""

রাউজানে ‌‘হৃদয় হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী?

মুক্তমত




দেবরাজ চাকমা

সম্প্রতি চট্টগ্রামের রাউজানে শিবলি সাদিক হৃদয় (২০) নামে অপহৃত এক যুবকের দেহাবশেষ উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবে সাম্প্রদাায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বিকৃতভাবে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ্ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে পাহাড়িদেরকে নানা কটু কথা বলে হেনস্থা করার ঘটনা ঘটছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। সবাইকে সংযত থাকা প্রয়োজন।

ঘটনার বিষয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে যতটুকু জানা গেছে, ঘটনার সূত্রপাত রাউজানের কদলপুর এলাকার একটি মুরগি খামারে শিবলি সাদিকের অধীনে কর্মরত কতিপয় পাহাড়ি (মারমা) যুবকের মধ্যেকার বাগবিতণ্ডাকে ঘিরে। বিষয়টি খামার মালিকেরা সমাধান করে দেয়ার পরও গত ২৮ আগস্ট শিবলি সাদিক অপহৃত হন এবং খামারে কর্মরত পাহাড়ি যুবকরাও উধাও হয়ে যায়। পরে অপহৃতের পিতা বান্দরবানে গিয়ে অপহরণকারীদের হাতে দুই লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দেন। কিন্তু অপহরণকারীরা শিবলি সাদিককে মুক্তি দেয়ার কথা বললেও তিনি বাড়ি ফিরে আসেননি। ফলে এ ঘটনায় অপহৃতের পিতা থানায় মামলা দায়ের করেন এবং ‍পুলিশ চট্টগ্রাম নগরীর চাঁন্দগাও এলাকা থেকে মামলার প্রধান আসামি উমংসিং মারমাসহ কয়েকজনকে আটক করে। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর ভোররাতে রাউজান থানার ওসির নেতৃত্বে একদল পুলিশ মামলার প্রধান আসামি উমংসিং মারমার স্বীকারোক্তি মোতাবেক তাকে নিয়ে রাউজান উপজেলা সীমান্তবর্তী রাঙামাটির কাউখালীর বেতবুনিয়া ইউনিয়নের রঙ্গি পাড়া নামক এলাকার জঙ্গল থেকে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করে। পরে এসব হাড়গোড় নিয়ে পুলিশ দু্টি ভ্যানে করে থানায় ফেরার পথে কদলপুরের পঞ্চপাড়া এলাকায় উত্তেজিত জনতা রাস্তায় গাছের গুড়ি ফেলে পুলিশের গাড়ি আটকিয়ে দেয় এবং হামলা চালিয়ে গাড়ি ভাঙচুর ও আসামি উমংসিং মারমাকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে।

উক্ত গণপিটুনি ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে কিন্তু উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত্ত করতে পুলিশের কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। যদিও পুলিশ বলেছে তারা কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছুঁড়েছে।  

এর পরপরই ঘটনাটি নিয়ে অপপ্রচারের ডালপালা ছড়াতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে যেভাবে পারে পোস্ট দিয়ে, ভিডিও কনটেন্ট বানিয়ে বিকৃতভাবে তথ্য প্রচার করতে শুরু করে। কেউ কেউ ‘উপজাতিরা হৃদয়কে হত্যা করে মাংস রান্না করে খেয়ে ফেলেছে” বলে প্রচার শুরু করে দেয়। এতে বাঙালিদের একটি অংশের মধ্যে এক ধরনের পাহাড়ি বিরোধী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তৈরি হয়। এখন রাঙ্গুনিয়া ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম নগরীসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড়িদেরকে “তোমরা মানুষের মাংস খাও’... ইত্যাদি বলে হেনস্থা করার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে অভিযোগ করেছেন। এছাড়া রাউজানে পড়ুয়া পাহাড়ি শিক্ষার্থীসহ পার্শবর্তী এলাকায় বসবাসরত পাহাড়িরা নানা হেনস্তার শিকারসহ ভয়-আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

কথা হলো, অপরাধী যেই হোক তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। হৃদয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদেরও নিশ্চয় শাস্তি হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। তবে তার জন্য তো দেশের আইন-আদালত রয়েছে। আদালতই তদন্ত সাপেক্ষে তার অপরাধ ও শাস্তি নির্ধারণ করবে। কিন্তু মামলার আসামিকে পুলিশের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করাটাও বড় ধরনের অপরাধ। এটি একটি বিচার বহির্ভুত হত্যা। তাই এ গণপিটুনিতে আসামি হত্যার ঘটনার জড়িতরাও শাস্তি থেকে রেহাই পেতে পারে না। তাদেরকেও আইনের আওতায় এনে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

অপরদিকে, পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে আসামিকে রক্ষা করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাকে আদালতে সোপর্দ করা। কিন্তু পুলিশ সেটা করতে পারেনি। আদালতে সোপর্দের আগেই পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে আসামিকে হত্যা করা হয়েছে। এটা পুলিশের দুর্বলতা নাকি ইচ্ছাকৃত তা বোঝা মুশকিল। কারণ পুলিশ জনতাকে নিবৃত্ত করার মতো যথাযথ পদক্ষেপ নিলে নিশ্চয় আসামিকে রক্ষা করতে পারতো এবং ঘটনার প্রকৃত রহস্যও উদ্ঘাটন হতো। কিন্তু আসামিকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে ঘটনার রহস্য আড়াল করা হলো কিনা তাও দেখার বিষয়।

ঘটনা শুধু এই গণপিটুনিতেই শেষ নয়। গতকাল (১৪ সেপ্টেম্বর) আবারো একই এলাকায় দুই পাহাড়ি যুবককে (বলা হচ্ছে হৃদয় হত্যাকাণ্ডের ৩ ও ৪ নং আসামি) গণপিটুনি দিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রাখার আরো একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের উপস্থিতিও দেখা গেছে। সেই ভিডিওটি দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সেনাবাহিনী ও পুলিশের সামনেই তাদের গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীই আসামিদের একে একে জনতার হাতে তুলে দিয়ে গণপিটুনি দেয়ার ব্যবস্থা করছে। ফলে পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে একজন আসামির নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

শিবলি সাদিক হৃদয় হত্যাকাণ্ডটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। এই হত্যাকাণ্ডটি যারা ঘটিয়েছে তারা সমাজ-জাতির কাছে অপরাধী। দেশের প্রচলিত আইনে অপরাধীদের বিচার ও সাজা হবে। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো একটি জাতির ওপর দায় চাপানো কিসের আলামত? কী উদ্দেশ্যে, কারা এই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে? এতে কি বিশেষ কোন মহলের ইন্ধন রয়েছে? এই প্রশ্নগুলোরও উত্তর খোঁজা দরকার। তাই সরকার ও প্রশাসনের উচিত রাউজানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাতে সাম্প্রদায়িক কোন পরিস্থিতির উদ্ভব না হয় সেদিকে নজর রাখা এবং যারা এই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।


[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত ]


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


 





0/Post a Comment/Comments