট ও হিংসাত্মক। তিনি চেয়েছিলেন পাহাড়ি দিয়ে পাহাড়িদের ধ্বংস করা। এ জন্য তিনি কেবল সন্তু লারমাকে দিয়ে খুন সন্ত্রাস করেননি, তিনি ইউপিডিএফের গণতান্ত্রিক আন্দোলন নস্যাত করার জন্য ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গঠন করে দিয়েছিলেন। এভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি ও অরাজকতার রাজত্ব কায়েম করেন এবং নিরীহ মানুষের রক্তে পাহাড় রঞ্জিত করেন। দুঃখজনক হলো ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে তার সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীগুলো এখনও ক্রিয়াশীল রয়েছে। সর্বশেষ গত ৩০ অক্টোবর পানছড়িতে ঠ্যাঙাড়েরা তিন ইউপিডিএফ সদস্যকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। তার কিছু দিন আগে ১১ অক্টোবর তারা পানছড়িতে সংঘাত বিরোধী রোড মার্চ বানচালের জন্য সন্তু লারমার জেএসএস দলের সাথে মিলে সশস্ত্রভাবে কাজ করেছে। এটা স্পষ্ট হাসিনার পতনের পরও তার প্রতি সহানুভূতিশীল কিছু সেনা কর্মকর্তা অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ঠ্যাঙাড়ে ও সন্তু লারমাকে দিয়ে পাহাড় অশান্ত করতে চাইছে। এই অবস্থায় সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে এবং ঠ্যাঙাড়ে ও সন্তু লারমাকে দিয়ে পাহাড় অশান্ত করার ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দিতে হবে।
এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তিনটি
পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে: এক, ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগি ও সুবিধাভোগি সন্তু লারমা ও
তার দলের সদস্যদের বাদ দিয়ে আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠন করতে হবে। দুই, ঠ্যাঙাড়ে
বাহিনী ভেঙে দিতে হবে ও খুনী ঠ্যাঙাড়েদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। তিন,
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রতি সহানুভূতিশীল সেনা কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবেই কেবল আগস্ট অভ্যুত্থানের চেতনায় পাহাড় ও
সমতলে ফ্যাসিস্টমুক্ত প্রকৃত গণতান্ত্রিক
শাসন কায়েম করা সম্ভব হতে পারে। (সমাপ্ত)
* লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহিত।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।