""

সন্তু লারমা: শাসকগোষ্ঠীর আন্দোলন দমনের হাতিয়ার

সন্তু লারমা।



সুনয়ন চাকমা, সাবেক সভাপতি, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ


এক.

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরের ১৭ জন পাহাড়ি নেতা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন রাষ্ট্রপতি) শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার সরকারি বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন।  তারা প্রাদেশিক আইনসভাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন প্রদান, পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৯০০ রেগুলেশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু আইনগত বিধান জারি, চাকমা, মং ও বোমাং- এই তিন রাজার দফতর অক্ষুন্ন রাখা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামত ব্যতিত এই অঞ্চলে কোনো প্রকার প্রশাসনিক কাঠামো বিস্তার না করা ু এই ৪দফা দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি মুজিবের হাতে তুলে দেন।  কিন্তু যে আওয়ামীলীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অনড় ছিল, সেই দলের নেতা শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পাহাড়িদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললেন, “বাংলাদেশের সব মানুষ বাঙালি। এই সত্য অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই।  সুতরাং স্বায়ত্তশাসনের কথা ভুলে যাও, বাড়ি ফিরে যাও, এবং বাঙালি হয়ে যাও।

এরপর ১৯৭২-১৯৭৫ সময়ের মধ্যে এম এন লারমার নেতৃত্বে ওভারগ্রাউন্ড এবং আন্ডারগ্রাউন্ড এই উভয় আন্দোলনের প্রস্তুতির লক্ষ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংহতি সমিতির মত একটা রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি ‘শান্তি বাহিনী নামে সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা হয়। এম এন লারমার নেতৃত্বে পিসিজেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রামের দুইটি সংসদীয় আসনে জয়লাভ করে।  অপরদিকে তাদের গেরিলা ইউনিট শান্তিবাহিনী সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে জুড়ে প্রভাব বিস্তার করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট শেখ মুজিব ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ এক নৃশংস সেনা অভ্যূত্থানে নিহত হন।  পরের দিন খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলেও বছরের শেষ দিকে এক সফল সেনা অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতায় আসেন।

এসময় গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও উন্মুক্ত রাজনীতির সুযোগ সীমিত হয়ে আসলে জেএসএস নেতারা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সশস্ত্র সংগ্রামের জন্যই এত বছর ধরে শান্তিবাহিনীকে প্রস্তুত করা হয়েছিল।  তাদের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের আরেকটি কারণ হলো শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশের নতুন সরকারের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতির পরিবর্তন।

সে সময় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW)-এর আগরতলায় মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত গোপাল চাকমার মাধ্যমে সন্তু লারমা ও ভবতোষ দেওয়ান ২১ আগস্ট দিল্লি গিয়ে ‘র-এর কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাত করেন এবং গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও ভারতের ভূমি ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি লাভ করেন।  সন্তু লারমা দিল্লি থেকে ফিরে ২৯ আগষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে আগরতলা ত্যাগ করেন।  তার একদিন পর অর্থাৎ ৩০ আগস্ট তিনি পানছড়ি-খাগড়াছড়ি রোডের কুকিছড়া থেকে বাংলাদেশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এই গ্রেফতার ছিল ভারতের সহযোগিতায় গেরিলা যুদ্ধ শুরু করার পরিকল্পনার একেবারে চূড়ান্ত ধাপে এসে মুখ থুবড়ে পড়া।  কারণ সন্তু লারমা ছিলেন শান্তি বাহিনীর প্রধান বা ফিল্ড কমান্ডার। তার ধরা পড়ার কারণে ভারত ও পিসিজেএসএসের সকল গোপন পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে পড়ে। এতে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বেই বড় ধাক্কা লাগে। অবিভক্ত পিসিজেএসএসের সে সময়কার অন্যতম শীর্ষ নেতা প্রীতি কুমার চাকমা সন্তু লারমাকে সরকারী রাস্তা এড়িয়ে জঙ্গলের পথ ব্যবহার করে খাগড়াছড়ি যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেলেন। কিন্তু তিনি তার পরামর্শ কানে তোলেননি। এজন্য অনেক পিসিজেএসএস নেতা সরকারী রাস্তা ব্যবহার করার কারণে পুলিশের কাছে ধরা পড়াকে তার কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ বলে মন্তব্য করেছিলেন।

১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এম. এন. লারমা প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে এসে গোপন আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ভারতে প্রশিক্ষণ লাভের পর শান্তি বাহিনীর প্রথম দফার গেরিলারা ফিরে এলেই ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয় ও ক্রমে তীব্র রূপ ধারণ করে।  সন্তু লারমা জেলে অন্তরীণ থাকাকালেই এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। সর্বাত্মক গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতির গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে সন্তু লারমা সম্পূর্ণ নিজের দোষে গ্রেফতার হন এবং ক্রমে শাসকগোষ্ঠীর আন্দোলন দমনের হাতিয়ারে পরিণত হন।

দুই.

সশস্ত্র সংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করলে বাংলাদেশ সরকার তা দমনে হিমসিম খেতে থাকে। এ সময়ের মধ্যেই শান্তিবাহিনী একটি বিগ্রেডের শক্তি (ন্যূনতম ২ হাজার ৬০০ জন গেরিলা) অর্জন করে।  বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গেরিলাদের আক্রমণে পর্যুদস্ত হতে থাকে। জিয়াউর রহমান আন্দোলন দমনের কৌশল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু গেরিলারা সদ্য অনুপ্রবেশ করা সেটলারদের ওপর আঘাত করলে সরকারের পরিকল্পনা বানচাল হওয়ার উপক্রম হয়। প্রাণের ভয়ে অধিকাংশ সেটলার পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যায়।

ঠিক এই অবস্থায় বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একটি দূরদর্শী কৌশলী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৯৮০ সালের ২৩ জানুয়ারি বিশেষ নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে পিসিজেএসএসের দুই নেতা সন্তু লারমা ও চাবাই মগকে মুক্তি দেন। জিয়া বিশ্বাস করতেন, সন্তু লারমার অনুস্থিতিতে পিসিজেএসএস পার্টির ভেতরে ইতিমধ্যে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। তাই সন্তু লারমার মুক্তি সরকারকে রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিতে ফেলবে না, বরং পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৌশলগতভাবে সহায়ক হবে।

ভারতীয় নামকরা সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক লেখেন, জিয়ার এই কৌশল ভালো ফল দিয়েছিল।  সন্তু লারমা ছাড়া পেয়ে যা যা করলেন তা বাংলাদেশ সরকারকে বিপুলভাবে লাভবান করেছিল।  জেল মুক্তির পর সন্তু লারমা যখন দলের অভ্যন্তরে ৪৫ পৃষ্ঠার একটি নথি বিতরণ শুরু করেন, তখন তার সহযোদ্ধারা বেশ হতবাক হয়ে পড়েন। ওই নথিতে তিনি উল্লেখ করছিলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমেই সম্ভব।  পরে জানা যায়, ৪৩ পৃষ্ঠার একই চিঠি তিনি স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে পাঠিয়েছিলেন, যার ভিত্তিতে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।  এই নথি শান্তি বাহিনীর সাধারণ সদস্যদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। স্ব য়ং এম এন লারমা মন্তুব্য করে বলেছিলেন: আ দ বেগ ভারাল আদুরি গালি দেগোই। (তাহলে সে তো পার্টির সব গোপনীয় বিষয় বলে দিয়েছে)।

সরকারের কাছে দেয়া ৪৫ পৃষ্ঠার নথিতে সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয়ার পর, পিসিজেএসএস ও শান্তি বাহিনীর অনেক নেতা সন্তু লারমাকে এত দ্রুত দলে ফেরানোর বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন।  কিন্তু এম এন লারমা তাদের মতামত অগ্রাহ্য করে তাকে আবার দলে নিয়ে আসেন।  এর কয়েকদিন পর যখন এম এন লারমা চিকিৎসার জন্য ভারতে যান, তখন তিনি সন্তু লারমাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে যান। এই দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথেই সন্তু লারমা প্রথমে যা করলেন তা হলো নতুন বসতিস্থাপনকারী মুসলিম সেটেলার বাঙালিদের ওপর হামলা বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ।  সেই সঙ্গে তিনি মেজর দেবজ্যোতি চাকমার নেতৃত্বাধীন শান্তি বাহিনীর বিশেষ টাস্কফোর্স ভেঙে দেন। ওই টাস্কফোর্সটি মূলত সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়ন ও নতুন আগমন রোধ করতে তাদের নতুন বসতিগুলোতে বড় ধরনের হামলা চালানোর জন্য গঠন করা হয়েছিল।

শুধু তাই নয়, সন্তু লারমা ছাড়া পাওয়ার পর প্রচার করতে শুরু করেন যে, সরকারের সাথে সংলাপ শুরু হবে, তাই আন্দোলন হবে নিরর্থক। তিনি শান্তিবাহিনীর সদস্যদেরকে নির্ভয়ে হাটে বাজারে ঘোরাফিরা করতে বলেন। এভাবে তিনি দলের সদস্যদের বিভ্রান্ত করেন এবং কার্যত সশস্ত্র সংগ্রামের গতিকে শ্লথ করে দেন। এরপর তার কারণেই শুরু হয় জেএসএস এর মধ্যকার রক্তক্ষয়ী অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ, যে যুদ্ধে স্বয়ং এম এন লারমা প্রাণ হারান।

এদিকে পাহাড়িদের জমি বেদখল করে গড়ে তোলা সেটলার বসতিতে হামলা বন্ধ হলে সরকার তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। সরকার পিসিজেএসএসের মধ্যে চলা গৃহযুদ্ধের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে নতুন করে আবার সেটলারদের নিয়ে আসে। এছাড়া সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান সংহত করে নেয়।  এসবই সম্ভব হয় সন্তু লারমাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়ার কারণে। কাজেই নিঃসন্দেহে বলা যায়, সেটলার বসতি প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে সন্তু লারমা শাসকগোষ্ঠীর আন্দোলন দমনের হাতিয়ার হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতন আবির্ভূত হন।

তিন.

১৯৮৩-৮৫ সালের গৃহযুদ্ধে জয়লাভের পর সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পিসিজেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু তারপরও তিনি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিস্তার ঘটাতে কিংবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখ করার মত সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন, যদিও তিনি সে সময় ভারত সরকারের কাছ থেকে সামরিক ও অন্যান্য সাহায্য লাভ করেছিলেন। সন্তু লারমার সশস্ত্র আন্দোলন মূলতঃ মুসলমান বাঙালি বসতিতে হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু নতুন করে সেটলার বসতিতে হামলা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়।  এবার সেনাবাহিনী সংগঠিত বাঙালি সেটলারদের নিয়ে পাহাড়িদের বসতিতে পাল্টা হামলা চালায়। ফলে পাহাড়িরা নিজ বাড়িঘর ও জমিজমা থেকে উৎখাত হয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।  বাঙালি সেটলাররা তারপর পাহাড়িদের সকল জমিজমা ও ঘরবাড়ি দখল করে নেয়। এসব জমি পাহাড়িরা এখনও ফিরে পায়নি।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, সন্তু লারমা কেন ১৯৮০ সালে তার ভাষায় বিনা শর্তে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পরই সেটলারদের ওপর হামলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং কেনই-বা গৃহযুদ্ধ শেষে তিনিই আবার নতুন করে সেটলারদের ওপর হামলা শুরু করার নির্দেশ দেন? আসলে তিনি প্রথমে হামলা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে সেটলারদেরকে সুসংগঠিত ও তাদের ভিত্তি মজবুত করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। অপরদিকে ভুল সময়ে নতুন করে পুনরায় হামলার নির্দেশ দিয়ে বাঙালি সেটলারদেরকে পাহাড়িদের ওপর পাল্টা হামলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, বুঝে হোক, না বুঝে হোক, সন্তু লারমার এইসব সিদ্ধান্ত কেবল বাংলাদেশ সরকার, সেনাবাহিনী ও বাঙালি মুসলমান সেটলারদেরকেই লাভবান করেছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ক্ষেত্র সৃষ্টি হলেও সন্তু লারমার কারণে তা বার বার ব্যর্থ হয়েছে।  তিনি তার ব্যক্তিগত স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সকল সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেন। এজন্য ইতিহাস তাকে কখনই ক্ষমা করবে না। তবে সন্তু লারমার জমানা চিরকাল থাকবে না। কুমিরেরও যেমন মরণ আছে, সন্তু লারমারও তেমনি পতন আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ একদিন অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হবে এবং আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার ছিনিয়ে আনবে। 

আগেই বলা হয়েছে, গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করলেও সন্তু লারমা আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন। সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিমধ্যে তার শক্তি বৃদ্ধি ও সংহত করতে সক্ষম হয়। ১৯৮৯ সালে সরকার আরও একটি নতুন চাল দেয়।  তা হলো তিন জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদ (জেলা পরিষদ) গঠন ও নির্বাচন।  সন্তু লারমার জেএসএস তা প্রত্যাখ্যান করে এবং নির্বাচন বানচালের ঘোষণা দেয়।  কিন্তু সরকার জেএসএসের বিরোধীতা সত্বেও জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে।  জেএসএস নির্বাচন বানচাল করতে ব্যর্থ হলে তাদের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া সেনাবাহিনী গুচ্ছগ্রাম, আদর্শ গ্রাম, বড় গ্রাম নামে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প এবং বিভিন্ন ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গঠন করে জেএসএসকে কোনঠাসা করে ফেলে। দলে দলে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা সরকারের কাছে আত্মসমর্পন করতে থাকে। এক কথায় বলতে গেলে সন্তু লারমার নেতৃত্বে জেএসএসের আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে।

ঠিক এই প্রেক্ষাপটে ১৯৮৯ সালের ২০ মে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ জন্ম লাভ করে।  অল্প সময়ের মধ্যেই এটি পাহাড়ি জাতিসত্তার রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।  পিসিপির নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভূতপূর্ব ব্যাপক ছাত্র গণ আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হয়। যার ফলে সরকার ও সেনাবাহিনী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।  এরপরই কেবল শান্তিবাহিনীর সদস্যদের আত্মসমর্পন বন্ধ হয় ও পিসিজেএসএস নিঃশ্বাস ফেলার সময় পায়।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হওয়ার ফলে আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হতে থাকে। ফলে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত খালেদা জিয়ার সরকার জনসংহতি সমিতির সাথে সংলাপের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়। সংলাপ চলার সময়ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ অন্যান্য সংগঠনগুলো তাদের আন্দোলন জোরদার করে সরকারকে চাপের মধ্যে রাখার চেষ্টা চালায়।  কিন্তু ১৯৯৫ সালের ১৫ জুন হঠাৎ সন্তু লারমা সরকারের সাথে বৈঠক শেষে ধুধুকছড়ায় অপেক্ষমান জনতার সম্মুখে ভাষণ দেয়ার সময় পিসিপিকে উদ্দেশ্য করে বলেন: ‘গুলতি মেরে, জঙ্গী আন্দোলন করে স্বায়ত্তশাসন কায়েম করা যায় না।’ তার এই বক্তব্য ছিল অনেক কষ্ট করে গড়ে তোলা আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাতের সামিল।

তার এই বক্তব্যের পর পরই সেনাবাহিনী খাগড়াছড়িতে মুখোশ বাহিনী গঠন করে দেয় এবং এই বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে পিসিপি, পিজিপি (পাহাড়ি গণ পরিষদ) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা শুরু করে। ফলে পিসিপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ভাটা পড়তে থাকে।  যে সময় সংলাপের টেবিলে সুবিধা পাওয়ার জন্য জেএসএসের উচিত ছিল সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে পিসিপিদের দিয়ে আন্দোলন জোরদার করা, সেখানে সন্তু লারমা উল্টো সেই আন্দোলন দুর্বল ও বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নেন। এভাবে তিনি তৃতীয়বারের মতো জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন দমনের জন্য শাসকগোষ্ঠীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হন।

চার.

১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর কয়েক দফা সংলাপের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জনসংহতি সমিতি সরকারের সাথে চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করে ও অস্ত্র-গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পন করে। এরপরের ইতিহাস কমবেশি সবার জানা। সন্তু লারমা চুক্তি বাস্তবায়নের চেষ্টা ও আন্দোলন না করে ইউপিডিএফের সাথে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের সূচনা করেন। এতে আজ পর্যন্ত গত ২৭ বছরে আনুমানিক ৬০০ জন প্রাণ হারিয়েছে।  এই সংঘাতের ফলে সরকারের বিরুদ্ধে পাহাড়িদের দাবি আদায়ের আন্দোলন বলতে গেলে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ইউপিডিএফ বার বার ঐক্য ও সমঝোতার আহ্বান জানায় এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সন্তু লারমা বার বার সেই প্রস্তাব প্রখ্যাখ্যান করেন।

দীর্ঘ পনেরো বছরের একনায়কতান্ত্রিক ও দমনমূলক শাসনের পর গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।  এই ঐতিহাসিক ঘটনা শুধু সমতলের রাজনীতিতেই নয়, ইতিবাচক প্রভাব ফেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজের মাঝেও। ইউপিডিএফের নেতৃত্বে পাহাড়িরাও এই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়।  অভ্যুত্থানের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা আন্দোলন গড়ে তুলতে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন নামক ব্যানারে সংগঠিত হয়। তারা খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি শহরে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে।  দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ব্যাপক গণ আন্দোলনে রূপ লাভ করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এতে গভীর হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণ নতুন করে আশার আলো দেখতে পায়। কিন্তু সন্তু লারমার অবিমৃষ্যকারিতার জন্য সেই আশায় আবার গুড়েবালি পড়ে।

সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দাবি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় জেএসএস সন্তু গ্রুপের জারী রাখা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের অবসান এবং জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমান নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। আন্দোলনকারীরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও আদিবাসী স্বীকৃতিকে তাদের মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে।  সকলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে তারা ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং অন্যান্য দল ও সংগঠনের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেয়।

যদিও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন এবং আদিবাসী স্বীকৃতির জেএসএসের দীর্ঘদিনের দাবি, তবু রহস্যজনকভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জেএসএস (সন্তু) নেতৃত্বের বাধার মুখে পড়ে। জেএসএসের পক্ষ থেকে প্রায়শ দাবি করা হয় যে ইউপিডিএফ চুক্তির বিরোধিতা করে বলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে সমালোচনা করলেও, ইউপিডিএফ কখনোই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে কোনো প্রকার বাধা দেয়নি।  বরং তারা আন্দোলনের বৃহত্তর স্বার্থে শিক্ষার্থীদের আহ্বানে এই দুই দাবিতে আন্দোলন হলে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়।  কিন্তু ইউপিডিএফসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯৯ শতাংশ পাহাড়ি জনগণ ‘সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডাকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হলেও সন্তু লারমা ও তার দল তাতে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়।

সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন অংশ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন না দিয়ে বরং তাতে বাধা দিয়ে দুর্বল করার প্রয়াস চালায়। তারা সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের হুমকি দেয়, আন্দোলনে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করে এবং শেষে সরকারের সাথে যোগসাজশ করে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে আন্দোলন ধ্বংস করে দেয়। জেএসএস সন্তু গ্রুপের সহযোগিতা না পেলে সরকার বা সেনাবাহিনী কখনই শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হতো না।কারণে ইতিপূর্বে দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি শহরে উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটলার সংগঠনগুলোকে দিয়ে হামলা-দাঙ্গা করেও সেনা শাসকগোষ্ঠী তাদের আন্দোলনকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছিল।

মূলতঃ জেএসএসের রাজনৈতিক ভুল অবস্থানের কারণে সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন একটি সম্ভাবনাময় সময়েও কাঙ্ক্ষিত শক্তি হিসেবে বিকশিত হতে পারেনি। সেনা শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে পিসিজেএসএস প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনে বাধা দেয় এবং ফলে হাসিনার পতনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক ছাত্র গণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, তা জেএসএস (সন্তু) নেতাদের কারণে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। এভাবে সন্তু লারমা চতুর্থ বারের মতো জুম্ম জনগণের আন্দোলন দমনের শাসকগোষ্ঠীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হন।

উপসংহারে বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ক্ষেত্র সৃষ্টি হলেও সন্তু লারমার কারণে তা বার বার ব্যর্থ হয়েছে।  তিনি তার ব্যক্তিগত স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সকল সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেন। এজন্য ইতিহাস তাকে কখনই ক্ষমা করবে না। তবে সন্তু লারমার জমানা চিরকাল থাকবে না। কুমিরেরও যেমন মরণ আছে, সন্তু লারমারও তেমনি পতন আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ একদিন অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হবে এবং আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার ছিনিয়ে আনবে।  (সমাপ্ত)

৩১.০৭.২০২৫

* লেখাটি সুনয়ন চাকমার নিজস্ব ব্লগ থেকে নেওয়া হয়েছে।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।









0/Post a Comment/Comments