এম. চাকমা
(১)
যে চুক্তি ২৭ বছরে বাস্তবায়ন হয় না, সেই চুক্তির কি আদৌ কোন ভবিষ্যত থাকতে পারে? যারা এক সময় চুক্তি নিয়ে মাতামাতি করেছিল, তারাও আজ সুর পাল্টিয়ে ফেলেছে, বা পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তির অসারতা প্রথম যারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল, তারা হলো তিন ভূবনের তিন বাসিন্দা: ইউপিডিএফ, বর্তমানে পরিনির্বাণ প্রাপ্ত শ্রদ্ধেয় বনভান্তে ও এক ঝাঁক কবুতর।
ইউপিডিএফের বর্তমান নেতৃবৃন্দ ১৯৯৭ সালে শান্তি আলোচনার শেষ দিকে টের পান কিছু একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। পরে চুক্তির ধারা ব্যাখ্যা করে তারা দেখিয়ে দেন যে, চুক্তিতে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে, যা পরে অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়।
পূজনীয় বনভান্তে চুক্তিকে “খালি বিস্কুটের প্যাকেটের“ সাথে তুলনা করেছিলেন ও “মৃত্যুর চুক্তি” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তার মতে সন্তু লারমা চুক্তি করে শেখ হাসিনার কাছে ঠকেছেন।
শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন সন্তু লারমা ও আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭। ছবি: সংগৃহিত |
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তিতে যে শান্তি আসবে না এ সত্য সেদিন আরও যারা
বুঝতে পেরেছিল, তারা হলো এক ঝাঁক শান্তির পায়রা। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি
স্টেডিয়ামে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (বর্তমানে ক্ষমতাচ্যুত) শেখ হাসিনা সন্তু লারমাকে
নিয়ে কবুতর উড়িয়ে শান্তিবাহিনীর অস্ত্র সমর্পন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছিলেন। কিন্তু আশ্বর্যজনক
হলো, একটি কবুতরও উড়ে যায়নি। কবুতরগুলো অনুষ্ঠান মঞ্চের আশেপাশে ঘরে ফিরে থেকে গিয়েছিল।
যেন সেদিন তারাও শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমার দুরভিসন্ধি ও অসৎ উদ্দেশ্যের কথা বুঝতে
পেরেছিল।
(২)
আসলে চুক্তি স্বাক্ষরের পর গত ২৭ বছরে সন্তু বাবুদেরকে আঞ্চলিক পরিষদের গদিতে বসানো ছাড়া চুক্তির কোন ধারা সরকার বাস্তবায়ন করেনি। অন্যদিকে জেএসএসও চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চুক্তির বার্ষিকীতে কান্নাকাটি ছাড়া কোন আন্দোলন করেনি। গদি পেয়েই তারা সন্তুষ্ট, যদিও সন্তু লারমার ভাষায়, একজন পুলিশ কনস্টেবলের যে ক্ষমতা আছে, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের সেই পরিমাণ ক্ষমতাও নেই। অথচ তারপরও ঠুটো জগন্নাথ হয়ে তারা ২৭ বছর পার করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, গদি রক্ষার জন্য তারা সব সময় মরিয়া এবং এর জন্য শাসকগোষ্ঠীর যে কোন ফরমাশ খাটতেও তারা প্রস্তুত; এমনকি তা জাতীয় স্বার্থের জন্য চরম অনিষ্টকর হলেও। সেনা শাসকগোষ্ঠীর দাসের মতো ব্যবহৃত হয় বলেই জেএসএস নেতারা গত ২৭ বছরে দেশের সব ধরনের সরকারের আনুকূল্য লাভ করেছে। আর এর বিনিময়ে তাদেরকে জুম্ম জাতীয় স্বার্থের বিরেুদ্ধে কাজ করতে হয়েছে ও হচ্ছে এবং ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত জিইয়ে রাখতে হয়েছে ও হচ্ছে।
জেএসএসের শীর্ষ নেতাটি এক সময় কথায় কথায় চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য রক্ত দেয়ার শপথ নিতেন, সশস্ত্র সংগ্রামে ফিরে যাওয়ার হুমকি দিতেন। ইউপিডিএফ প্রথম থেকেই চুক্তির দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরে তার সমালোচনা করলেও, চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে জেএসএসকে সমর্থন দেয়ার অঙ্গীকার করে। কিন্তু জেএসএস নেতারা তারপরও আন্দোলনের দিকে পা বাড়ায়নি। বরং তারা উল্টো ইউপিডিএফকে নির্মূলের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। কিন্তু জেএসএসের এই কর্মসূচি ও কৌশল সঙ্গত কারণে জনগণের কাছে সমর্থন লাভ করেনি। জেএসএসের এই ইউপিডিএফ নির্মূলের বর্বর কর্মসূচির কারণে আজ পর্যন্ত পাহাড়ে শত শত মূল্যবান জীবন অকালে ঝরে গেছে, এমনকি জেএসএসও দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও সন্তু বাবু “এক বনে দুই বাঘ না থাকার” তত্ত্ব বাস্তবায়নের ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ইউপিডিএফ সদস্যদের “গলা টিপে হত্যা করে, হাত পা ভেঙে দিয়ে”।
(৩)
কিন্তু সন্তু বাবুরা জনগণের সামনে স্পষ্ট করে বলেন না ইউপিডিএফের কী অপরাধ। ইউপিডিএফ কি জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কাজ করছে? এর উত্তর হবে একটি বিরাট “না”। কারণ প্রকৃতপক্ষে একমাত্র ইউপিডিএফই নিরলসভাবে সকল প্রকার ঝুঁকি নিয়ে জনগণের অধিকার ও কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তাহলে কি চুক্তির সমালোচনা করাই ইউপিডিএফের অপরাধ? সন্তু বাবুরা হয়তো সেটাই মনে করতে পারেন, কারণ তারা ইউপিডিএফ নামটি উচ্চারণের আগে সব সময় “চুক্তি বিরোধী” বিশেষণ জুড়ে দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা জানি, চুক্তির সমালোচনা করা, অর্থাৎ মত প্রকাশের অধিকার বাংলাদেশের অন্য সকল নাগরিকের মতো ইউপিডিএফেরও রয়েছে। এই অধিকার প্রয়োগ করার কারণে জেএসএস কিংবা অন্য পক্ষের অধিকার নেই তাদের নির্মূল করার। তাছাড়া চুক্তির সমালোচনা কেবল ইউপিডিএফ করে না, আরও অনেক দল, সংগঠন ও ব্যক্তিও করে থাকে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউপিডিএফ যৌক্তিক কারণে চুক্তির সমালোচনা করলেও, চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় সরকার ও জেএসএসকে সহযোগিতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছে। এরপর তো তাদের ওপর হামলা অন্ততঃ জেএসএসের দিক থেকে বন্ধ হওয়া উচিত ছিল।
করা শেখ হাসিনার হাতে নিজের অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন সন্তু লারমা, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮, খাগড়াছড়ি স্টেডিয়াম। সংগৃহিত ছবি |
জেএসএসের একটি সাংগঠনিক নীতি হলো আন্দোলনে সক্রিয়কে অধিকতর সক্রিয় করা, নিষ্ক্রিয়কে সক্রিয় করা এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের নিরপেক্ষ করার চেষ্টা করা। কিন্তু তাদের এই নীতি ইউপিডিএফের বেলায় প্রযোজ্য হচ্ছে কই? জেএসএস তো যারা সক্রিয় হতে চায়, তাদের আন্দোলনে সহযোগিতা দিতে চায়, তাদেরকে কেবল দূরে সরিয়ে দিচ্ছে তাই নয়, তারা তাদের সম্ভাব্য মিত্রদেরকেই ধ্বংস করছে। এভাবে জনগণের কোন আন্দোলন কি জয়যুক্ত হতে পারে?
আমার মতে ইউপিডিএফ কেন চুক্তির দুর্বলতা সবার সামনে তুলে ধরেছে সেটাই জেএসএস নেতারা মেনে নিতে পারেননি। জেএসএসের ভুলের সমালোচনা করা বা সত্যকে তুলে ধরাই যেন ইউপিডিএফ নেতাদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেএসএসের এই অবস্থা আমাদেরকে সেই গল্পটির কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে ন্যাংটো রাজার চাতুকাররা তার কাছে সত্য বলার সাহস করেনি, একজন সত্যবাদী বালকই রাজার গায়ে কাপড় নেই বলে চিৎকার করেছিল এবং এজন্য তাকে রাজার রোষানলে পড়তে হয়েছিল।
চুক্তির দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করা ছিল পার্টি হিসেবে ইউপিডিএফ নেতাদের একটি বড় জাতীয় দায়িত্ব। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে সময় তাদের এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেটা না করলে তারা জাতি ও জনগণের কাছে চিরকাল অপরাধী হয়ে থাকতেন। চুক্তির সমালোচনা করে নতুন পার্টি ইউপিডিএফ গঠিত হয়েছে বলেই গত ২৭ বছরে ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে সংগ্রামসহ জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনকে জিইয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।
(৪)
৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন” নামে একটি প্লাটফরমে সংগঠিত হয়। তারা ইউপিডিএফ ও জেএসএসের উভয় গ্রুপের মধ্যে ঐক্যের চেষ্টা চালায় এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নসহ জনগণের বিভিন্ন ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু ঐক্য ও আন্দোলন বিষয়ে সংঘাত বিরোধী ছাত্র নেতারা জেএসএস সন্তু গ্রুপের কাছ থেকে কোন ইতিবাচক সাড়া পেতে ব্যর্থ হন। এমনকি চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করতে চাইলেও জেএসএস সন্তু গ্রুপ তাতে বাধা দেয়। তারা সাফ জানিয়ে দেয় যে, এই দাবিতেও তারা কোন আন্দোলন করতে পারবে না।
এসব ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, জেএসএস এখন শতভাগ প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এর চাইতে বাস্তব সত্য আর নেই। তাদের কাজের মাধ্যমেই প্রতিদিন তা প্রমাণিত হচ্ছে। তারা এখন নিজেরাও আন্দোলন করে না, অন্যকেও আন্দোলন করতে দেয় না – এমনকি সেটা যদি চুক্তি বাস্তবায়ন অথবা তাদের দলের কর্মসূচি ও দাবি বাস্তবায়নের জন্য হলেও। জেএসএসের ভাবখানা যেন এমন: আমরা যেহেতু আন্দোলন করবো না, অন্যরাও আন্দোলন করতে পারবে না। যদি কেউ ফ্যাসিজম কাকে বলে জানতে চায়, তাহলে জেএসএসের এই মনোভাব ও আচরণই হলো নির্ভেজাল ফ্যাসিবাদ। পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে এই যদি হয় জেএসএসের অবস্থান, তাহলে কীভাবে তারা চুক্তি বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করতে পারে? অথচ তারা ২ ডিসেম্বর প্রতি বছরের মতো এবারও হয়তো চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য অরণ্যে রোদন করবে। ইহুদিদের জেরুজালেমে wailing wall-এ কান্নাকাটি করার মতো। আসলে চুক্তি বাস্তবায়ন তাদের মূল লক্ষ্য নয়, তাদের আসল নজর হলো আঞ্চলিক পরিষদের গদি।
(৫)
অনেকের হয়তো হবুচন্দ্র রাজা, গবুচন্দ্র মন্ত্রীর কথা মনে আছে। গবুচন্দ্র তার মন্ত্রীকে রাজ্যে এই মর্মে নির্দেশ জারী করতে বলে যে, যতই শোকে কাতর হোক, রাজ্যে আজ থেকে কোন প্রজা আর কাঁদতে পারবে না, কাঁদলে তাকে শূলে চড়ানো হবে। রাজার এই নির্দেশ জারীর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল প্রতিদিন কাউকে না কাউকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে আনন্দ লাভ করা। কিন্তু তার এই আদেশ জারীর পর ছেলে-বুড়ো সবাই কান্না ভুলে যায়, সবাই হাঁসতে থাকে। শেষে আদেশ অমান্যকারী কাউকে না পেয়ে গবুমন্ত্রী নিজেই কেঁদে শূলে চড়ার প্রতিশ্রুতি দেয় রাজাকে। কিন্তু দেখা গেল এতদিনে গবুমন্ত্রীও কীভাবে কাঁদতে হয় তা ভুলে গেছে। তখন হবুরাজা তার মন্ত্রীকে কীভাবে কাঁদতে হয় তা দেখিয়ে দেয় এবং ফেঁসে যায়। শেষ পর্যন্ত তাকেই শূলে চড়তে হয়।
সন্তু বাবুদেরকেও একদিন হবুরাজার মতো নিজের ফাঁদে নিজেদেরকেই পড়তে হবে।
ঘটনা সেদিকেই দ্রুতগতিতে ধাবিত হচ্ছে। ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার ও আন্দোলন না করার শাস্তি
তাদেরকে পেতেই হবে। যে শাস্তি তারা ইউপিডিএফ ও জনগণকে দিতে চাইছে, সেই শাস্তি তাদেরকেই
ভোগ করতে হবে। এর কোন অন্যথা হবে না। (সমাপ্ত, ১ ডিসেম্বর ২০২৪)
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।