""

মাটিরাঙ্গার তাইন্দংয়ে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার ৯ বছর

সিএইচটি নিউজ ডেস্ক
বুধবার, ৩ আগস্ট ২০২২

ফাইল ছবি


আজ ৩ আগস্ট ২০২২ খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দংয়ে সেটলার বাঙালি কর্তৃক পাহাড়ি গ্রামে হামলার ৯ বছর পূর্ণ হল। ২০১৩ সালের এই দিনে কামাল হোসেন নামে এক মোটর সাইকেল চালককে অপহরণের নাটক সাজিয়ে সেটলাররা সংঘবদ্ধভাবে পাহাড়িদের কয়েকটি গ্রামে হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও ব্যাপক লুটপাট চালায়। এতে পাহাড়িদের ৩৪টি বাড়ি, ১টি বৌদ্ধ বিহারের দেশনাঘর ও ১টি দোকানঘর সম্পূর্ণ ভষ্মীভূত হয়। চার শতাধিক বাড়িতে চালানো হয় ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট। সেটলারদের হামলার ভয়ে ওইদিন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামসহ আশে-পাশের ১২টি গ্রামের তিন সহস্রাধিক পাহাড়ি ভারতের সীমান্তে (নো ম্যানস ল্যাণ্ডে), পানছড়ি উপজেলায় ও জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। 

সেদিন সেটলারদের হামলায় কমপক্ষে ১২ জন পাহাড়ি মারধরের শিকার হয়ে আহত হন।

বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে বগা পাড়া, সর্বেশ্বর পাড়া, মনোদাস পাড়া, বান্দরশিং পাড়া, তালুকদার পাড়া ও হেডম্যান পাড়া।

সেদিন দুপুর ১২টার দিকে মোহাম্মদ কামাল হোসেন নামে একজন মোটর চালককে অপহরণ করা হয়েছে বলে একটি ভুয়া খবর রটানো হয়। এই খবরটি দ্রুত স্থানীয় সেটলার বাঙালীদের মধ্যে ছড়ানো হয়। খবরটি শুনে সেটলার বাঙালিরা উত্তেজিত হয়ে উঠে। এরপর খবরটি গ্রামের মসজিদগুলো হতে মাইকে প্রচার করা হয় এবং তাদের সমবেত হওয়ার আহ্বান করা হয়।

এদিকে অপহৃত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা এবং উদ্ধার করার জন্য পাহাড়ি গ্রামগুলির নেতাদের স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে যেতে বলা হয়। অনেক সেটলার বাঙালিও বিজিবি ক্যাম্পে যায়। এরপর বিজিবি সদস্য, পুলিশ, সেটলার বাঙালি ও পাহাড়িরা মিলে অপহৃত কামালকে খোঁজা শুরু করেন। কিন্তু অনেক্ষণ খুঁজেও কামালকে পাওয়া যায়নি।

এর মধ্যে মসজিদের মাইক হতে একত্রিত হওয়ার আহ্বান শুনে শত শত সেটলার জমায়েত হয়। এরপর তারা বিকাল আনুমানিক ৩টার দিকে দলবদ্ধভাবে চি কার “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি দিয়ে পাহাড়ি গ্রামগুলির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। 

প্রথমে সেটলাররা নিখোঁজ কামালকে খুঁজতে বিজিবি ক্যাম্পে যাওয়া পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের ওপর বিজিবি সদস্যদের উপস্থিতিতে মারধর শুরু করে। পরে সেটলাররা একের পর এক পাহাড়িদের গ্রামে হামলা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালাতে থাকে। এ সময়ও বিজিবি’র সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তারা হামলাকারী সেটলারদের নিবৃত্ত না করে উল্টো পাহাড়িদের ধাওয়া করার কাজে নিয়োজিত হয়।

এক পর্যায়ে পাহাড়িরা ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ভারতের সীমান্তের দিকে, অনেকে পানছড়ির দিকে ও অনেকে আশে-পাশের জঙ্গলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যারা পালানোর সময় পায়নি তাদেরকে মেরে রক্তাক্ত করা হয়, পাহাড়ি নেতাদের দা দিয়ে জখম করা হয়।

সেটলারদের হামলার ভয়ে লোকজন পালিয়ে যাচ্ছে। ফাইল ছবি


সেদিন এ বর্বর হামলায় হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা না ঘটলেও হামলার ভয়ে পালাতে গিয়ে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২ মাস বয়সী শিশু আশামনি চাকমা খাগড়াছড়ি হাসপাতালে চিকি
সাধীন অবস্থায় মারা যায়।

হামলার পর রাতে কথিত অপহরণ ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন হয়। মুলত পরিকল্পিতভাবে মো. কামাল হোসেনকে লুকিয়ে রেখে অপহরণ নাটক সাজিয়ে এই হামলা চালানো হয়েছিল। হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়িদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের জায়গা-জমি বেদখল করা।

পরে পুলিশ মো. কামাল হোসেনকে আটক করে ঘটনার আসল কারণ জানতে পারে। এরপর দায়েরকৃত মামলার ভিত্তিতে হামলার মূল পরিকল্পনাকারীসহ বেশ কয়েকজন সেটলারকে আটক করা হয়। কিন্তু তাদের দৃষ্টান্তমুলক কোন শাস্তি হয়নি। আটকের কয়েকদিনের মধ্যে তারা জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে যান। ফলে তাইন্দং-তবলছড়ি এলাকার পাহাড়িদের এখনো নানা আশঙ্কা নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে।

শুধু তাইন্দং হামলা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের উপর এ যাবত যতগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে তার কোন ঘটনারই দৃষ্টান্তমূলক কোন বিচার হয়নি। শাসকগোষ্ঠী তথা সরকার ও তার প্রশাসন বরাবরই সেটলারদের পক্ষাবলম্বন করার ফলে সেটলাররা বীরদর্পে এ ধরনের হামলা চালাতে সাহস পেয়ে থাকে।





0/Post a Comment/Comments