""

মিঠুন চাকমা হত্যার ৭ বছর : এখনো অধরা খুনিরা!

শহীদ মিঠুন চাকমা। ফাইল ছবি


খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি ২০২৫

 আজ ৩ জানুয়ারি ২০২৫ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর অন্যতম সংগঠক, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি মিঠুন চাকমাকে হত্যার ৭ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৮ সালের আজকের এই দিনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে নব্যমুখোশ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য দিবালোকে মিঠুন চাকমাকে বাড়ির সামনে থেকে অস্ত্র ঠেকিয়ে তুলে নিয়ে গুলি করে খুন করে। কিন্তু সাত বছরেও খুনিরা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। উপরন্তু সন্ত্রাসীরা সেনা-প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে প্রতিনিয়ত খুন-খারাবি চালিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশের প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা!

জানা যায়, ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে খাগড়াছড়ি জেলা আদালত থেকে একটি মামলায় হাজিরা দেয়ার পর শহরের অপর্ণা চৌধুরী পাড়ার নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন মিঠুন চাকমা। বাড়িতে পৌঁছার আগে বাড়ির প্রবেশের মূল গেটের এলাকা থেকে একদল সন্ত্রাসী তাকে অস্ত্রের মুখে মোটর সাইকেলে তুলে নিয়ে যায়। এরপর দক্ষিণ পানখাইয়া পাড়া এলাকায় নিয়ে গিয়ে রাস্তার মাঝে সন্ত্রাসীরা তাকে মাথায় ও বুকে গুলি করে ফেলে রেখে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিভে যায় একটি উজ্জ্বল প্রদীপ।

মিঠুন চাকমা খুনের সাথে সেনা-প্রশাসনের যে যোগসাজশ ছিলে সেটা তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বাধাদানের মাধ্যমেই অনেকটা স্পষ্ট হয়েছিল। মিঠুনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের দিন সকাল থেকেই সেনাবাহিনী ও পুলিশ যেভাবে খাগড়াছড়ি প্রবেশ পথসহ বিভিন্ন জায়গায় চেকপোষ্ট বসিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা লোকজনকে বাধা প্রদান করে তাতে খুনের ঘটনায় আসল মদদদাতাদের চেহারা ভেসে উঠে। যার কারণে এ হতাকাণ্ডের সাত বছরেও পুলিশ মিঠুন চাকমার খুনিদের গ্রেফতারে কোন উদ্যোগ নেয়নি। ফলে খুনিরা রয়েছে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা সেনা-প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে প্রতিনিয়ত খুন, গুম, অপহরণসহ নানা অপরাধকর্ম সংঘটিত করে যাচ্ছে।

হত্যাকাণ্ডের আগেও শাসকগোষ্ঠি কর্তৃক মিঠুনকে থামানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ১২ জুলাই রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে তার নামে মিথ্যাভাবে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দিয়ে কারাগারে বন্দি করা হয়েছিল। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে এই কালো আইনের ধারাটি প্রথম প্রয়োগ করা হয়েছিল মিঠুন চাকমার ওপর। এ মামলা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছিল আরো ডজনের অধিক মিথ্যা মামলা। পরে তিনি আদালত থেকে জামিনে মুক্তিলাভ করেছিলেন।

মিঠুন চাকমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সুযোগ স্বেচ্ছায় প্রত্যাখ্যান করে জুম্ম জনগণের মুক্তির লড়াইয়ে প্রত্যক্ষভাবে সামিল হতে ইউপিডিএফে যোগ দিয়েছিলেন। এর আগে তিনি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একই সাথে তিনি দেশের প্রগতিশীল সংগঠন ও আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন।

মিঠুন চাকমা ছিলেন ইউপিডিএফ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ও দেশের নিপীড়িত মানুষের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। তার মধ্যে ছিল সমাজ পরিবর্তনের বিশাল তাড়না। তিনি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের শোষিত-নিপীড়িত মানুষের কথা ভাবতেন না, ভাবতেন বিশ্বের সকল নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের কথাও। মৃত্যুর বছরখানিক আগে তিনি ফিলিস্তিনের জনগণের সংগ্রামের উপর একটি লেখাও লিখেছিলেন। যেটি তিনি পুস্তিকা আকারেও বিলি করেছিলেন।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন ব্লগেও সমান সক্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ব্লগে নিয়মিত লিখতেন। তার বেশ কিছু লেখা mithunchakma.blogspot.com এই ব্লগসাইটটিতে রয়েছে (যারা তাঁর লেখা পড়তে আগ্রহী তারা ব্লগটি দেখতে পারেন)। এছাড়া তিনি বিডি নিউজ ব্লগ, সামহোয়ারইন ব্লগসহ বিভিন্ন ব্লগে সক্রিয় থেকে নানা বিষয়ে লেখালেখির কাজে যুক্ত ছিলেন।

মিঠুন চাকমা তার সৃষ্টিশীল কর্মের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের মুক্তিকামী মানুষের কাছে অমর হয়ে থাকবেন। ঘাতকরা তাকে মেরে ফেলতে পারলেও তার চিন্তা-চেতনা, তার সৃষ্টিকে মেরে ফেলতে পারেনি। তার সৃষ্টি ও চিন্তা-চেতনা থেকে নতুন প্রজন্ম যদি কিছুটা হলেও ধারণ করতে পারে তাহলেই তার মৃত্যু সার্থক হবে।

এখানে আরও যে কথাটি বলা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে- মিঠুন চাকমার খুনি-সন্ত্রাসীদের উপদ্রব এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেনা-প্রশাসনের আদর-যত্নে এই সন্ত্রাসীরা অবাধে খুন, গুম, অপহরণ, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়সহ জনগণের উপর নানা উপদ্রব চালিয়ে যাচ্ছে। এই খুনিরাই এখন জননিরাপত্তার চরম হুমকি। আর খুনিদের মদদ, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে সেনা-প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে অরাজকতা জিইয়ে রাখতে চায়।

এই খুনি-সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজারে প্রকাশ্যে পুলিশের সামনে পিসিপি নেতা তপন-এল্টন, যুব নেতা পলাশ চাকমাসহ ৬ জনকে এবং পেরাছড়ায় বিক্ষোভরত জনতার মিছিলে হামলা চালিয়ে ১ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাঙ ইউনিয়নের পুজগাঙের অনিল পাড়ায় পিসিপির সাবেক সভাপতি বিপুল চাকমা, পিসিপি’র বর্তমান সহসভাপতি সুনীল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা সহসভাপতি লিটন চাকমা ও ইউপিডিএফ সংগঠক রুহিন বিকাশ ত্রিপুরাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ গত ৩০ অক্টোবর ২০২৪ পানছড়ির লতিবান শান্তি রঞ্জন পাড়ায় সিজন, শাসন ও জয়েন নামে তিন ইউপিডিএফ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এ নিয়ে এই খুনি-সন্ত্রাসীদের দিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ৬৩ জন ইউপিডিএফের নেতা-কর্মী, সমর্থককে হত্যা করা হয়েছে বলে ইউপিডিএফ সূত্রে জানা গেছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিলেও হাসিনার আমলে সৃষ্ট এই খুনি ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উপরন্তু তাদেরকে আগের মতোই হাসিনার আমলে নিয়োজিত সেনা কর্মকর্তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রেখে ইউপিডিএফের নেতা-কর্মী হত্যায় লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।   

কাজেই, সরকার যেহেতু মিঠুন চাকমার খুনি ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না, সেহেতু এই খুনি চক্রটির বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনগণ ও তরুণ প্রজন্মকে রুখে দাঁড়াতে হবে। মিঠুন চাকমাকে হত্যার সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে সোচ্চার হতে হবে।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments