""

মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিষোদগার : জল ঘোলা করে তৃষ্ণা নিবারণ ও মাছ শিকারের নেপথ্য রাজনীতি

(কালের সাক্ষী)

১২ আগস্ট ২০২২

‘মৃত ব্যক্তির সাথে ঝগড়া করতে নেই’ বলে কথা প্রচলিত আছে। কোন সমাজেই মৃতকে নিয়ে মিথ্যাচার মেনে নেয়া হয় না। অপবাদ দিয়ে মৃতকে নিয়ে কল্প-কাহিনী ফাঁদা কোন সুস্থ রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সভ্য সমাজে তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ঘৃণ্য।

১২ জুলাই ২০২২ দীঘিনালার দুর্গম নাড়েইছড়ির ধনপাদা বটতুলিপাড়ায় (বুদ্ধধন কার্বারিপাড়া) নিহত জীবন ত্রিপুরা (২৬)-কে নিয়ে যেভাবে জঘন্য মিথ্যাচার ও বিষোদগার শুরু হয়েছে, তা যে কোন চিন্তাশীল বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন না করে পারে না। সহজ সরল পাহাড়িদের কেন এমন অধঃপতন হলো, একজন মৃতকে নিয়ে একটি দল পরিকল্পিতভাবে মিথ্যাচারে নামলো, সেটির পেছনের কারণ জানা ও বোঝা বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

তার আগে জানা দরকার শহীদ জীবন ত্রিপুরার পরিচয় ও তার মৃত্যুর কারণ। শহীদ জীবন ত্রিপুরা ইউপিডিএফ-এর স্থানীয় লেভেলের একজন রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠক, বাড়ি হচ্ছে রাঙ্গামাটির রাজস্থলীর বটতলীতে। তার পার্টি জীবনও বেশি দিনের নয়। দীঘিনালায় খৃস্টান ধর্ম প্রচারে নিযুক্ত থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালে সরাসরি ইউপিডিএফ’এ যোগ দেন এবং নাড়াইছড়িতে গণসংযোগ দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তার আগে খাগড়াছড়িতে ২০১৬ সালে ইউপিডিএফ কর্তৃক সংগঠিত ‘আলুটিলায় উন্নয়নের নামে পাহাড়িদের ৭০০ একর ভূমি বেদখলের প্রতিবাদ কর্মসূচি মিছিল ও সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৪-১৬ সাল পর্যন্ত খাগড়াছড়ি মিলনপুরস্থ গসপেল ফর এশিয়া মিশনারিতে ধর্মীয় তত্ত্ব শিক্ষাগ্রহণ করেন।

খুন হলেন যেভাবে : ১১ জুলাই দিবাগত মধ্য রাত তিন ঘটিকার (অফিশিয়ালি ১২ জুলাই) সময় সন্তুচক্রের সশস্ত্র জঙ্গীরা ধনপাদা বটতুলি গ্রামের উপেন্দ্র চাকমা টুক্কু বাপ (৭০) এর বাড়ীতে হানা দেয়, এটি ছিল পরিকল্পিত এবং ঘুমন্ত অবস্থায় তারা জীবন ত্রিপুরাকে ধরে ফেলে। সারারাত অবস্থানের পর পরদিন সকাল ১০ টার দিকে জীবন ত্রিপুরাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার সময় পাকুজ্জেছড়িতে মাথায় গুলি করে হত্যা করে। স্থানীয়রা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত, তারাই ঘটনার সাক্ষী।

এমন ঠাণ্ডামাথার হত্যাকাণ্ডকে বিজয় বিকাশ ত্রিপুরার ছদ্মনামে জেএসএস (সন্তু)-এর শীর্ষ নেতা “... উভয় পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গুলি বিনিময়ে নিহত” বলে চালিয়ে দিতে গল্প ফেঁদেছেন, যা আসলে কুখ্যাত জল্লাদবাহিনী র‌্যাব-এর ‘ক্রস ফায়ারে নিহত’ প্রেস নোটের নকল কপি। বিজয় বিকাশ ত্রিপুরা ছদ্মনামধারী জেএসএস শীর্ষ নেতা লিখেছেন, “পানছড়ি ও দীঘিনালায় .....একযোগে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এমন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থীর সামরিক কমান্ডার জীবন ত্রিপুরা নিহত হয়।

গাল-গল্প মিথ্যাচারেরও একটা সীমা থাকে, তাও তিনি ছাড়িয়ে গেছেন। হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করতে এরপর আরও লিখেছেন, “২০১০ সালের দিকে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা যখন রাঙ্গামাটির রাজস্থলীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, সে সময়ে রাজস্থলীতে জীবন ত্রিপুরা জনসংহতি সমিতির নেতা-কর্মীসহ চুক্তি পক্ষের বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল।

উপরে বর্ণিত জীবন ত্রিপুরার সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত দেখলে, আর তার ব্যাপারে আর বেশি বাক্য ব্যয়ের প্রয়োজন করে না। তিনি ইউপিডিএফ’এ যোগ দিয়েছেন ২০১৯ সালে। ৯ বছর আগের ২০১০ সালে সন্তুচক্র কথিত “রাজস্থলীতে জেএসএস কর্মী-সমর্থক হত্যাকাণ্ডের (?)” অপরাধী হিসেবে জীবন ত্রিপুরাকে দায়ী করা হয়েছে। এ গল্প তো কুখ্যাত র‌্যাব-এর ক্রস ‘ফায়ারে নিহত’ সরকারি প্রেস নোটকেও হার মানিয়েছে। কথিত সময়ে, কোথায় এবং কিভাবে শহীদ জীবন ত্রিপুরা জেএসএস কর্মী-সমর্থক হত্যা করলেন, নিহতদের নাম-ঠিকানা পরিচিতি-ই বা কী, এ ধরনের কোন তথ্য হাজির না করে মিথ্যাচার করা হয়েছে। এটা জীবন ত্রিপুরার হত্যাকে জায়েজ করার অত্যন্ত ঘৃণ্য নিন্দনীয় অপচেষ্টা। কথায় বলে, ‘দুর্জনের ছলের অভাব হয় না’। 

জেএসএস সন্তু গ্রুপের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হওয়া জীবন ত্রিপুরার মরদেহ। ফাইল ছবি


‘একটা মিথ্যা ঢাকতে দশটি মিথ্যার জন্ম হয়’। পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক যেভাবে মিথ্যাচার করে জেএসএস (সন্তু) ‘জল ঘোলা’ করছে, জীবন ত্রিপুরার হত্যাকাণ্ড হচ্ছে তার সাম্প্রতিক এক ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত মাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রামে এই ‘ঘোলাজল খাচ্ছে গাধা’, মাছ ধরছে ‘শিকারীরা’! তাতে বগল বাজিয়ে উল্লাস করছে সেনা গোয়েন্দাচক্র। পাহাড়ি জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব হয়ে পড়েছে হুমকির সম্মুখীন। অন্যদিকে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের, প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে সম্ভাবনাময় ছাত্র-যুবক। অতীতেও এ ঘৃণ্য নিষ্ঠুর খেলায় প্রাণহানি ঘটেছে, যার সংখ্যা তিন শতাধিক। যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে আগামিতে আরও প্রাণহানির আশঙ্কা প্রবল হয়েছে।

সাধারণ মানুষের কেন এত দুর্ভোগ এত প্রাণহানি ক্ষয়-ক্ষতি, তা বোঝার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনে বাঁক পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা দরকার। আগ্রহী অনুসন্ধিসু পাঠক এসব ঘটনা আর তথ্য মিলিয়ে দেখলে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যত গতি-প্রকৃতি সহজে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে নয়, সত্য অনুসন্ধানের স্বার্থে জাতীয় প্রয়োজনে এ তথ্য ও ঘটনাবলী সংক্ষেপে তুলে ধরা হচ্ছে।

১. আশির দশকে জিগির :

‘বেতার শিল্পী’ ও উচ্চ শিক্ষার্থীদের সমভিহারে সন্তু লারমার দলে যোগ দান

জেল থেকে ছাড়া (২২ জানুয়ারি ১৯৮০) পেয়ে সন্তু লারমা শীঘ্রই শান্তিবাহিনীতে যোগ দেবেন এমন ইঙ্গিত দিয়ে, আন্দোলন জোরদারের জিগির তোলা হয়। অথচ তথ্য অভিজ্ঞমহলের মতে, তিনি সরকারের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নেবেন এমন অঙ্গীকার করে মুক্তি লাভ করেছিলেন। একই সাথে মুক্তি লাভ করেছিলেন শান্তিবাহিনীর উর্ধ্বতন নেতা চাবাই মগ, পরে আততায়ীর হাতে নিহত। একেক জনকে একেক রকমের কথা বলে নিজের মতো সন্তু লারমা তপরতা শুরু করেন। কারামুক্ত চাবাই মগ সম্পর্কে সন্তু লারমা তার ঘনিষ্ঠদের কানে কানে ‘তারে বিশ্বাস ন যিও!’ (তাকে বিশ্বাস করো না!) ধারণা দেন, চাবাই ব্যাপারে বিষোদগারও করেন। সে সময় ভার্সিটিতে অধ্যয়নরত ছাত্রসহ অনেকের সাথে যোগাযোগ করেন, এমন ভাবভঙ্গী দেখান যেন শীঘ্রই কিছু একটা হবে!!! সরল বিশ্বাসে অনেকে তার কথাবার্তায় আস্থাও স্থাপন করে। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র অনুরূপ ‘একটা কিছু’ হবে এমন কথাও শুনিয়েছিলেন তিনি শিল্পীদের। তখনকার জেনারেশন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের’ ভূমিকা ভাল করেই জানত এবং গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠীর অনেকে তাতে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত ছিল।

‘বেতার শিল্পীর’ ভূমিকা পালনের উসাহ নিয়ে রাঙামাটির স্বনামধন্য এক শিল্পী সে সময় শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। কোন সময়ই আর সে কল্পিত ‘বেতার কেন্দ্র’ বাস্তবতার মুখ দেখে নি, দেখার কথাও নয়। জনসংহতি সমিতির সে ধরনের কিছু করার অবস্থা ছিল না, তারা সে রকম প্ল্যানও করেনি। সে আমলে প্রযুক্তি আজকের দিনের মতো উন্নত ছিল না। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নিয়োজিতদের উদ্দেশ্যে অনুপ্রেরণামূলক সঙ্গীত পরিবেশন দূরের কথা শোনা যায়, জেএসএস-এর “এক শীর্ষ নেতার” বাড়িতে ‘তামাক সাজিয়ে দেয়ার’ কাজে উক্ত শিল্পীর দিন অতিবাহিত হয়েছে। পরে এক সময় বিফলমনোরথে তিনি স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করেন। ‘পার্বত্য চুক্তি’র পর নতুন প্রজন্মের আরেক শিল্পীও দুর্দশায় পতিত হন, আন্দোলন জোরদারের আশায় চুক্তির সন্নিকটে অনেকের সাথে তিনিও শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।

আশির দশকে “আন্দোলন জোরদারের” উদ্দেশ্যে ভার্সিটির পাঠ গুটিয়ে কারামুক্ত সন্তু লারমার সাথে যারা শান্তিবাহিনীতে যোগ দিতে যান, ‘লাম্বা-বাদি’ দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে পরে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। সে দুঃখজনক কাহিনী আজকালকার দিনের শিক্ষার্থীদের জানার কথা নয়। “আন্দোলন জোরদারের” চাইতেও সে সময় সন্তু লারমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সংগঠনে নিজের প্রত্যাবর্তন ও পূর্ব পদবী (ফিল্ড কমান্ডার) লাভ নির্বিঘ্ন করা। উচ্চ শিক্ষার্থী ও ‘বেতার শিল্পী’ সমভিহারে দলভারি করে আন্ডারগ্রাউন্ডে যোগদান তার অবস্থান শক্ত করবে এটা ছিল হিসেব। তার এ দূরভিসন্ধির বলি হয়েছে সে আমলে ভার্সিটিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী আর শিল্পীরা। শান্তিবাহিনীতে দায়িত্ব নিয়েই তিনি ‘ফেণী মিশন’সহ বেশ কিছু পরিকল্পনা বাতিল করে দেন। সরকার-সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান বন্ধ করেন, যা তার মুক্তিলাভের শর্ত বাস্তবায়ন বলে অভিজ্ঞমহলের ধারণা। এ নিয়ে দলে বিতর্ক দেখা দেয় এবং পরে শান্তিবাহিনী ‘লাম্বা-বাদি’ ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। পরিণতিতে দলীয় প্রধান মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা, অস্ত্রগুরু অমৃত লাল চাকমা সহ বেশ ক’জন শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মী প্রাণ হারান।

২. ’৮৯-এ মানচিত্র বদল’, পরিস্থিতি বিরাট উলোট-পালট করার ধাপ্পাবাজি

ফৌজী শাসক এরশাদ সম্ভাব্য সকল রকম উপায়ে জেলা পরিষদ নির্বাচন (২৫ জুন ১৯৮৯) অনুষ্ঠিত করতে ছিল মরিয়া। অন্য দিকে শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে নির্বাচন বানচাল করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। সাধারণ জনগণ পড়ে যায় উভয় সংকটে। সে সময় জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়, পরিস্থিতি ওলোট-পালট হয়ে যাবে। এমন ধুয়ো তোলা হয়, প্রয়োজনে ‘মানচিত্র বদলে যাবে’ তবু নির্বাচন হতে দেয়া যাবে না!!! এমন প্রচারণায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে অনেকে বাস্তুভিটা ছেড়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থীর খাতায় নাম লেখায়। গ্রামের ছাত্র-যুবকদের অনেকে শান্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। নির্বাচনের দিন সেনাবাহিনী ভোটকেন্দ্রে নিতে আসবে এই ভয়ে লোকজন গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। ভোটকেন্দ্রের আশে-পাশের লোকজন যাদের পালানোর সুযোগ ছিল না, তাদেরকে সেনাবাহিনী ভোটকেন্দ্রে লাইন করিয়ে নির্বাচনের নাটক মঞ্চস্থ করে। এ দৃশ্য বিটিভি এবং পত্র-পত্রিকায় প্রচার করে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে সরকার ব্যাপক প্রচারণা চালায়।

অন্যদিকে ঘোষণা মতো ভোটকেন্দ্র উড়িয়ে দেয়া (রকেট হামলা করে), ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র দখল, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর হামলা-আটক... এমন কোন কিছুই শান্তিবাহিনী করতে সক্ষম হয়নি। তাদের ঘোষণা ও প্রচারণার সাথে বাস্তব কার্যকলাপের মিল না থাকায় তারা জনগণের বিরূপ সমালোচনা ও নিন্দার মুখে পড়ে। কার্যতঃ তারপর থেকে জেএসএস’এর ওপর জনগণের আস্থা শূণ্যের কোটায় নেমে যায়, রাজনৈতিকভাবে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

সরকারের জেলা পরিষদ নির্বাচন ব্যর্থ করে দিতে জেএসএস কৌশল হিসেবে ‘সামরিকভাবে বানচাল’ করবে বলে ‘ব্লাফ’ দিয়েছিল। সন্তু লারমার নিজ স্বীকারুক্তি অনুযায়ী রাজনীতিতে জনগণকে ‘ব্লাফ’ দিতে হয়। তার এ ধোঁকাবাজির শিকার হয়ে শত শত লোককে গৃহহারা সহায় সম্বলহীন অবস্থায় শরণার্থী শিবিরে মানবেতর দিন কাটাতে হয়েছে। সরকারের সাথে দর কষাকষি করতে তাদের তিনি তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেন।

৩. ’৯৭-এ ‘পার্বত্য চুক্তির’ দ্বারপ্রান্তে ‘চূড়ান্ত লড়াইয়ের’ প্রস্তুতি (?!?)

সরকারের সাথে আলোচনা ও বোঝাপড়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে আবারও জিগির তোলা হয় ‘চুক্তি’ না হলে চূড়ান্ত লড়াই শুরু হবে। প্রয়োজনে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে’ নামবে জেএসএস, অথচ তলেতলে সরকারের সাথে জেএসএস-এর সব কিছু বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ লক্ষ্য সামনে রেখে প্রচারণা জোরদার করা হয়, শান্তিবাহিনীতে ভর্তির হিড়িকও পড়ে যায়। এবারও অনেকে সরল বিশ্বাসে আবার অনেক ধান্দাবাজ সুযোগসন্ধানী ছাত্র-যুবক সব জেনে বুঝে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে শান্তিবাহিনীতে যুক্ত হয়। আশির দশকে উচ্চ শিক্ষার পাঠ গুটিয়ে যারা শান্তিবাহিনীতে যোগ দেয়, তাদের সাথে নব্য শান্তিবাহিনীর পার্থক্য আকাশ-পাতাল। সরকারের সাথে চুক্তি অত্যাসন্ন সেটা সবাই বুঝে যায়, পত্র-পত্রিকায়ও এ নিয়ে লেখালেখি হয়। এ পরিস্থিতিতে রাতারাতি ভোলচাল পাল্টিয়ে মুখচেনা ব্যক্তিরা জেএসএস-এর সমর্থক ও মুখপাত্র বনে যায়, তারা জোরেশোরে জেএসএস-এর প্রচারণা ফেরি করতে থাকে।

এখানে স্মর্তব্য যে, জেএসএস’এর আন্দোলন কোন পথে এগুবে সেটা ধুধুকছড়ায় ১৯৯৫ সালের ১৫ জুন স্পষ্ট হয়। এদিন সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশ্যে সন্তু লারমা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘জঙ্গী আন্দোলন করে পুলিশকে গুলতি মেরে স্বায়ত্তশাসন আদায় হয় না।’ সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য জেএসএস-এর কর্মী ভর্তিরও কোন প্রয়োজন ছিল না। নতুন করে ভর্তি ছিল স্রেফ মতলববাজি ও হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা আসলে চাইছিল বাইরের প্রতিবাদী ছাত্র-যুবসমাজকে মোকাবিলা করার জন্য নিজেদের গদি রক্ষার্থে একটি লাঠিয়াল বাহিনী। বাস্তবে সশস্ত্র পর্ব চুকিয়ে ফেলতে জেএসএস সব কিছু চূড়ান্ত করে ফেলেছিল। শান্তিবাহিনী কমান্ডারদের ডেকে ‘সামরিক ম্যানুয়েল’ জমা নিয়ে সে সব পুড়িয়েও ফেলা হয়। “এসবের” আর দরকার নেই বলে মাঠ পর্যায়ের কমান্ডারদের হাই কমান্ডের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। অথচ বাইরে গণসংযোগের সময় জেএসএস-এর পক্ষ থেকে “চূড়ান্ত লড়াই” চালানোর কথা বলে ছাত্র-যুবকদের শান্তিবাহিনীতে ভর্তির জোর আহ্বান জানানো হতে থাকে, উদ্দেশ্য ছিল এবারও দল ভারি করে উদ্দেশ্য হাসিল তথা প্রতিবাদী ছাত্র-যুবসমাজকে বিভক্ত ও দুর্বল করে ফেলা। এ ধরনের পাল্লায় পড়ে শান্তিবাহিনীতে যোগ দিতে সচিব চাকমা (বর্তমানে ইউপিডিএফ’এর কেন্দ্রীয় সদস্য) একটি টিম নিয়ে সীমান্তবর্তী পানছড়ি পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসেন। যোগ দেয়ার আগে ভিতরের খবর নিশ্চিত হওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হলে শান্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে কর্মরত সুনাম বাবু (হিরালাল দেওয়ান) তার আত্মীয় সম্পর্কীয় অভিলাষ চাকমাকে খবর পাঠান, “কী মত্তাককি! ইঙিল্ল্যা এবঙ!” অর্থা ‘কী জন্য মরতে আসবে! এবার চলে আসবো!’ সে কথা শোনার পর মি. সচিব চাকমা তার টিম নিয়ে আর সেদিকে পা বাড়াননি।

যাদের এভাবে ভেতর থেকে নিশ্চিত খবর দেয়ার মতো নিকটজন কেউ নেই, অথবা যারা পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেনি, শান্তিবাহিনীর ভেলকিবাজিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তারাই “চূড়ান্ত লড়াইয়ে” নামতে শান্তিবাহিনীতে যুক্ত হয়, তারা ধাপ্পাবাজির শিকার এবং বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, অনেকে সবকিছু জেনে হিসেব কষেই ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল।’৯৭-এ যোগ দিয়ে ‘৯৮’এর ১০ ফেব্রুয়ারিতে বেরিয়ে আসে এ হাইব্রিড শান্তিবাহিনী। শুধু নাম লিখিয়ে তারা হাতিয়ে নেয় পঞ্চাশ হাজার টাকা, সরকারি রেশন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা, সেটাই ছিল তাদের সংগঠনে যোগ দেয়ার লক্ষ্য। চুক্তির পরেও যারা জেএসএস ও এর অঙ্গসংগঠনসমূহে যুক্ত হয়েছে, তারা আন্দোলনের মহান উদ্দেশ্য নিয়ে যোগ দেয়নি (ব্যতিক্রম থাকলেও তা খুবই সামান্য) , তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এরা আন্দোলনের কর্মী নয়, ভিতরের সশস্ত্র লড়াই বা বাইরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোন অভিজ্ঞতা তাদের নেই। এরা সন্তু লারমার গদি রক্ষার্থে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাদের ভূমিকা ছাত্রলীগের গুণ্ডা মাস্তানদের মতো। বর্তমানে জনসংহতি সমিতিতে এরাই বাড় বাড়ন্ত! পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, যারা পুরানা শান্তিবাহিনী সে সময় ছুটিতে ছিল, তারা তালিকা থেকে বাদ পড়ে। উপেক্ষিত হয় শহীদরাও। প্রয়াত লারমা ব্যতীত অন্য শহীদদের স্মরণে জেএসএস কোন প্রোগ্রাম করেছে বলে জানা যায় না। রাজনৈতিকভাবে ফায়দা লুটার জন্যই জেএসএস কল্পনা অপহরণ দিবসে তপরতা দেখায়। আগে শহীদ ভরদ্বাজমুণি স্মরণেও প্রোগ্রাম দিতো, এখন তা করতে দেখা যায় না।

এই হাইব্রিড জেএসএস কর্মীদের দাপটে পুরানা জেএসএস-শান্তিবাহিনী নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা। শুধু ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসনপন্থী’ কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা চালিয়ে নয়, খোদ জেএসএস-এর নেতা-কর্মীরাও এদের উপাতে টিকতে পারছে না। ‘জেএসএস আর আগের জেএসএস নেই’ এ আক্ষেপ করছেন প্রাক্তন কর্মীরা।

৪. ‘তিন মাসে’ চুক্তি বিরোধী নির্মূলের ঘোষণা, সংগঠন ও সমাজে বিরূপ প্রভাব

আত্মসর্মপণের পর খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে তরুণ চাকুরীজীবীরা সৌজন্য সাক্ষাত করতে গেলে সন্তু লারমা তাদের উদ্দেশ্যে কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘প্রদীপ লাল-কুসুম প্রিয় হত্যা (৪ এপ্রিল ১৯৯৮)-এর মতো চুক্তি বিরোধীদের হরিণ-শুকর শিকারের স্টাইলে মারা হবে। তিন মাসের মধ্যে ‘চুক্তি বিরোধীদের নির্মূল করা কোন ব্যাপার নয়।’

ধুধুকছড়ায় অবস্থানকালে বেছে বেছে লোক ডেকে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন,‘সরকারের সাথে চুক্তি হচ্ছে, সকল প্রশাসনিক ক্ষমতা জেএসএস-এর হাতে থাকবে। পাহাড়ের আনাচে-কানাচে তারা ঘুরে বেড়িয়েছে সবই চেনা-জানা, এক কথায় পার্বত্য চট্টগ্রাম তাদের নখের দর্পণে। বাদী গ্রুপকে দমন করা হয়েছে। কোথায়ে যাবে ‘চুক্তি বিরোধী’! বাইরেও জেএসএস, ভিতরেও তাদের কর্তৃত্ব থাকবে। ‘তিন মাসে’ তাদের দমন করা হবে’। ’৯৮-এর ৪ এপ্রিল প্রদীপ লাল ও কসুমপ্রিয়কে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় হত্যালীলা। পর পর কয়েকটি জোড়া খুন হতে থাকে, সে ধারা এখনও চলছে।

চুক্তিত্তোর এ ধরনের কঠিন পরিস্থিতিতে টিকতে না পেরে পিসিপি, পিজিপি (পাহাড়ি গণপরিষদ) ও এইচডব্লিউএফ-এর অনেক আন্তরিক কর্মী সমর্থক নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে যায়। এর মধ্যে দোদুল্যমান সুবিধাবাদীরা ভোলচাল পাল্টিয়ে অন্যপথ ধরে। উপায়ন্তর না দেখে অনেক উদ্যমী কর্মী বাধ্য হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেয়, এনজিও’র সাথেও যুক্ত হয় অনেকে। মুক্তিকামী তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশ গা বাঁচাতে আন্দোলন সংগ্রাম থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। মাঠ পর্যায়ের সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের একটি বিশাল অংশ চট্টগ্রাম ও ঢাকার গার্মেন্ট কারখানায় সাময়িকভাবে মাথা গুঁজতে গিয়ে আর ফিরতে পারেনি। শাসকগোষ্ঠী অভিজ্ঞ কর্মীদের সংগঠন ও আন্দোলন থেকে সরিয়ে দিতে নীলনক্সা প্রণয়ন করে থাকে। জেএসএস (সন্তু)-এর এই হত্যালীলা ও ভীতিকর পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাব শুধু সংগঠনে পড়েনি, গ্রামাঞ্চলেও সুদূরপ্রসারী শূণ্যতা তৈরি করেছে। যত দিন যাবে সমাজে এর মারাত্মক প্রভাব তত বেশি অনুভূত হবে।

(ক্রমশ)

 





0/Post a Comment/Comments