""

পার্বত্য চট্টগ্রামে ও প্যালেস্টাইনের ভূমিতে সেটলারদের মুল বৈশিষ্ট্য একই : ইমতিয়াজ মাহমুদ

আপনারা ভালমানুষেরা, আপনারা যখন আজ আমার মতই ফিলিস্তিনিদের জন্যে কাঁদবেন, চোখের জল ফেলবেন- মেহেরবানী করে এক ফোঁটা আশ্রু আপনার পাশের বাড়ীর আপনজন আদিবাসীদের জন্যেও ফেলবেন। ফিলিস্তিনিদের পক্ষ হয়ে যখন প্রতিবাদ করবেন, তখন আমাদের পাহাড়ের জন্যেও একটা দুইটা বাক্য বলবেন। সেটা যদি আপনি না করেন, ফিলিস্তিনিদের জন্যে আপনার প্রতিবাদ ন্যায়সঙ্গত হবে না। 
ইমতিয়াজ মাহমুদ। সংগৃহিত ছবি

(১)

গাজায় মৃত্যু আতঙ্কে থাকা ফিলিস্তিনিদের অবস্থা সম্ভবত আমি খানিকটা অনুভব করতে পারি। মাত্রাগত তারতম্য থাকলেও মোটামুটি (প্রায় বা অনেকাংশেই) একইরকম ঘটনা আমি আমার প্রিয় মাতৃভূমিতেও দেখেছি। সত্তরের দশকের শেষদিকে, জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট, তাঁর নির্দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতল থেকে নিয়ে গিয়ে অসংখ্য বাঙালী পরিবারকে সেটেলমেন্ট দেওয়া হলো। প্রতিটি পরিবারকে ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হলো, নগদ টাকা দেওয়া হলো আর সাথে রেশন দেওয়া। সর্বশেষ যখন আমি খবর নিয়েছি, এই সেটেলাররা এখনো নিয়মিত রেশন পায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালী সেটেলার আর প্যালেস্টাইনের ভূমিতে ইহুদী সেটেলার ওদের মধ্যে নানারকম পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে- কিন্তু মুল বৈশিষ্ট্য একই। হঠা করে আপনি দেখলেন আপনার নিজের ভূমিকে আপনি আর চিনতে পারছেন না। এর ডেমিগ্রাফিক প্যাটার্ন পাল্টে গেছে। সরকারী সেটেলাররা সংখ্যায় আপনার চেয়ে বেশী হয়ে গেছে। আপনার এলাকার যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, সেটা পাল্টে গেছে। আর সেটেলার যারা, দেখতে পাচ্ছেন যে ওরা আপনার প্রতি বৈরি, পদে পদে আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। আপনার পিতৃপিতামহেরও আগে থেকে যে ভূমিকে আপনি আপনার নিজের জেনেছেন, সেগুলি ওরা দখল করে নিচ্ছে।

(২)

আর দুই ক্ষেত্রেই, সেই সেটেলারদের পৃষ্ঠপোষক ও পাহারাদার হিসাবে নিয়োজিত আছে সশস্ত্র বাহিনী। এইসব বাহিনী আপনার পাড়ায় গ্রামে ওদের বুটের আওয়াজ তুলে টহল দিচ্ছে। স্থানীয় আদিবাসীদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, যখন তখন তল্লাশি করছে। সেটেলাররা ছুতানাতায় স্থানীয় ক্যাম্পে গিয়ে নালিশ করে। সরকারী বাহিনীর হাতে মাঝে মাঝেই নিহত হয় বা নির্যাতিত হয় আপনাদের লোকজন। প্যালেস্টাইন আর বাংলাদেশের পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু মিলও আছে। সেটেলারদের উপস্থিতির ফলে কোন কোন এলাকার এথনিক ক্লিঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে- আমাদের দেশেও, প্যালেস্টাইনেও।

আজ যখন ইসরাইলের বাহিনী গাজায় সর্বাত্মক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আমরা সকলেই ইসরাইলি বাহিনীর এইরকম নৃশংস কর্মকাণ্ডের নিন্দা করছেন আপনারা সকলেই। কেউ কেউ হামাসকেও নিন্দা করছেন, সাথে ইসরাইলকেও। সকলেই চাইছেন যেন সেখানে রক্তপাত না হয়। যেন সেখানে শিশু হত্যা না হয়। সকলেই চাইছেন যেন যার যার ভূমিতে সকল মানুষ নিরাপদে বাস করতে পারে। সকলেই চাইছেন ইসরাইলী সেটেল্ররা যেন আর কোন ফিলিস্তিনি ভূমি দখল না করে, আর যেন সেটেলারদের জন্যে বসতি স্থাপন করা না হয়। আপনারা ভাল মান্সুহ, হৃদয়বান মানুষ, ন্যায়বোধ আছে আপনাদের, সেজন্যে এইসব দাবী করছেন।

(৩)

আপনারা ভালো মানুষেরা, দেশের দিকেও মাঝে মাঝে একটু দেখবেন। এই তো দুই তিনদিন আগে একটা ওয়েব পোর্টালে খবর দেখলাম লঙ্গদুতে কিছু আদিবাসী মানুষ মছিল করছে। কি হয়েছে? সেটেলাররা সেখানে নাকি একটি বৌদ্ধমন্দিরের জায়গা দখল করে নিয়েছে। এই লঙ্গদুতেই কয়েক বছর আগে একদিনে আদিবাসীদের তিন শতাধিক ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুক্রবার ছিল। সেটেলাররা মিটিং করেছে, মিছিল করেছে, তারপর গিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে- সবকিছু জুমার আগে আগে শেষ। সেই কাণ্ডের এখনো কোন বিচার হয়েছে? পাহাড়িদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার জন্যে কারো শাস্তি হয়েছে?

আমার হৃদয় ফিলিস্তিনিদের কাছে চলে যায়- কোন ধর্মীয় কারণে নয়, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে মুসলমান আছে খৃস্টান আছে, অল্প কিছু অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও আছে। মায়া আমার ইহুদীদের জন্যেও আছে- শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ওদের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে সে তো আমি অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু তাঁর জন্যে ফিলিস্তিনিদের উখাত করে দিতে হবে? ফিলিস্তিনিদের সাথে আমার এই আত্মার সংযোগ এইখানে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আমি চাকমা মারমা লুসাই ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীসমূহের চেহারা দেখতে পাই। নিজ ভূমিতে এইরকম প্রতিনিয়ত ধারাবাহিক অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হওয়া- সেই ব্যাথা আমি জানি।

(৪)

আপনারা ভালমানুষেরা, আপনারা যখন আজ আমার মতই ফিলিস্তিনিদের জন্যে কাঁদবেন, চোখের জল ফেলবেন- মেহেরবানী করে এক ফোঁটা আশ্রু আপনার পাশের বাড়ীর আপনজন আদিবাসীদের জন্যেও ফেলবেন। ফিলিস্তিনিদের পক্ষ হয়ে যখন প্রতিবাদ করবেন, তখন আমাদের পাহাড়ের জন্যেও একটা দুইটা বাক্য বলবেন। সেটা যদি আপনি না করেন, ফিলিস্তিনিদের জন্যে আপনার প্রতিবাদ ন্যায়সঙ্গত হবে না।

 *লেখাটি লেখক ইমতিয়াজ মাহমুদের ফেসবুক থেকে নেওয়া হয়েছে।




সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments