""

‘পার্বত্য চুক্তি’র ২ যুগ : আগের কথা, পরের কথা

‘বেক গোজেই দিলা (সব ছাড় দিলেন)!’


রাজনৈতিক ভাষ্যকার

(১০ ডিসেম্বর ২০২১)


 
(১)

‘পার্বত্য চুক্তি’র দুই যুগপূর্তির (২০২১) প্রাক্কালে গত ৩০ ও ২৬ নভেম্বর রাঙ্গামাটির বন্দুকভাঙা ইউনিয়নে কিজিঙ আদামে জেএসএস (সন্তু)-এর এক কর্মী খুন এবং বামে ত্রিপুরাছড়ায় সাধারণ গ্রামবাসীর ওপর সেনা ও তাদের মদদপুষ্ট সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের হামলা-মারধর-লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পর পর এ দু’টি মর্মান্তিক ঘটনায় জেএসএস-এর চুক্তির দুই যুগপূর্তি উৎযাপনের অনুষ্ঠান আয়োজন ও প্রস্তুতিতে প্রভাব পড়ার কথা, ম্লান হওয়ার কথা। কিন্তু জনসংহতি সমিতি যথারীতি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে তাদের গৃহীত কর্মসূচি সম্পন্ন করেছে। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, ২ ডিসেম্বর ২০২১ দুই যুগপূর্তি উপলক্ষে প্রচারিত তাদের বিবৃতি-লিফলেটসমূহে দলীয় কর্মী শহীদ হওয়ার এ মর্মান্তিক ঘটনাটি স্থান পায় নি। জেএসএস এ ঘটনাকে গতানুগতিক ও সাধারণ ব্যাপার হিসেবে নিয়েছে কিনা প্রশ্ন জাগে।

(২)

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত ‘পার্বত্য চুক্তি’ হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে বড় সাফল্য ও রাজনৈতিক কৃতিত্ব, যার কারণে প্রতি বছর সেনাবাহিনী ও জেলা পরিষদ মহা সমারোহে দিবসটি পালনে তৎপর হয়। সরকারি উদ্যোগে আনন্দ র‌্যালি, কনসার্ট-ব্যান্ড শো, বিনোদন জগতের তারকাদের দিয়ে জমকালো অনুষ্ঠান….ইত্যাদির আয়োজন হয়ে থাকে। পত্র-পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশসহ বিটিভি’র প্রাইম নিউজে শেখ হাসিনার হাতে সন্তু লারমার একে-৪৭ তুলে দেয়ার ভিডিও দৃশ্য দেখানো হতো।

বর্তমানে দেশে আওয়ামী লীগ এক নাগাড়ে এক যুগের অধিক ক্ষমতাসীন। দিবসটি সরকারি উদ্যোগে জাঁকজমকভাবে পালিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে এবার যেটি যুক্ত হয়েছে সেটি হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ থেকে এক গোপন সার্কুলারের (২৪ নভেম্বর ২০২১) মাধ্যমে পাঁচটি মন্ত্রণালয়কে (পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়)- “সরকারের সফলতা, পাহাড়িদের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরে উৎসবমুখর পরিবেশে” দিবসটি পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

চুক্তি দিবস উদযাপনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ থেকে এক গোপন সার্কুলার

সার্কুলারে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স-পার্বত্য মন্ত্রণালয়-আঞ্চলিক পরিষদসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবনসমূহে আলোকসজ্জা করার, প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনের এবং বাংলাদেশে বৈদেশিক কূটনৈতিক মিশনসমূহকে “শান্তিচুক্তি  বাস্তবায়নের ধারা উন্নয়নের চিত্র” তুলে ধরতে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাহাড়ি জনগণের সাথে প্রতারণাপূর্ণ দিবসকে আওয়ামী লীগ সরকার “বিজয় দিবস” “স্বাধীনতা দিবসের” মতো আনন্দ উল্লাস করতে নির্দেশ দিয়েছে।

সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক রাঙ্গামাটিতে সেনা রিজিয়ন কর্তৃক নৌকা বাইচ, খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি-বান্দরবানে জেলা পরিষদ ও প্রশাসনের নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়েছে। রাঙ্গামাটি বাঘাইহাট সেনা জোন জোরজবরদস্তি করে স্থানীয় লোকজনকে আনন্দ র‌্যালিতে অংশ নিতে বাধ্য করেছে। ‘পার্বত্য চুক্তির’ সাফল্য “পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে” এমন মিথ্যা চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টার ত্রুটি নেই! বস্তুতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও ‘অপারেশন উত্তরণ’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ‘১১দফা নির্দেশনা’ জারি রেখে জনগণের ওপর অব্যাহতভাবে দমন-পীড়ন চলছে, পাহাড়ি জনগণ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে, চুক্তির ধারা মতে প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্প পুনঃস্থাপিত হচ্ছে, শান্তি প্রতিষ্ঠা তো সুদূর পরাহত।

(৩)

অন্যদিকে ‘পার্বত্য চুক্তির’ ফলে প্রধানত প্রতারণার শিকার জেএসএস (সন্তু) আগে যত স্বপ্ন-আশা নিয়ে চুক্তি করে থাকুক না কেন, এখন আর তাদের নিকট দিবসটি কোনো অবস্থাতেই বিজয় আনন্দ উল্লাসের উপলক্ষ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। এটি এখন তারা ঘৃণা ক্ষোভের সাথে প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালন করতে পারে। আর আগে চুক্তি নিয়ে আশান্বিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণের নিকটও চুক্তিটি এখন এক দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে!

পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের অস্তিত্ব এখন গুরুতর হুমকির সম্মুখীন। ‘পার্বত্য চুক্তি’র ফলে জনগণের  যে অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে, এ পরিস্থিতিতে সকল দেশপ্রেমিক শক্তির উচিত রাজনৈতিক মত-পথের পার্থক্য ভুলে অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এভাবে সকল মত-পথের সংগঠন ও ব্যক্তিগণ ঐক্যজোট গঠনের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছে। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়যুক্ত হবার এটিই হচ্ছে অব্যর্থ পরীক্ষিত সূত্র।

তাই এ মুহূর্তে জেএসএস-এর উচিত সরকারি সাফল্যের মিথ্যা প্রচারণায় সহায়ক না হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত প্রকৃত দেশপ্রেমিক লড়াকু সংগঠন ও ব্যক্তিদের সাথে সমঝোতায় পৌঁছানো, সকলের সমন্বয়ে এমনভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা, যাতে জনগণের দাবি পূরণে সরকারকে বাধ্য করা যায়।

(৪)

যেহেতু এ বছর পার্বত্য চুক্তির দুই যুগপূর্তির বছর, কাজেই এবার জেএসএস-এর কর্মসূচির প্রতি রাজনীতি সচেতন মহলের বিশেষ কৌতুহল থাকা স্বাভাবিক। বরাবরের মতো এবারও দেখা গেছে, চুক্তির দুই যুগ পূর্তিতে ক্ষোভ ও হতাশা নিয়ে জেএসএস তার নিজস্ব প্রকাশনার পাশাপাশি জাতীয় পত্র-পত্রিকায় সাক্ষাৎকার, মতামত-নিবন্ধ প্রকাশসহ নির্দিষ্ট কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী নিয়ে যে ধরণের গতানুগতিক আলোচনা করেছে, তাতে এমন কিছু নেই যা সরকারকে নাড়াতে পারে।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল হতে একটানা ক্ষমতায় থেকেও যেহেতু চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না, প্রবল চাপ প্রয়োগ করতে না পারলে ভবিষ্যতে করবে এমনটা আশা করাও বোকামি। আওয়ামী লীগ সরকার জেএসএস তথা পাহাড়িদের সাথে যে প্রতারণা করেছে, তাতে সন্দেহ রাখার কোনো সুযোগ নেই আর। এ প্রসঙ্গে এক সময়কার রাঙ্গামাটির এসপি হুমায়ুন কবীরের পার্বত্য চুক্তিকে মুলার সাথে তুলনা করার কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি পরিহাসের ছলে চুক্তিকে ‘মুলা’ বলে চুক্তির ধারাসমূহ বাস্তবায়নের আশা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। (প্রথম আলো ১৮ জুন ২০০৩)।

কাজেই এটা সবার নিকট স্পষ্ট যে, ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল জেএসএস চুক্তির “৭২টি ধারার” বাস্তবায়ন-অবাস্তবায়নের তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত বিবরণ সরকারের নিকট হস্তান্তর করলেও তা সরকার আমলে নেবে না। তাছাড়া ২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল হাইকোর্ট আঞ্চলিক পরিষদ ব্যবস্থাটিকে বাতিল করার কারণে সাংবিধানিক গ্যারান্টি না থাকায় যে কোনো সময় সরকার চুক্তিটি বাতিল করে দিতে পারে। এমন দুর্বলতা নিয়েও জেএসএস চুক্তি নিয়ে দেন দরবার করছে।

অসৎ ব্যবসায়ীর মতো আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার ৪৮টি বাস্তবায়ন করেছে বলে দাবি করছে, আর জেএসএস বলছে ২৫টি। এভাবে পরষ্পর বিরোধী বক্তব্য ও পরিসংখ্যান উপস্থাপিত হয়েছে, যা সাধারণের বোধগম্য নয়, তারা দেখতে চায় ফল! যদি সরকারের ভাষ্যকেও সত্য বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলেও প্রশ্ন এসে যায় ৭২টি ধারার ৪৮টি বাস্তবায়ন করতে যদি ২৪ বছর লেগে যায়, বাকী ধারাসমূহ অর্থাৎ চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতে কত বছর লাগবে! ততদিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমিতি ও পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ সামগ্রিক অবস্থা এমনভাবে পরিবর্তিত হবে, তখন চাইলেও সরকারের পক্ষে কোনোভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

আওয়ামী লীগ সরকার শুধু যে পাহাড়িদের সাথে প্রতারণা করেছে এমন নয়, এখন গোটা দেশ পরিচালনা করছে মিথ্যাচার, প্রতারণা ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে। নৈশভোট করেও তারা এমন আচরণ ও ভাব ভঙ্গী করে, যেন তারা ভূমিধ্বস ভোটে বিজয়ী প্রবল জনপ্রিয় কেউ। মোটকথা তৃণমূলের সাধারণ মানুষজনের মুখেও নাটক অভিনয়ের মাধ্যমে সরকারের দেশ চালানোর কথা অহরহ শোনা যায়।

সোশাল মিডিয়ায়ও এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়। ইউটিউব চ্যানেল খুললেই দেখা যায় সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, শিক্ষক বুদ্ধিজীবীসহ ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন ও মিথ্যাচারের বয়ান। তারা দেশছাড়া হয়ে শেখ হাসিনার দুর্নীতি আর দুঃশাসনের ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রামাণ্য সহকারে উপস্থাপন করে চলেছেন। শুধু প্রচারণা আর বক্তব্য দিয়ে হাসিনা সরকারকে উৎখাত করা যাবে না, সেটাও তারা বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিয়ে জনগণকে আন্দোলনের আহ্বান জানাচ্ছেন।

দুঃখজনক হলেও বারে বারে দেখা যায়, জেএসএস নেতৃত্ব সরকারের সমালোচনা করেন, চুক্তির ব্যাপারে প্রতারণার অভিযোগ আনেন, বিভিন্ন সংস্থায় ধর্ণা দেন, “কঠোর কর্মসূচি” “পুরানো কর্মসূচি”তে ফিরে যাবার হুমকি দেন। অথচ চুক্তির বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই যথারীতি আঞ্চলিক পরিষদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে অফিস করেন!!!! এভাবে চললে সরকার কোনো দিনই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না।

(৫)

এটা মনে রাখা দরকার, পার্বত্যবাসীদের প্রতি দয়াপরবশত নয়, জনগণের আন্দোলনের ফলে শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের পথে অগ্রসর হতে বাধ্য হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে পাহাড়ে সংগঠিত হয়েছে অসামান্য আত্মত্যাগের দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম। ১৯৭২ সালে জেএসএস গঠিত হবার মধ্য দিয়ে এ সংগ্রাম শুরু হলেও ১৯৮৯ সাল হতে এ লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছে পিসিপি-পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ। ১৯৯২ সালের ১০ আগস্ট জেএসএস এক তরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার পর থেকে বড় ধরণের কোনো আন্দোলন করেনি। সে সময় মূলত ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রিত শরণার্থী ইস্যুটি সামনে রেখে জেএসএস’কে সরকারের সাথে দর কষাকষি করতে দেখা যায়। অন্যদিকে একই সময়ে দেশের অভ্যন্তরে পিসিপি তথা তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন প্রতিবাদ সংগ্রামের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তার ধারাবাহিকতায় শাসকগোষ্ঠী সংলাপে উদ্যোগী হয় এবং পরবর্তীতে ‘পার্বত্য চুক্তি’ সম্পাদিত হয়।

এটা বলা মোটেও অত্যুক্তি হবে না যে, জেএসএস এককভাবে আন্দোলনের ((১৯৭২-১৯৮৯) মাধ্যমে ১৭ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে দেশ-বিদেশে যতটা প্রচার ও সমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছে, পিসিপি আবির্ভাবের পর নব্বইয়ের দশকে ছাত্র-গণজাগরণের (১৯৮৯-১৯৯৭) মাধ্যমে ৮ বছরে তা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং আন্দোলন প্রকৃত গণভিত্তি ও শক্তি লাভ করে জোরদার হয়। মূলত তার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পথ উন্মোচিত হয়। 

(৬)

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়সহ সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের একটি সাধারণ ধারণা যে, আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের প্রতি তুলনামূলকভাবে সহানুভূতিশীল দল। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে দূর্গাপূজায় মণ্ডপে কোরান প্রাপ্তির ঘটনায় আওয়ামী লীগের প্রতি সবচে’ বেশি অনুরক্ত বলে কথিত হিন্দু সম্প্রদায়েরও সে ভুল ভাঙে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এবং জেএসএসও এ ধারণার বাইরে যেতে পারেনি। জেএসএস আওয়ামী লীগকে “জাতীয় বুর্জোয়া দল” ও “সংখ্যালঘুদের প্রতি সবচে’ সহানুভূতিশীল”– এ ধরনের সিদ্ধান্ত টানার পরিণামে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর নাটকীয় দ্রুততার সাথে চুক্তিতে উপনীত হয়। এমনকী তারা ‘অলিখিত চুক্তি’ও করে। পরে যদিও সরকারের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, কোনো অলিখিত চুক্তি হয় নি (যুগান্তর ৩ ডিসেম্বর ২০০০ )। বৈঠকে চুক্তির মূল বিষয় বেশি ছাড় দিতে দেখে বিস্মিত হয়ে অংশগ্রহণকারী খোদ সরকারি পক্ষের প্রতিনিধি কল্প রঞ্জন চাকমা মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিলেন, ‘আঃ দ বেক গোজেই দিলা!’ অর্থাৎ সবকিছুই তো ছাড় দিয়ে ফেললেন! জেএসএস তাদের মূল দাবিনামা একের পর এক ছাড় দিতে থাকলে, রূপায়ন দেওয়ান এক পর্যায়ে সন্তু লারমার কাছ থেকে কলম কেড়ে নিয়ে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘মাম, উইয়ে এ্যাবল। মঞ্জাই ঝারৎ পুজি যেই, ন দিবং আর!’ অর্থাৎ মামা, অনেক হয়েছে। প্রয়োজনে বন-জঙ্গলে পঁচে যাবো, তবু আর ছাড় নয়!’ ‘পার্বত্য চুক্তি’ সম্পাদনের ক্ষেত্রে জেএসএস-এর দুর্বলতা সম্পর্কে ধারণা পেতে এ দু’টি উক্তিই যথেষ্ট।

চুক্তি স্বাক্ষরের আড়াই মাস না পেরোতেই জেএসএস অস্ত্র সমর্পণ শুরু করে। চার দফায় অস্ত্র সমর্পণ সম্পন্ন করে (১০, ১৬, ২২ ফেব্রুয়ারি ও ৫ মার্চ ১৯৯৮) সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী ভেঙে দেয়া হয়। এতে করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি বা দাবি আদায়ের আর কোনো রক্ষাকবচ বাকি রইল না। এত বড় জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ছিলেন অন্ধকারে, এমনকী খোদ জেএসএস-এর কেন্দ্রীয় নেতারাও বিষয়টি ভালভাবে অবহিত ছিলেন না। চুক্তি নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হলে সুধাসিন্ধু খীসা আক্ষেপ করে তা প্রকাশ করেছিলেন।

‘পার্বত্য চুক্তি কাগুজে চুক্তিতে পরিণত হয়েছে।’ (মুক্তকণ্ঠ ৯ এপ্রিল ২০০০)। ‘পার্বত্য চুক্তির নামে অস্ত্র গোলাবারুদ জমা নিয়ে সরকার আমাদের নিরস্ত্র করছে। সরকার চুক্তিকে পদদলিত করে জুম্ম জাতির সাথে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’ (আজকের কাগজ ২৯ ডিসে. ২০০১)–ইত্যাদি অভিযোগ করে সন্তু লারমা যত কথাই বলুন,  এই করুণ মর্মান্তিক পরিণতির মূল কারণ নিহিত রয়েছে জনগণের প্রতি জেএসএস-এর আস্থাহীনতা আর শাসকগোষ্ঠীর প্রতি অতিরিক্ত আস্থা। শত্রু-মিত্র গুলিয়ে ফেলার এ পরিণতি কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা জেএসএস-এর বর্তমান অবস্থাই জানান দেয়। “আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক, ‘বিশেষ মহলই’ নানা ষড়যন্ত্র করে চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে”– এ ধরনের তোষামুদে কথাবার্তায়ও তেমন সুবিধে হয়নি, এটাও আজ প্রমাণিত।

মনে রাখতে হবে, ‘পার্বত্য চুক্তি’ সম্পাদনকারী আওয়ামী লীগ হচ্ছে শাসকগোষ্ঠীভুক্ত দলসমূহের মধ্যে সবচে’ ধুরন্ধর। চরিত্রগতভাবে দলটি হচ্ছে ‘মুৎসুদ্ধি বুর্জোয়া’, বেঈমানি ও বিশ্বাসঘাতকতা হচ্ছে এদের বৈশিষ্ট্য।

আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের প্রতি সবচে’ সহানুভূতিশীল দল, এ কথা যে সত্য নয় সেটি সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লার দূর্গাপূজার ঘটনায় (১৩ অক্টোবর ২০২১) আরও স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রারম্ভে মুজিবের আমলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সূত্রপাত ঘটে। তিনি পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যেতে নির্দেশ দেন, সাংবিধানিক অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানান। মুজিবই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পাহাড়িদের উৎখাত করার হুমকি দিয়েছিলেন। পরে ফৌজি শাসকরা তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হবার পর পাহাড়ে এবং সমতলে সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা, লুটপাট হয়েছে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলীই তার প্রমাণ। হিন্দু সম্প্রদায়ও মুজিবের সময়ে নিগৃহীত হয়।

‘পার্বত্য চুক্তি’ সম্পাদনের আগে থেকেই জেএসএস আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রতারিত হয়ে আসছিল, এ দিকটি আলোচনা হতে দেখা যায় না। ‘৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেএসএস আওয়ামী লীগের সাথে এই মর্মে সমঝোতায় উপনীত হয় যে, জেএসএস নিজ পছন্দ মতো প্রার্থী দেবে আর আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় টিকিট দেবে। কিন্তু দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ কথা রাখেনি। তারা নিজ দলীয় প্রার্থী দিয়েই নির্বাচন করে। আওয়ামী লীগের প্রতি জেএসএস-এর অতি বিশ্বাস ও নির্ভরশীল হয়ে পড়া ছিল অপরিণামদর্শী ও আত্মঘাতি। ‘অলিখিত চুক্তি’ অনুযায়ী উভয়ের বোঝাপড়া হয় যে, আঞ্চলিক পরিষদের বাঙালি (পুরোনবস্তি) সদস্যদের জেএসএস মনোনয়ন দেবে, আওয়ামী লীগ অনুমোদন করবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ কথার বরখেলাপ করেছে। দেখা যায়, চুক্তির আগে ও পরে কোনো সময়ই আওয়ামী লীগ কথা রাখেনি। চুক্তির অব্যবহিত পরেই আঞ্চলিক পরিষদের বাঙালি (পুরোনবস্তি) সদস্য মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে জেএসএস পিছু হটে ১৯৯৯ সালের ২৭ মে আঞ্চলিক পরিষদের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। তারপর থেকে জেএসএস কোনো দাবিতে আর অটল থাকতে পারেনি এবং আজ অবধি সরকারের বিরুদ্ধে তেমন কোনো আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারছে না।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ আর বিএনপি–যে দলই হোক, যে কোনো সমঝোতা ও চুক্তিতে উপনীত হতে সতর্কতা প্রয়োজন। এ বিষয়টি সংলাপ চলাকালে তখনকার তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন (পিসিপি-পিজিপি-এইচডব্লিউএফ)-এর নেতৃত্ব রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে জেএসএস-কে জানিয়েছিল। তিন গণতান্ত্রিক সংগঠনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণের বিপরীতে জেএসএস নিজ অভিমতের সপক্ষে কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সে সময় দেয় নি, পরেও আর কোনো সময় সে ব্যাপারে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায় নি। ‘আওয়ামী লীগ জাতীয় ‍বুর্জোয়া দল’ –জেএসএস এ সিদ্ধান্তে অনড় অবস্থানে থেকে তাদের বাইরে সে সময় যারা রাজপথের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে, তাদেরকে “রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী” বলে অপবাদ দেয় । লড়াই সংগ্রামে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে পতিত জনগণকে অপবাদ দেয়া হয় “আন্দোলন বিমুখ” ও ‘অকৃতজ্ঞ জাতি’ বলে।

 ‘জঙ্গী আন্দোলন করে স্বায়ত্তশাসন আদায় হয় না’ (১৫ জুন ১৯৯৫ ধুধুকছড়া)–সন্তু লারমার এমন সবক দানের ফলে মুক্তিকামী জনতার মধ্যে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তার কণ্ঠে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়ে সে সময়ে সমাজে প্রবল বিতর্ক ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয়।

অন্যদিকে বাইরের অর্থাৎ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুবিধাবাদী ধারাটি এমন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, তারা রাতারাতি ভোল পাল্টিয়ে একনিষ্ঠ সমর্থক সেজে জেএসএস-এ ঢুকে পড়ে। পিসিপি’র ৪র্থ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে (পলোগ্রাউন্ড চট্টগ্রাম, ১৩-১৫জুন ১৯৯৪) ছাত্রসমাজ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ধারাটি জেএসএস-এর ধ্বজাধারী হয়ে মাঠে নামলে ছাত্র আন্দোলনে এক কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়। পরিণতিতে ঘটে বহু দুঃখজনক ঘটনা, যার জের এখনও চলছে। এর রাশ টেনে যত দ্রুত সম্ভব ছাত্রসমাজ তথা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়, আন্দোলন সংগ্রামের পক্ষে ততই মঙ্গল।

(৭)

পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সমগ্র দেশে এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর মিলনায়তনে ২ ডিসেম্বর ‘পার্বত্য চুক্তি’র দুই যুগপূর্তি উপলক্ষে জেএসএস ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এক সভার আয়োজন করে। উক্ত সভায় সন্তু লারমা ইউপিডিএফ-এর ব্যাপারে যে ভাষা ও ভঙ্গীতে কথা বলেছেন, তাতে দু’দলের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে চলমান সমঝোতায় বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এবং সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে যে ন্যুনতম জাতীয় ঐক্য সংহতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তা বিনষ্ট করে আবার বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিনি “সেনাবাহিনী, পুলিশ, জেলা-উপজেলা লেভেলের স্থানীয় আমলাবাহিনী, চুক্তি বিরোধী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র একটি অংশ ইউপিডিএফ’কে মদদ দিয়েছে” বলে যারপরনাই মিথ্যাচার করেছেন, মুক্তিপণ, চাঁদাবাজি ও ৮৮ জন জেএসএস সদস্য খুনের অভিযোগ করেছেন। তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন, আকাশের দিকে থু থু ফেললে তা নিজের গায়ে এসে পড়ে।

সভায় প্রদত্ত তার বক্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি ‘মুখ্য শত্রু ও গৌণ শত্রু’ গুলিয়ে ফেলেছেন। অতীতের ভুলের দুঃখজনক পুনরাবৃত্তি করে তিনি নিজের ছায়ার বিরুদ্ধেই গোদা ঘুরিয়েছেন।

যে সময় তিনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ইউপিডিএফ’-এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করছিলেন, পরিহাসের বিষয় রাঙ্গামাটি থেকে বিতাড়িত তার কর্মীবাহিনীর একাংশ সে সময় ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়ে। সন্তু লারমার বক্তব্য শুনলে তারা বিব্রত হবেন, তাতে সন্দেহ নেই। তার চিরাচরিত দ্বিমুখী আচরণ-কথাবার্তা নিয়েও মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বহু কথা উঠবে, যা সুখকর হবে না। তিনি যদি নিজ ভ্রান্তনীতি থেকে সরে আসতে আগ্রহী না হন, গোঁয়ার্তুমি বজায় রাখেন, তাহলে পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের নিরসন হবে কীভাবে! তাতে লাভবান হবে শাসকগোষ্ঠীই।

সরকার ও জনসংহতি সমিতির তৃতীয় বৈঠকের পূর্বে ১০ মার্চ ১৯৯৭ সালে তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন (পিসিপি-পিজিপি-এইচডব্লিউএফ) পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন উত্থাপন করে। সন্তু লারমা ভাল করে জানেন ‘পার্বত্য চুক্তি’ স্বাক্ষরের আট মাস আগে ২৫-২৭ মার্চ ১৯৯৭ সালে তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন বিশেষ সম্মেলনে সাত দফা গ্রহণ করে। সে সম্মেলনে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত না হলে আবার আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়, সরকারের সাথে জেএসএস-এর সংলাপের সাফল্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। তারই যৌক্তিক পরিণতিতে গৃহীত সাত দফার ভিত্তিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

পার্টি গঠনের পূর্ব থেকে তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন ছিল শাসকগোষ্ঠীর নীলনক্সার বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরীর মতো সজাগ, জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ইউপিডিএফ রাজনৈতিক দল হিসেবে গঠিত হলে এ সংগ্রাম আরও সুসংগঠিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে ইউপিডিএফ আপোষহীন ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সে কারণে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ যে সরকারই দেশে ক্ষমতাসীন হয়, তারা ইউপিডিএফ-কে মূল শত্রু বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে স্টিম রোলার চালায়। চুক্তি পরবর্তী সময় থেকে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা-হুলিয়া দিয়ে ইউপিডিএফ-এর নেতা-কর্মী, সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীদের হয়রানি ধরপাকড় শুরু হয়। বর্তমানে তা আরও বহু গুণ বেড়েছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, মামলা-হুলিয়া ইউপিডিএফ নেতা-কর্মীদের নামে বেশি, কারাগারেও তারা সর্বাধিক সংখ্যায় দুঃসহ দিন কাটাচ্ছে।

এখানে মনে করিয়ে দেয়া আবশ্যক যে, ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম খাগড়াছড়ি সফর কালে দালাল পরিবেষ্টিত হয়ে সভামঞ্চে গেলে জুতা স্যান্ডেল উঁচিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে তিন সংগঠনের কর্মীবাহিনী। তার আমলেই তিন সংগঠন দমন করতে গঠিত হয় কুখ্যাত মুখোশবাহিনী। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শান্তিবাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশী সাংবাদিক কূটনৈতিকদের উপস্থিতিতে তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ‘No Full Autonomy, No Rest’ পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ব্যানার প্রদর্শন করে, যা আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে সারা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে। এ কর্মীবাহিনী দিয়ে গঠিত ইউপিডিএফ’কে সন্তু লারমা ‘সরকারের মদদপুষ্ট’ বলে অভিযোগ আনেন কোন যুক্তিতে! মিথ্যা প্রচারণায় তিনি যেন গোয়েবেলসকেও হার মানাতে চান! সন্তু লারমা শত্রু-মিত্র গুলিয়ে ফেললেও শাসকগোষ্ঠী তা করার  মতো বোকা নয়। জেএসএস’কে বাগিয়ে নেয়ার পর শাসকগোষ্ঠী ইউপিডিএফকে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করে দমন-পীড়ন শুরু করে। দল হিসেবে গঠিত হবার আগেই তিন সংগঠনের ওপর সেনাবাহিনী ও জেএসএস যৌথ হামলা শুরু করে। ৪ এপ্রিল ১৯৯৮-এ সন্তু লারমা কুসুম প্রিয় চাকমা ও প্রদীপ লাল চাকমাকে অভয় দিয়ে খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে ডেকে পাঠান। তাদের বাগে আনতে ব্যর্থ হলে ফেরার পথে ভাইবোন ছড়ায় কুসুমপ্রিয় ও প্রদীপ লালকে দিয়ে শুরু হয় জেএসএস-এর অপহরণ ও হত্যার রাজনীতি। জেএসএস-এর হাতে এ পর্যন্ত ইউপিডিএফ-এর তিন শতাধিক নেতা-কর্মী খুন হয়।

‘পার্বত্য চুক্তি’র ত্রুটির কারণে ইউপিডিএফ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করলেও এটি বাস্তবায়নে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বরং চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা প্রমাণ দেবার জন্য সরকারকে আহ্বান জানায়। ইউপিডিএফ চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে সহায়তা দেবে মর্মে জেএসএস’কে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতেও আহ্বান জানিয়েছে।

এটা বাস্তব সত্য যে, উপলক্ষ বিশেষে সমর্থক শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে সভা-সেমিনারে আক্ষেপ-বিলাপ, অভিযোগ-অনুযোগ করে কেউ কোনো সময় অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। লড়াই সংগ্রাম করতে হলে প্রয়োজন লড়াকু কর্মী। ‘দুধের মাছি’ দিয়ে কখনও আন্দোলন সংগ্রাম হয় না। কোনো দরদী বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষী বা দলও চুক্তি বাস্তবায়ন করে দিতে পারবে না।

বর্তমান সময়ে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষাই এখন পাহাড়ি জনগণের নিকট প্রধান ও একমাত্র কর্তব্য হিসেবে উপস্থিত। অন্য সব মতভেদ ও তিক্ততা ভুলে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া পাহাড়িদের সম্মুখে অন্য কোন পথ নেই। ইউপিডিএফ ও জেএসএস উভয় দলে কম বেশি প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও সংগ্রামী কর্মী আছেন, মত-পথ ভিন্ন হলেও তারা নিপীড়িত জনগণের-ই অংশ, এটাই হচ্ছে বাস্তব। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অস্তিত্বের প্রধান হুমকি শাসকগোষ্ঠীই হচ্ছে উভয়ের প্রধান শত্রু! শাসকগোষ্ঠী আন্দোলনকারী শক্তির মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত উস্কে দিতে নীলনক্সা জারি রেখেছে, তাদের ফাঁদে পা দেয়ার পরিণতি হবে গুরুতর, যা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে ভাড়াটে সশস্ত্র সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে হামলা-ধরপাকড়-লুটপাটের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অসহনীয় পরিস্থিতি জারি রেখেছে করেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের ঐক্য সমঝোতা গড়ে তোলা হচ্ছে সবচে’ জরুরি কর্তব্য।#





0/Post a Comment/Comments