""

পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তে রঞ্জিত আরও একটি দিন ২২ এপ্রিল: প্রতুল-সুরমণি’র শহীদ দিবস

পুলিশের গুলিতে নিহত প্রতুল চাকমার মরদেহ। ফাইল ছবি


বিশেষ প্রতিবেদন, সিএইচটি নিউজ
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বজনহারা, শোকাবহ, হৃদয় মুষড়ানো অশ্রভেজা অসংখ্য দিনের মতো রক্তে রঞ্জিত আরও একটি দিন ২২ এপ্রিল। প্রতুল-সুর মণি চাকমা’র শহীদ দিবস। ১৯৯৯ সালের এই দিনে খাগড়াছড়িতে জেএসএসের ষড়যন্ত্রে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন প্রতুল ও সুরমণি চাকমা। রক্তাক্ত হয় খাগড়াছড়ির রাজপথ। পুলিশের বর্বরোচিত হামলায় আহত হন আরও অর্ধশতাধিক লোক।

সেদিন (২২ এপ্রিল ‘৯৯) ছিল পাহাড়ি গণ পরিষদ (পিজিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ)-এর পূর্ব নির্ধারিত যৌথ কেন্দ্রীয় সম্মেলন। খাগড়াছড়ি সদরের খেজুর বাগান মাঠে (উপজেলা মাঠে) এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ নেতৃবৃন্দ অনেক আগে থেকেই সম্মেলনের জন্য প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করে। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি যথারীতি প্রশাসনকে লিখিতভাবে অবহিত করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে পোস্টারিং করা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা সম্মেলনে যোগদানের জন্য খাগড়াছড়িতে এসে পৌঁছেন।

সম্মেলনে যোগদানের জন্য সেদিন সকাল থেকে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে গাড়িযোগে ও পায়ে হেঁটে হাজার হাজার জনতা জেলা শহরের দিকে আসতে থাকে। কিন্তু পুলিশ তাদেরকে সম্মেলন স্থলে যেতে বাধা দেয়।

খাগড়াছড়ি শহরের প্রবেশ মুখে তিনটি পয়েন্টে (স্টেডিয়াম এলাকা, খাগড়াপুর ও জিরো মাইল) ব্যারিকেড সৃষ্টি করে সম্মেলনে আসা জনতাকে আটকানো হয়। তাছাড়া পানছড়ি, মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি ও দীঘিনালাসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদেরকে পুলিশ আটকায়।

সকাল ১০টার দিকে পানছড়ি থেকে ২৫টি গাড়িতে করে সমাবেশে যোগ দিতে আসা ছাত্র জনতাকে পুলিশ খাগড়াছড়ি স্টেডিয়াম এলাকায় আটকায়। সমবেত জনতা তাদেরকে সম্মেলন স্থালে যেতে বাধাদানের প্রতিবাদ জানাতে গেলে পুলিশের সাথে তাদের বাগবিতণ্ডা হয়। এ সময় জনতা মুর্হুমুর্হু শ্লোগান দিয়ে তার তীব্র প্রতিবাদ জানালে এক পর্যায়ে পুলিশ বিনা উস্কানিতে জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। এতে ঘটনাস্থলেই প্রতুল চাকমা (১৯) শহীদ হন। তিনি পানছড়ি থেকে এসেছিলেন। অন্যদিকে জিরোমাইলেও একই কায়দায় পুলিশ জনতার উপর গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে সুরমণি চাকমা শহীদ হন। সুরমণি চাকমা এসেছিলেন রাঙামাটির কুদুকছড়ি থেকে। এছাড়া পুলিশের এই বর্বরোচিত হামলায় সেদিন আরো শতাধিক লোক আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর আহত হয় ২৪ জন। খাগড়াছড়ি, লক্ষ্মীছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে আটক করা হয় ২৫ জনকে।

পুলিশের এই বর্বর হামলা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। পাহাড়ি গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের এই সম্মেলন ভণ্ডুল করে দেয়ার জন্য সরকার, প্রশাসন ও জেএসএস নানা ষড়যন্ত্র চালায়। সম্মেলনের একদিন আগে জেএসএস মদদপুষ্ট দুই নাম্বারীরা একই সময় ও একই স্থানে তাাদের সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। ঐদিন প্রশাসনের মদদে ৫০/৬০ জনের জেএসএসের ভাড়াটিয়া একদল সন্ত্রাসী এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে। তারা স্বনির্ভর বাজারে জোরপূর্বক দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্য করে। এর আগে (২০ এপ্রিল‘৯৯) তারা খাগড়াছড়ি জীপ মালিক সমিতিকে সম্মেলনের জন্য গাড়ি ভাড়া না দিতে চিঠি দেয়।

অন্যদিকে প্রশাসন সম্পূর্ণ অযৌক্তিভাবে সম্মেলন স্থলে ’জেএসএস’রও সমাবেশ রয়েছে’--এমন অজুহাতে ১৪৪ ধারা জারি করে। যদিও জেএসএস বা তার মদদপুষ্ট দুই নাম্বারীরা সেদিন কোন কর্মসূচি পালন করেনি। মূলত পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ’র সম্মেলন বানচাল করে দিতেই তারা এ ষড়যন্ত্র করেছিল।

প্রশাসনের এহেন ষড়যন্ত্র ও অসহযোগিতার কারণে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি সম্মেলনের স্থান পরিবর্তন করে স্বনির্ভর মাঠে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও প্রশাসন বাধা দেয়।

পুলিশের এই বর্বর হামলার প্রতিবাদে সেদিন (২২ এপ্রিল’৯৯) বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে স্বনির্ভর এর কাছাকাছি শহীদ অমর বিকাশ সড়কে হাজারো জনতার অংশগ্রহণে এক প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। এতে ইউপিডিএফ নেতৃবৃন্দসহ ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আসা জাতীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। সমাবেশ থেকে পুলিশী বর্বরতার নিন্দা এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়।

অন্য অনেক শোকাবহ দিনের মতো ২২ এপ্রিল দিনটিও পার্বত্য চট্টগ্রামের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। চির ভাস্বর হয়ে থাকবে শহীদ প্রতুল ও সুরমণি চাকমার নাম।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।








Post a Comment