পুলিশের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন তিনি
ডেস্ক রিপোর্ট, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫
রাঙামাটির কাউখালিতে গতকাল (১২ জুন) তিন অধিকারকর্মী ও অ্যাক্টিস্টের ওপর হামলাকারীরা কাউখালী সরকারি ডিগ্রী কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মো. নাইম হোসেন হিমেল বলে চিহ্নিত করেছেন অধিকারকর্মী ও অ্যাক্টিভিস্ট মারজিয়া প্রভা।
গতকাল রাতে তাঁর ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে তিনি এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এতে তিনি বলেন “আজ আমাদের তিনজনের উপর রাঙামাটি কাউখালিতে সন্ত্রাসী হামলা
করেছে কাউখালি সরকারি ডিগ্রী কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক
মো. নাইম হোসেন হিমেল।”
তিনি এ দু’জনের ফেসবুক আইডির লিঙ্কও যুক্ত করেছেন। লিঙ্কগুলো হলো:
মো: নাইম হোসেন হিমেল
https://www.facebook.com/share/1AX6FLUfgE/?mibextid=qi2Omg
ইমরান হোসেন
https://www.facebook.com/share/16VsEdEYk1/?mibextid=qi2Omg
আরেকটি পোস্টে তিনি হামলাকারীদের ছবি যুক্ত করেন। এতে তিনি লেখেন “এরাই আজকের চিহ্নিত সন্ত্রাসী, আমাদের উপর আক্রমণকারী রাঙামাটির কাউখালিতে। আর্মি ডিজিএফআইয়ের পোষা সেটেলার।” নীচে তাঁর যুক্ত করা ছবিটি দেওয়া হলো।
এর আগে গতকাল (১২ জুন) বিকালে কাউখালীতে কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৯তম বার্ষিকীতে
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের আয়োজিত নারী সমাবেশে অংশগ্রহণ শেষে ঢাকার উদ্দেশ্যে ফেরার পথে কাউখালীর বেতছড়ি
নামক স্থানে তাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
মারজিয়া প্রভা ছাড়াও হামলার শিকার অন্য দু’জন হলেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট অলিউর সান এবং বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নূজিয়া হাসিন রাশা। তারা তিনজনই কাউখালীতে নারী সমাবেশে অতিথি বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
হামলার বিষয়েও মারজিয়া প্রভা ফেসবুকে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তাঁর সেই পোস্টটি
হুবহু নীচে দেওয়া হলো:
#কাউখালী আর্মি ডিজিএফআইয়ের সেটলার কর্তৃক সন্ত্রসী হামলা ও
পরবর্তীতে কি হলো তার বিস্তারিত
প্রথম পোস্টটা যখন দিয়েছিলাম তখন জাস্ট সন্ত্রাসী হামলার পর
মূহুর্তে সিএনজি ছেড়েছে। আমি, রাশা ও সান ভাই প্রবল বিধ্বস্ত, কাঁপছি অন্যায় অপমানে।
একে একে ফোন করে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী প্রেসিডেন্ট দিলীপ, পিসিপির এক্স প্রেসিডেন্ট
অংকন চাকমাকে হামলার ঘটনা জানাই। কি হয়েছিলো বিস্তারিত তা বলার দরকার আছে মনে করি।
পাহাড়ে স্টেট কিভাবে আতংক ছড়ায়, তার মেকানিজমকে কিভাবে কাজ করায় তার অতি চাক্ষুস কিছু
মুহুর্তের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই!
প্রথমত বলতে চাই, কাউখালী তে ২০০৭ সালের পর এইবারই হিল উইমেনস্
ফেডারেশন কর্মসূচি নিয়েছে। স্বভাবত তারা যে স্থানগুলোতে তাদের কর্মসূচি নিয়ে থাকে,
তার চাইতে অন্যত্র স্থানে এই প্রোগ্রাম নিয়েছে। এবং প্রথম থেকেই এই প্রোগ্রামের স্থান
সেই অর্থে জনসম্মুখে বলা হয়নি নিরাপত্তার খাতিরে। কারণ কল্পনা চাকমার ২৯ বছর অপহরণের
বিচার না পাওয়া এবং লেফট্যানান্ট ফেরদৌসের বিচারের দাবিতে এই কর্মসূচিটি অত্যন্ত সংবেদনশীল
ছিলো। পাহাড়ে সেনাবাহিনীর তা ভালো লাগার কথা না।
সমাবেশের শুরুর দিকেই বিভিন্ন স্থানে নারীদের সমাগম বন্ধ করার পাঁয়তারা শুরু করেছিলো সেনাবাহিনী। তাদের আসতে দিতে চাচ্ছিলোনা। তাই সময়ের চাইতে এক ঘন্টা পর অতি রোদের মধ্যে প্রোগ্রাম শুরু করি আমরা। প্রোগ্রামে বক্তব্য কর্মসূচির শেষে সাংস্কৃতিক কর্মসূচির সময়ে আমি আর রাশা পেছনে দাঁড়িয়ে সোহেল চাকমার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন দুইজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি আমাদেরকে মার্ক করছিলো। গোলাপী টিশার্ট এবং আর্মি কাট চুলের।
আমরা অন্য পাহাড়ি বন্ধুদের কাছে অবহিত হলাম তারা ডিজিএফআইয়ের
ব্যক্তিবর্গ। এবং এও জানলাম সমাবেশ শেষে আমাদের বিক্ষোভ মিছিল হবার কথা তা হচ্ছেনা।
সেনাবাহিনী বাজার পর্যন্ত মিছিল নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলো, আমরা সেইটা মানা স্বত্তেও
বিক্ষোভ মিছিল করতে পারলাম না। এবং তখুনি আমরা জানতে পারি, যে বাসগুলো আমাদের সমাবেশে
নারীদের এনেছে, সে বাসগুলোর থেকে আটটি বাসের ড্রাইভারকে সেনাক্যাম্পে ধরে নেওয়া হয়।
আমরা ক্যাম্প এ যেতে উদ্যত হয়। পথিমধ্যে ২ নং ফটিকছড়ির চেয়ারম্যান ও ছাত্র জনতা সংগ্রাম
পরিষদের প্রেসিডেন্ট উষাতন চাকমা দাদার সাথে দেখা হয়। তিনি আমাদেরকে বসতে বলে নিজেই
পুলিশের সাথে দেখা করতে যান। এরপর দেখলাম ওই আট বাসের নারীদের সিএনজিতে করে পাঠানো
হচ্ছে। আমাদের ঢাকায় ফিরতে হবে বলে আমরা দুপুরের খাবার খেতে এক কমরেডের বাসায় প্রবেশ
করলাম।
দুপুরের খাবার খাওয়ার পর শুনি, ওই ৮ বাসের ড্রাইভাররা নাকি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি। তাদেরকে ক্যাম্পে শারীরিক আঘাত করা হয়েছে। সময়ের স্বল্পতা ও নিরাপত্তার কারণে আমাদেরকে পাহাড়ি কমরেডরা বললো দ্রুত চলে যেতে। তারাও যাবে। কারণ পরিস্থিতি আশংকাজনক।
একগাদা পাহাড়ি বন্ধুদের উপহার দেওয়া আম কাঠাল আর কলা নিয়ে পিসিপির
চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ চাকমার সহায়তায় সিএনজি চেপে বসেছি। কাউখালির দুপুর
উপভোগ করছি তিনজনে। ক্লান্ত কিছুটা। হঠাৎ কাউখালি বাজার পার হতেই একটি মোটরবাইক আমাদেরকে
সাইড করে। তার সবচেয়ে পিছনে কালো টিশার্ট পরা ছেলেটার সাথে আমাদের একাধিক চোখাচুখি
হয়। বাজার পার হয়ে বেতছড়ি জায়গাটার কাছে এসে সিএনজির সামনে তেড়ছা হয়ে মোটর বাইক রাখা
হয়। এবং আগ্রাসী ভুমিকায় কালো শার্টের ছেলেটি এসে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করে আমরা কে কোথায়
এসেছি? আমরা উলটো জিজ্ঞেস করি তারা কে? তারা বলে তাদের এলাকায় এসেছি তাদেরকেই পরিচয়
দিতে হবে, তারা এলাকার সাধারণ নাগরিক! আমরা বললাম আমরা ঘুরতে এসেছি। তারা বলে কোথায়
ঘুরতে এসেছি? আমরা তথ্য জানাতে অস্বীকৃত জানায়। কেন জানাবো অচেনা একজনকে?
এই সময়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি ও মুখে দাঁড়ি আলা লোকটা কাকে
যেন ফোন দিয়ে বলে হ্যা লাল টিপ আর দুই মেয়ে এক ছেলে তাই না? পাইছি তাইলে। (উল্লেখ্য
আমার কপালে লালটিপ, রাশা আর আমাকে মেয়ে ও সান ভাইকে ছেলে প্রতিপন্ন করেছে তারা)!
এই বলে সান ভাইকে অকস্মাৎ চড় মারতে শুরু করে ওরা। আমি আর রাশা
তাদের হাত চেপে ধরার চেষ্টা করি। ধস্তাধস্তি হয়। তারা আমাদের সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যেতে
চায়। স্পষ্ট বলে 'তোরা ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীর প্রোগ্রামে আসছস, তোরা জানস না আমরা কি
সংঘাতের মধ্যে আছি! কেন আসছস এই প্রোগ্রামে, আজ তোরক ঢাকায় কেমনে যাইস দেখবো"!
বারবার ইউপিডিএফকে সন্ত্রাসী বলে আমরা কেন এসেছি জিজ্ঞেস করে সান ভাইকে উপর্যুপরি চড়,
লাথি মারার একপর্যায়ে সান ভাই বলে উঠে "ইউপিডিএফ যদি সন্ত্রাসী হয়, আপনারা আরো
বড় সন্ত্রাসী, আপনারা আমাদের মারছেন, আমার চশমা ভেঙ্গে দিয়েছেন"! সান ভাইসহ আমাদের
বেশি বেশি মারার জন্য সিএনজি থেকে নামতে বলে ওরা, আমরা নামিনি।
দেবাশীষ চাকমা কি আমাদের সাথে কিনা জানতে চাইলে, আমি প্রথমে
অস্বীকার করি। উনাকে যাত্রী হিসেবে দেখাই। কারণ স্বাভাবিক ভাবে দেবাশীষদাদা বেশি ভারনারেবল
হবে আমাদের চাইতে। উনার ফোন চেক করে ওরা কিছু না পেয়ে দেবাশীষ চাকমাকে চলে যেতে বলে।
সিএনজি ড্রাইভারকে বলে না যেতে। দেবাশীষ দাদা বুদ্ধি করে নানাবিধ কথা বলে আমাদের ছেড়ে
যায়নি, তবে ড্রাইভার চাচ্ছিলো আমরা নেমে যাই।
সাদা পাজামা পরা লোকটা খুব কনফিউজড হয়ে যায় মেয়ে মানুষের গায়ে
হাত তুলবে কি করে! এজন্য সে আমাদেরকে মুখে জুতা দিয়ে পেটাতে চায়, কেটে টুকরা করতে চায়
আর সান ভাইকে চড় দেয়। অবশেষে আমি আর রাশা বারবার ধস্তাধস্তি করার সময় আমাকে চড় মারে
এবং রাশার কব্জি চেপে ধরে। আমাকে চড় মারলে আমি নেমে আসি সিএনজি থেকে। এইসময় আরো দুইটা
সিএনজি যাত্রীবোঝাই করে আসে। তাদেরকে চিৎকার দিয়ে বলে, "এই যে ইউপিডিএফের প্রোগ্রামে
আসছে ওরা"! এক হুজুর সিএনজির ভেতর থেকে বলে "পুলিশে নিয়ে যান "! আমি
তখন উনাকে সমর্থন দিয়ে বলি, ইয়েস ভাই! চলেন পুলিশে। পুলিশের কাছে যাবো চলেন"!
পুলিশ শুনে সাদা পাঞ্জাবি পিছনে বলে, "যা তোদের ছেড়ে দিলাম' জাতীয় এটিটিউড দেখিয়ে।
আমরা তো তখন ছাড়ার মুডে নেই। আমরা ক্যাম্পেও যেতে চাই, পুলিশেও যেতে চাই। কালো শার্টের
হাত ধরে বললাম, যে চলেন পুলিশে যাই। সে বলে কি, আমার গায়ে হাত দিছেন কেন? আমি রাশা
বলা শুরু করলাম এতক্ষণ গায়ে কে হাত দিসে? অদ্ভুতভাবে পুলিশের কাছে যেতে চাচ্ছি, থানায়
যেতে চাচ্ছি, ক্যাম্পে যেতে চাচ্ছি, আগ্রহী দেখাচ্ছি এই আলাপে ওরা পিছনে চলে যেতেই
থাকে।
আমরা সিএনজিতে উঠি। এরপর পোস্ট দেই। বার্তা পৌছাই।
রানীরহাটে নেমে আমি কাউখালি থানার ওসি সাইফুর ইসলামকে ফোন দিয়ে
জানাই। উনি বেতছুড়ি কাউখালি না রাঙ্গুনিয়া থানায় পড়ছে এই নিয়ে প্রথমে কনফিউশান দেখান।
আমরা আমাদের পরিচয় দেই। উনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসতে বলেন।
আমরা উনাকে ফোর্স পাঠাতে বললে উনি ঈদের ছুটিতে ফোর্স নেই জানান। আমরা ওই একই পথে থানা
ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাবার ঝুকিটা নিতে পারিনি, কারণ ওই মুহুর্তে কাউখালী
তে আমাদের কোন বন্ধুরা নেই। যদি ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ফের কোন মব সৃষ্টি হয় তবে
আমাদের জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। ডিসিশন নিয়েই আমরা চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার বরাবর
কথা বলবো বলে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে আসি।
চট্টগ্রামে এসে দেখি পুলিশ সুপার কার্যালয়ে কেউ নেই। নিচের
দারোয়ান থেকে এডিশনাল এসপি (এডমিন) আসাদুজ্জামানের সাথে কথা বললে, উনি রাঙামাটি পুলিশ
সুপারকে জানাতে বলেন এবং কাউখালিতে সশরীরে না হোক অনলাইনেও জিডি করতে বলেন, এবং আশ্বাস
দেন তা কার্যকরী হবে!
রাঙামাটির পুলিশ সুপারকে জানানোর জন্য আমি আমাদের সাংবাদিক
সহযোদ্ধা প্রত্যয়ী চাকমাকে জানাই। আর অনলাইনে জিডি করার চিন্তা নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে
রওনা দেই।
ঢাকার বাসে উঠার পর এক সাংবাদিক বন্ধু ফোন দিয়ে বললো তিনি কাউখালী
থানার ওসি সাইফুর ইসলাম এবং রাঙামাটি পুলিশ সুপারকে ফোন দিয়েছিলো আজকের ঘটনার ব্যাপারে
উক্তি নিতে।
তারা দুইজনই একই রিপ্লাই দিয়েছে "তারা এমন কিছু জানেনা,
বরং আজকের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ হয়েছে"!
এই কথা শুনে আমার মনে পড়লো, এই ব্যক্তিবর্গদের মতোই ৩৯ জন তদন্ত
কর্মকর্তা কল্পনা চাকমার তদন্তে গত ২৯ বছর ধরে প্রায় একই ভাষাগত রিপোর্ট দিয়ে এসেছে।
"কল্পনা চাকমাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে।
এই পোস্টের শেষে তিনি আপডেট যোগ করে বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে হামলাকারীদের
পেয়েছি। এরা কাউখালী সরকারি ডিগ্রী কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি মো: ইমরান হোসেন এবং সাধারণ
সম্পাদক মো: নাইম হোসেন হিমেল।” এতে তিনি তাদের ফেসবুক আইডির লিঙ্ক দিয়ে এভাবে উল্লেখ
করেন-
সাদা পাজামা হামলাকারীর আইডি: https://www.facebook.com/share/16VsEdEYk1/?mibextid=qi2Omg
কালো শার্টের হামলাকারীর আইডি https://www.facebook.com/share/1AX6FLUfgE/?mibextid=qi2Omg
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।