খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
খাগড়াছড়িতে নিপীড়ন বিরোধী মহাসমাবেশ থেকে আগামীকাল শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর
২০২৫) খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে জুম্ম ছাত্র
জনতা।
আজ শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সকালে খাগড়াছড়ি শহরের চেঙ্গী স্কয়ারে ‘পার্বত্য
চট্টগ্রামে অব্যাহত নারী নিপীড়ন ও সেনা-প্রশাসনের বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের
বিরুদ্ধে’ এই নিপীড়ন বিরোধী মহাসমাবেশের আয়োজন করে তারা।
সমাবেশের আগে খাগড়াছড়ি কলেজ মাঠ থেকে মিছিল বের করে তারা শহরের গুরুত্বপূর্ণ
সড়ক প্রদক্ষিণ করে শাপলা চত্ত্বরের মুক্তমঞ্চ এলাকা ঘুরে চেঙ্গী স্কয়ারে এসে সমাবেশ করেন।
সমাবেশে বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১০ হাজারের অধিক লোক অংশগ্রহণ করেছেন বলে আয়োজনকারীদের দাবি।
সমাবেশে কৃপায়ন ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা আমরা দেখতে
পাচ্ছি। কিন্তু এসব ধর্ষণের ঘটনা রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অন্যদিকে
নিয়ে যাওয়া হয়। নারীর চরিত্র নিয়ে কথা বলা হয়। যারাই ধর্ষক তারাই নারীদের নিয়ে এমন
করে থাকে। প্রতিটি ঘটনা সেনা-প্রশাসনের মাধ্যমে সংঘটিত হয় উল্লেখ করে তিনি এর তীব্র
নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
তিনি বলেন, গতকাল রাতে একজন ছাত্র নেতাকে টেনেহিঁচড়ে সেনাবাহিনীর গাড়িতে
তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং গাড়ির ভিতর তাকে পিটিয়ে আঘাত করা হয়। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর
প্রতি নিন্দা জানান তিনি।
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আরেকবার যদি কোন ছাত্র নেতার গায়ে হাত তোলা হয়
আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম অচল করে দিতে বাধ্য হবো।
কৃপায়ন ত্রিপুরা সেনাবাহিনীর বিষয়ে বলেন, একটি রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর গুরুত্ব
রয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা বার বার সেনাশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছি।
আমরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নই, সেনাশাসনের বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, সারাদেশে নারী, শিশু ধর্ষণ, নিরাপত্তাহীনতা ও বিচারহীনতার যে
সংস্কৃতি আমরা তার থেকে উত্তরণ চাই।
ধর্ষণের ঘটনা সমতলেও ঘটছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা জানি ২০১৬ সালে তনুকে
ক্যান্টনমেন্টের ভিতর কীভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল। কিন্তু নতুন
‘স্বাধীন’ বাংলাদেশে আমরা এর বিচার এখনো দেখিনি। আমরা ভাবি ক্যান্টনমেন্ট হচ্ছে নিরাপত্তার
চাদরে ঘেরা। কিন্তু সেই ক্যান্টনমেন্টেও যদি একজন হিজাবপরা নারীর নিরাপত্তার না থাকে
তাহলে নিরাপত্তা কোথায়?
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নারী, শিশু ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিচার
দাবি করেন।
নারী নেত্রী কবিতা চাকমা বলেন, একজন ৮ম শ্রেণির ছাত্রীকে তিন জন ধর্ষক মিলে
যেভাবে নির্মমভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে তারই বিচার দাবিতে আজ আমরা এখানে মিলিত হয়েছি।
তিনি বলেন, গতকাল অবরোধ পালনকালে একজন তরুণী এক সেনা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা
করেন, পাহাড়ে আপনারা থাকতে ধর্ষণ হবে কেন? তখন তার উত্তরে সেনা কর্মকর্তা বলেছেন এটা
স্বাভাবিক। আমি আজকে সেই সেনা কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করতে চাই, পাহাড়ি নারী না হয়ে যদি
আপনার বোন কিংবা মা ধর্ষিত হতেন তাহলে কী আপনি এটা স্বাভাবিক বলতে পারতেন?
কবিতা চাকমা আরো বলেন, যারা ধর্ষণসহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তাদেরকে
ধরে নেওয়া হয়, অপহরণ, খুন, গুম করা হয়। যে বাহিনী গুম, খুন করে, যে বাহিনী অন্যায়ের
বিরুদ্ধে কথা বলে না, সে বাহিনী আমরা মানি না, মানি না।
উক্যনু মারমাকে তুলে নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, গতকাল উক্যনু মারমাকে সেনাবাহিনী
অপহরণ করে নিয়ে যায়। আমরা জানি উক্যনু মারমা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। আমরা এ রাষ্ট্রে
থেকে দেখছি যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ করে তাকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়,
অপহরণ করে, খুন করে, গুম করে। কেন এটা করবে? আমরা কি এদেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
করতে পারবো না?
তিনি বলেন, আজকে আমরা ধর্ষণের বিচার চাইতে এখানে এসেছি। আমরা আইনের ওপর আস্থা রেখে নিপীড়ন-নির্যাতন ও ধর্ষণের বিচার পাবে এই আশা ব্যক্ত করছি।
তিনি সেনাবাহিনীকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ভবিষ্যতে সেনাবাহিনী যাতে এ
ধরনের নৃশংস কর্মকাণ্ড না করে সেজন্য হুশিঁয়ারি দিচ্ছি। যদি আবারো এ ধরনের কর্মকাণ্ড
করা হয় তাহলে আমরা তিন পার্বত্য জেলা অচল করে দিতে বাধ্য হবো।
তিনি ভবিষ্যতে যে কোন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে সমবেত ছাত্র-জনতার প্রতি আহ্বান
জানান।
আকাশ ত্রিপুরা বলেন, আমরা বার বার বলে আসছি, আমরা কোন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে
নই, আমরা সেনাশাসনের বিরুদ্ধে। সেনাবাহিনীর কাজ জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু সেখানে
আমাদের ওপর নির্যাতন, জুলুম, অত্যাচার করা হয়। তিনি অতীতে তার ওপর নিপীড়নের ঘটনা তুলে
ধরেন।
তিনি আরো বলেন, আমরা কোন দালালি করছি না। আমরা আমাদের অস্তিত্বের জন্য আন্দোলন
করছি, কথা বলছি। তাহলে এখানে আমাদের দোষ কোথায়? তিনি জুম্মদের মধ্যে থাকা দালালদের
চিহ্নিত করে প্রতিরোধ করারও আহ্বান জানান।
সাচিং মারমা বলেন, আমাদের ওপর যে দমন-পীড়ন করা হচ্ছে তা জাতিগত নিপীড়ন।
গতকাল উক্যনু মারমাকে ধরে নিয়ে যে নির্যাতন করা হয়েছে এটা রাষ্ট্র যন্ত্রের কাজ। পার্বত্য
চট্টগ্রামে দশকের পর দশক ধরে রাষ্ট্রযন্ত্র সেনাশাসন কায়েম করে রেখেছে। আমরা এর প্রতিবাদ
জানাই। এক দেশে দুই শাসন কেন চলবে?
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আপামর জুম্ম জনগণ যাতে আন্দোলনে নামতে
না পারে সেজন্য প্রত্যেকবার আমাদেরকে তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়। বলা হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী,
সন্ত্রাসী, উপজাতি হিসেবে।
তিনি মিডিয়া ও প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, যারা নিজেদের অস্তিত্ব
রক্ষায় জাতির জন্য কাজ করছে তারা সন্ত্রাসী নাকি গতকাল যারা উক্যনু মারমাকে ধরে নিয়ে
গেছে তারা সন্ত্রাসী?
তিনি মিডিয়ার ওপর হাঁ করে তাকিয়ে না থেকে প্রত্যেককে মিডিয়ার ভূমিকা পালনের
আহ্বান জানান।
জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আজকে যারা সমাবেশে উপস্থিত হয়েছেন আপনারাই
আমাদের নিরাপত্তা দেবেন। গতকাল উক্যনু মারমাকে সন্ত্রাসী কায়দায় ধরে নিয়ে একটি প্রতিবাদী
কন্ঠস্বরকে দমাতে চেয়েছে। কিন্তু আমরা দমে যাইনি। আমাদেরকে দমিয়ে রাখা যাবে না।
তিনি বলেন, যে স্কুলছাত্রীকে তিনজন মিলে ধর্ষণ করা হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র
একজনকে আটক করা হয়েছে। শুধুমাত্র সেপ্টেম্বর মাসে বেশ কয়েকটি ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
কিন্তু দেশের মেইন স্ট্রিম মিডিয়ায় তেমনটা স্থান পায়নি। তাই আমাদের প্রত্যেককে একেকটি
মিডিয়া হয়ে কাজ করতে হবে। আমরা সকল অন্যায় রুখে দেবো। গতকাল যেমন রুখে দিয়েছি, আগামীতেও
রুখে দেবো।
তিনি খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্টকে দেখিয়ে দিয়ে বলেন, এই ক্যান্টনমেন্ট থেকে
জনগণকে সেবা দিতে, নিরাপত্তা দিতে আসে। কিন্তু আমরা কি দেখতে পাই। আমরা সিন্দুকছড়ি,
সিঙ্গিনালাসহ বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে দেখতে পাই তারা ভুক্তভোগীদের
নিরাপত্তা না দিয়ে ধর্ষকদের নিরাপত্তা দেয়। সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার করে না।
শেষে তিনি “উজো উজো” শ্লোগাসহ এক দুই তিন চার, সেনা তুই পাহাড় ছাড়, যে
বাহিনী মানুষ মারে সে বাহিনী চাই না’ শ্লোগান দেন। এতে উপস্থিত ছাত্র-জনতার শ্লোগানে
সমাবেশস্থল প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
তার বক্তব্য শেষ হতেই সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি সমাবেশস্থলে প্রবেশ করতে চাইলে উপস্থিত ছাত্র-জনতা তাদের বাধা দেয়।
শেষে ছাত্রনেতা উক্যনু মারমা জুম্ম ছাত্র জনতার পক্ষ থেকে আগামীকাল শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫) খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা (ভোর ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা) সড়ক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, অবিলম্বে স্কুলছাত্রীর ধর্ষণকারীদের গ্রেফতার-শাস্তি
এবং উক্যনু মারমাকে তুলে নেয়ার ঘটনায় জড়িত জোন কমান্ডারকে অপসারণ।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দূর্গাপূজার সময় কোন কর্মসূচি পালন না করার কথা জানিয়ে
উক্যনু মারমা বলেন, এর মধ্যে যদি দাবি পূরণ করা না হয় তাহলে দূর্গাপূজার পরে হরতালসহ
লাগাতার কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।
উল্লেখ্য, গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ি সিঙ্গিনালায় প্রাইভেট পড়ে বাড়ি যাওয়ার পথে ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে তিন বাঙালি যুবক মুখ চেপে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় শয়ন শীল (১৯) নামে একজনকে আটক করা হলেও বাকী দুজনকে এখনো পুলিশ গ্রেফতার করেনি। এ ঘটনার প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র জনতা বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ি জেলায় আধাবেলা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।