""

পাহাড়ে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর ডন কুইক্সোটীয় অভিযান



মন্তব্য প্রতিবেদন


পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর বর্তমান কাণ্ডকারখানা ডন কুইক্সোট ও সাঙ্কো পানজার গল্পটি মনে করিয়ে দেয়। বিভিন্ন রোমাঞ্চকর বীরত্ব গাঁথা পড়ে ডন কুইক্সোটের (প্রকৃত স্প্যানিস উচ্চারণ ডন কুহতে) অভিলাষ হলো সেও একজন নাইট বা বীর হবে। তাই সে রোমাঞ্চকর অভিযানে বের হয়। সঙ্গে তার সহযোগি হিসেবে নেয় গ্রামের অতি সাধারণ বাস্তববাদী চাষী সাঙ্কো পানজাকে (প্রকৃত উচ্চারণ সানজো পানতা)।

অভিযানে ডন কুহতে অত্যন্ত সাধারণ বস্তুকে খুব বড় হুমকি হিসেবে দেখে। যেমন সে উইন্ডমিল বা বায়ুকলগুলোকে ইয়া বড় বড় দৈত্য মনে করে এবং সেগুলোকে আক্রমণ করে। ফলতঃ সে উইন্ডমিলের পাখনার আঘাতে মাটিতে কুপোকাত হয়ে পড়ে। কিন্তু তারপরও সে সম্বিত ফিরে পায় না। সে মনে করে সে কোন যাদুকরী শক্তি দ্বারা এ্যমবুশের শিকার হয়েছে। এক পযায়ে সে অলীক শত্রুর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাড়ি ফেরে, তার নাইটের পরিচয় ত্যাগ করে এবং শেষে প্রাণত্যাগ করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীও ডন কুহতের মতো এখন কল্পনার জগতে ভাসছে। তারা সাধারণ বিষয়কে “সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি” মনে করছে এবং তাকে আক্রমণ করছে। তারা গণতান্ত্রিক দল ইউপিডিএফকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করছে এবং তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। অথচ ইউপিডিএফ নিজেই রাষ্ট্রীয় ও ঠ্যাড়াড়ে সন্ত্রাসের নির্মম শিকার। গত ২৭ বছরে এই উভয় সন্ত্রাসের যুপকাষ্ঠে ইউপিডিএফের প্রায় ৪০০ নেতা কর্মী ও সমর্থক বলি হয়েছে। এই হলো পাহাড়ের ট্রাজেডি: যারা গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করতে চায়, তারা হয় “সন্ত্রাসী”, আর যারা সন্ত্রাস দিয়ে এই আন্দোলন দমন করে তারা হয় “দেশপ্রেমিক ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকারী।”

অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তব পরিস্থিতি হলো: এখানে কোন যু্দ্ধ পরিস্থিতি নেই, নেই সশস্ত্র সংগ্রাম বা তথাকথিত ইন্সার্জেন্সি। এখানে মাঝেমধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত হয় সেটা সত্য, তবে এই সংঘাততো সন্তু লারমাকে দিয়ে শাসকগোষ্ঠী নিজেরাই সৃষ্টি করেছে এবং তারাই তাকে দিয়ে সেই সংঘাতকে জিইয়ে রেখেছে। তারা যদি সত্যিই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ করতে চায়, তাহলে তো তাদের বশংবদ সন্তু লারমাকে নির্দেশ দিলে এক নিমেষেই সব ঠিক হয়ে যায়। পাহাড় তার শান্তির সুবাতাস ফিরে পায়।

অথচ তারা সেটা না করে কী করছে? তারা প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা খরচ করে অপারেশন ও টহল পরিচালনার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। তাদের ঘরবাড়ি, দোকান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালাচ্ছে। তল্লাশির নামে জিনিসপত্র ওলটপালট করে দিচ্ছে, টাকা পয়সা ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নিচ্ছে। নারীদের শ্লীলতাহানি করছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি করছে। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর শারীরিক নিযাতন চালাচ্ছে ও আটক করে জেলে পাঠাচ্ছে।

সেনারা অপারেশেনের সময় স্কুল ভবন দখল করছে, স্কুলের খেলার মাঠে সামরিক মহড়া দিচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ও স্কুলের শিক্ষা কাযক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। তারা বিহার দখল করছে ও বিহারের সম্পত্তি জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে বিহারের পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে এবং জনগণের ধর্মচর্চা ও ভিক্ষুদের ধ্যান সাধনায় বিঘ্ন ঘটছে। এসবই হচ্ছে সার্বভৌমত্ব ও সন্ত্রাস দমনের নামে।

বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার আছে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে আসলে কী করছে, কত টাকা কীভাবে খরচ করছে, কেন খরচ করছে তার জবাবদিহি চাওয়ার, তার হিসাব চাওয়ার। কারণ এই টাকা জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা। বাংলাদেশের জনগণ নিশ্চয়ই পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনাবাহিনীর কাছে লিজ দেয়নি যেখানে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। তারা যা বলবে তা সবাইকে বিশ্বাস করতে হবে।

কেবল সেনা অপারেশন নয়, গুইমারায় রামেসু বাজারে সেনা সেটলার হামলার পর খুনী ও হামলাকারীদের গ্রে্প্তার না করে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাশাসকরা সার্বভৌমত্বের ঢোল পিটিয়ে উল্টো পাহাড়ে সেনা ক্যাম্প বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে । এই সেনা অপারেশন ও ক্যাম্প বৃদ্ধির প্রস্তাবের উদ্দেশ্য কী? এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো: খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় হামলাকারী সেনা ও উগ্র সেটলারদের আড়াল ও রক্ষা করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, পাহাড়ি জনগণের ওপর দমনপীড়ন চালানো, যাতে তারা ভবিষ্যতে ধর্ষণ বা ভূমি বেদখলের মতো ঘটনা ঘটলে তার প্রতিবাদে আন্দোলন করার সাহস না পায়। তৃতীয় উদ্দেশ্য হলো, পাহাড়ে একমাত্র আন্দোলনকারী দল ইউপিডিএফকে ধ্বংস বা দুর্বল করা, যাতে পাহাড়ি জনগণ নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। কারণ সেনা শাসকগোষ্ঠী  জানে সঠিক নেতৃত্বদানকারী একটি পার্টি ছাড়া কোন সফল আন্দোলন পরিচালনা করা যায় না। চতুর্থত, সার্বভৌমত্ব রক্ষার দোহাই দিয়ে বিশেষ কায়েমী স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে অব্যাহত সেনা উপস্থিতির জন্য দেশ-বিদেশের জনগণের কাছে বৈধতা সৃষ্টি করা। মোট কথা, সেনা ক্যাম্প বৃদ্ধির প্রস্তাব ও সেনা অপারেশনের প্রকৃত উদ্দেশ্য আদৌ সার্বভৌমত্ব রক্ষা নয়, কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার কোন আশঙ্কা সৃষ্টি হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই এবং এই সত্য কথাটি পাহাড়ে নিয়োজিত সেনাশাসকগোষ্ঠী ঠিকই জানে।

নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হোক বা না হোক, পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনও সেনা ছাউনিতে ভরপুর। বলতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো বিশ্বের অন্যতম ব্যাপক সামরিকায়িত অঞ্চলগুলোর একটি। এখানে এক লক্ষের মতো সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এই বিশাল সামরিকায়ন বজায় রাখতে বাংলাদেশকে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়। অথচ তার হিসাবের কোন জবাবদিহিতা নেই। আর এসবই হচ্ছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে।

বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার আছে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে আসলে কী করছে, কত টাকা কীভাবে খরচ করছে, কেন খরচ করছে তার জবাবদিহি চাওয়ার, তার হিসাব চাওয়ার। কারণ এই টাকা জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা। বাংলাদেশের জনগণ নিশ্চয়ই পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনাবাহিনীর কাছে লিজ দেয়নি যেখানে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। তারা যা বলবে তা সবাইকে বিশ্বাস করতে হবে।

পাহাড়ে নিয়োজিত সেনাবাহিনী আর যে একটি কথা বলে সেটি হলো সন্ত্রাস দমন। কিন্তু এটাও একটি ভূয়া আওয়াজ। প্রকৃত সত্য হলো তারা নিজেরাই সন্ত্রাসী বাহিনী সৃষ্টি করে জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করছে। গত ২৭ বছর ধরে তারা সেটা করে আসছে। আর এ সময়ে তারা নিজেরাই সন্ত্রাসের প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। সত্যি বলতে কী, পাহাড়ে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর ভুল নীতি ও পদক্ষেপের কারণে আজ সেনাবাহিনী ও জনগণ মুখোমুখি, যেন তারা একে অপরের শত্রু। এটা আর চলতে দেয়া যায় না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচিত ডন কুইক্সোটীয় অভিযান বন্ধ করে বাস্তব জগতে ফিরে আসা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বীকৃত রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিক নয়, রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

(৬ নভেম্বর ২০২৫)



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments