বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫
খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়ায় সেটলার বাঙালি মুনির ইসলাম ও এনায়েত হোসেন গঙ কর্তৃক
৮ম শ্রেণীর এক পাহাড়ি শিক্ষার্থীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে এবং ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারপূর্বক
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই ২০২৫) সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে
‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশ শুরুর পূর্বে জিরো পয়েন্ট থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি
কাটা পাহাড় সড়ক হয়ে বুদ্ধিজীবি চত্বর ও শহীদ মিনার প্রদক্ষিণ করে জিরো পয়েন্টে এসে
এক সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
মাষ্টার্সের শিক্ষার্থী সুদর্শন চাকমা'র সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন ২য়
বর্ষের শিক্ষার্থী অরিয়ন চাকমা, বিএমএসসি সংগঠক রাম্রাসাইন মারমা, টিএসএফ, চট্টগ্রাম
মহানগর শাখার সভাপতি ধনরঞ্জন ত্রিপুরা, ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া সিকদার, গণতান্ত্রিক
ছাত্র কাউন্সিল ও গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট, চবি শাখার সমন্বয়ক ধ্রুব বড়ুয়া প্রমুখ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি
ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ভূবন চাকমা।
শিক্ষার্থী অরিয়ন চাকমা বলেন, পাহাড়ে ধর্ষণ ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা না,
এটা পাহাড়ে চলমান জাতিগত নিপীড়নের হাতিয়ারের অংশ। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না
দিয়ে পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী বরং তাদের সুরক্ষা দিচ্ছে। আজকে ভাইবোনছড়ায়
সেনাবাহিনী কর্তৃক ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে বাধা দিয়ে হামলা করার দৃশ্য সেটিই প্রমাণ
করে।
বিএমএসসি সংগঠক রাম্রাসাইন মারমা বলেন, পাহাড়ে নারী নিপীড়ন থেকে শুরু করে
ভূমি বেদখল কিংবা সাম্প্রদায়িক হামলা সবকটিতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাত
রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরবর্তী সময় হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর ছাউনিতে
ঘেরা। প্রতিদিন কোন না কোনভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। বমদের জাতিগতভাবে নিধন করা
হচ্ছে। আজকে একজন বম রাষ্ট্রীয় কারাগারে মারা গেলো। এ দায় সরকারকে নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, খাগড়াছড়ির ধর্ষণ ঘটনা একটি ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় দখলদারনীতির
অংশ। এটা সেই দমননীতির অংশ, যেখানে পাহাড়ের ওপর সেনাশাসন কায়েম রেখে ভিন্ন জাতিসত্তাকে
দমন করা হচ্ছে। যেখানে পাহাড়ি নারীর শরীরকে উপনিবেশিক দখলের হাতিয়ার বানানো হয়েছে।
ধর্ষকদের শুধু গ্রেপ্তার করলেই হবে না, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ফাঁসি না দিলে সেটা প্রহসন
ছাড়া কিছু না।
টিএসএফ চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ধনরঞ্জন ত্রিপুরা বলেন, আমাদের এই
জমায়েত কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়। এটি এক অসহ্য রক্তক্ষরণ থেকে উঠে আসা ক্ষোভের বিস্ফোরণ।
মাত্র অষ্টম শ্রেণির এক ত্রিপুরা শিক্ষার্থী, একজন নিষ্পাপ কিশোরী সেটলার বাঙালি মুনির
ইসলাম ও এনায়েত হোসেন গংয়ের দ্বারা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ঘটনা ঘটেছে খাগড়াছড়ির
ভাইবোনছড়ায়। অথচ এই ভয়াবহ অপরাধের পরও প্রশাসনের নীরবতা দেখে আমরা শঙ্কিত নই, আমরা
এখন রাগে-ক্ষোভে-বেদনায় জ্বলে উঠেছি। আমরা দেখেছি ধর্ষণ হলে প্রশাসন ঘটনাটি চাপা দিতে
ব্যস্ত। ভূমি বেদখল হলে সেটাকে ‘সরকারি প্রকল্প’ বলে বৈধতা দেওয়া হয়। সেনা টহলে কোনো
শিশু আতঙ্কে কেঁপে ওঠলে, সেটাকে উন্নয়ন বলা হয়। আমরা পাহাড়ের ঘটে যাওয়া প্রত্যেক ঘটনার
বিচার চাই এবং সেনাশাসনের প্রত্যাহার চাই।
৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া সিকদার বলেন, বারবার পাহাড়ে ধর্ষণ হচ্ছে কখনো
মারমা, কখনো চাকমা, কখনো ত্রিপুরা মেয়েরা তার শিকার। কিন্তু অপরাধীরা বারবার বুক ফুলিয়ে
ঘুরে বেড়ায়, কারণ তারা জানে এই রাষ্ট্র ও প্রশাসন তাদের পাহারাদার, পাহাড়িদের নয়।
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের চবি শাখার সমন্বয়ক ধ্রুব বড়ুয়া বলেন, আজ পাহাড়ে
এক অদৃশ্য সেনাশাসন চলছে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সামরিক উপস্থিতি দিয়ে পাহাড়িদের
জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, আর পাহাড়ি নারীদের দেহকে বানানো হয়েছে সেই দমননীতি ও
দখল রাজনীতির এক নৃশংস শিকার।
তিনি আরো বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলছি এই ঘটনার দায় শুধু ধর্ষকদের নয়, এই দায় রাষ্ট্রের, প্রশাসনের এবং সেই দখলদার নীতির যারা পাহাড়ি জনগণের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করতে চায়। আমরা দেখেছি প্রশাসন প্রতিবারই ধর্ষণের পর সময়ক্ষেপণ করে। প্রশাসন নির্যাতিতের পাশে দাঁড়ানোর বদলে অপরাধীদের রক্ষা করে। পাহাড়ে নারীর জীবন নিরাপদ নয়, ভূমি নিরাপদ নয়, জাতিসত্তার অধিকার সুরক্ষিত নয়। তাই, গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের পক্ষ থেকে আমরা জোর দাবি জানাই, অবিলম্বে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড়ে নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে পাহাড়ে নাগরিক প্রশাসন কায়েম করতে হবে।
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ চবি শাখার সভাপতি ভূবন চাকমা
তার সভাপতির বক্তব্যে বলেন, আজ আমরা এখানে এক গভীর ক্ষত ও এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে আছি। খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়ায় মাত্র অষ্টম শ্রেণির এক ত্রিপুরা শিক্ষার্থী, এক
পাহাড়ি কিশোরী, সেটলার বাঙালি মুনির ইসলাম ও এনায়েত হোসেন গংয়ের দ্বারা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের
শিকার হয়েছে। এই ঘটনার খবর শুধু আমাদের কাঁদায়নি, আমাদের জাগিয়ে তুলেছে। এই ধর্ষণ শুধু
একটি অপরাধ নয় এটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন কাঠামোর প্রতিফলন।
তিনি আরো বলেন, এটি সেই সহিংস ঔপনিবেশিক মনোভাবের প্রকাশ, যেটা দীর্ঘদিন
ধরে আমাদের পাহাড়ি সমাজকে দমন করে আসছে। আমরা আজও দেখি ধর্ষণ হয়, কিন্তু বিচার হয় না।
ভূমি বেদখল হয়, কিন্তু প্রতিরোধ করলে মামলা হয় পাহাড়িদের নামে। সেনা ক্যাম্পের ছায়ায়
পাহাড়ি নারীদের মর্যাদা পদদলিত হয়, অথচ রাষ্ট্র বলে "উন্নয়ন" চলছে। এ কেমন
উন্নয়ন যেখানে আমাদের মেয়েরা স্কুলে যেতে ভয় পায়? এ কেমন রাষ্ট্র যেখানে এক কিশোরীর
চিৎকারও প্রশাসনের কানে পৌঁছায় না? আমরা পাহাড়ে সুস্থ পরিবেশে বাঁচতে চাই। যেখানে আমার
সহোদরেরা মুক্ত বিহঙ্গের মতো নিরাপদে পাহাড়ে বেড়ে উঠতে পারবে।
সমাবেশ থেকে চিহ্নিত গণধর্ষণকারী এনায়েত, আরমান হোসেন গঙদের দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তি প্রদান করা; ধর্ষণ বিরোধী সমাবেশে শিক্ষার্থীদের উপর নগ্ন হামলায় জড়িত সেনা
সদস্যদের ব্যবস্থা নেওয়া; ভাইবোন ছড়ায় ভিকটিম স্কুল ছাত্রীর জীবনের নিরাপত্তা ও যাবতীয়
চিকিৎসা খরচ নিশ্চিত করা এবং চিংমা খিয়াং হত্যার বিচার, বম জাতিসত্তার উপর রাষ্ট্রীয়
নিপীড়ন বন্ধ ও রাষ্ট্রীয় কারাগারে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার দাবি জানানো হয়।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।