""

সংবিধানের বিতর্কিত ‘পঞ্চদশ সংশোধনী’ আইন পাসের ১১ বছর, চাপিয়ে দেয়া উগ্রবাঙালি জাতীয়তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার, সিএইচটিনিউজ
বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০২২

আজ ৩০ জুন ২০২২ সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাসের ১১ বছর পূর্ণ হলো। ২০১১ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে বসবাসরত বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিসমূহের ওপর উগ্রবাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে তড়িঘড়ি করে আইনটি সংসদে পাস করে। এতে ষষ্ঠ অনুচ্ছেদের ২-এ বলা হয়েছে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিতি হইবেন”। যদিও কারা জনগণ আর কারা নাগরিক কিংবা জনগণ ও নাগরিকের মধ্যে পার্থক্য কী তার কোন ব্যাখ্যা সরকার দেয়নি।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কার্যত দেশে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খিয়াং, ম্রো, খুমি, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, সান্তাল, গারো, মুনিপুরি, ওঁরাওসহ দেশে বসবাসরত ৪৫টির অধিক জাতিসত্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে।

স্মর্তব্য যে, সংবিধানের এই পঞ্চদশ সংশোধনী আনয়নের জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। সংসদে আইনটি পাসের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করে ইউপিডিএফ সংবিধান সংশোধনী কমিটির কাছে ৬ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছিল। এছাড়া দেশে বসবাসরত জাতিসত্তাসমূহের পক্ষ থেকেও নানা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার এসবের কোন গুরুত্ব দেয়নি।

এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মুলত স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ এদেশে বসবাসরত বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিগুলোকে বাঙালি বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। যার কারণে ১৯৭২ সালের সংবিধানেও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে “বাঙালি” হিসেবে অভিহিত করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ এর বিরুদ্ধে সে সময় সংসদের ভেতরে ও বাইরে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। সে সময় সংসদে দাঁড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “মাননীয় স্পীকার, একজন বাঙালি কোনদিন চাকমা হতে পারে না, অনুরূপ একজন চাকমাও বাঙালি হতে পারে না’’ এই বলে তিনি প্রতিবাদ স্বরূপ সংসদ কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে তিনি ৭২-এ সংসদে গৃহিত সংবিধান আইনে স্বাক্ষর করেননি বলেও জানা যায়।

ইউপিডিএফভুক্ত ৮ গণসংগঠনের লালকার্ড প্রদর্শন। ফাইল ছবি

তবে পরবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রহিত করে তার পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্ত করে।

দীর্ঘ ৩৯ বছর পর ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ ’৭২ এর সংবিধান পুনপ্রবর্তনের কথা বলে পূনরায় সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্ত করে সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে সংসদে ‘পঞ্চদশ সংশোধনী আইন’ পাস করে। এতে দেখা গেল, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এর প্রতিবাদতো করেনইনি, বরং টেবিল চাপড়িয়ে এর সমর্থন দিয়েছেন। যে দলিলে তাদেরকে ও তাদের নিজ নিজ জাতির জনগণকে বাঙালি বলে হেয় ও অবজ্ঞা করা হয়েছে সে দলিলে তারা বিনা দ্বিধায় স্বাক্ষর করেছেন! এটা জাতির জন্য বড়ই লজ্জার।

উগ্রবাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেওয়া এই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবি জানিয়ে ইউপিডিএফের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ লাল পতাকা মিছিল, তিন জেলা জুড়ে সর্ববৃহ ও দীর্ঘ মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, লাল কার্ড প্রদর্শন--ইত্যাদি নানা কর্মসূচি পালন করেছে এবং এখনো এ দাবিতে সোচ্চার রয়েছে। কিন্তু ১১ বছরেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এই সংশোধনী বাতিল বা সংশোধন করেনি। উপরন্তু সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে আগের চাইতেও নিপীড়ন-নির্যাতনের মাত্রা আরো বৃদ্ধি করেছে।

বিতর্কিত এই পঞ্চদশ সংশোধনী বহাল রাখতে পারলে সরকার ভবিষ্যতে দলিল-দস্তাবেজসহ সবখানে ভিন্ন ভাষাভাষি ও ধর্মীয় জাতিসত্তাগুলোকে বাঙালি পরিচয় দিতে জোরজবরদস্তি করবে না তার কোন নিশ্চিয়তা নেই।

তাই সংবিধানের এই বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সকল জাতিসত্তাসমূহকে চাপিয়ে দেওয়া উগ্রবাঙালি জাতীয়তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।

এদিকে, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাসের ১১ বছর উপলক্ষে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন যৌথভাবে একটি পোস্টার প্রকাশ করেছে। 





 





0/Post a Comment/Comments