""

পাহাড়ের উদীয়মান প্রজন্মের উদ্দেশ্যে

মুক্তমত

প্রতীকী ছবি

রাঙবেল চাকমা ছদক 
ঢাবি (ক্রিমিনোলজি ডিপার্টমেন্ট)



ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম কতটুকু নিরাপদ? পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ভূ-খন্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি বৃহত্তর অঞ্চল। যেখানে যুগযুগ ধরে অবস্থান করে আসা পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলো অস্তিত্ব হারানোর অবস্থায় রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে মূল ভূখণ্ড থেকে এই জাতিসত্তাদের দূরে সরিয়ে রাখার শাসকগোষ্ঠীর কূটকৌশল। 

সেই মুঘল আমল হোক কিংবা গ্রেট ব্রিটেন তথা আজকের বাংলাদেশ প্রতিটি উপনিবেশিক শাসক ও স্ব-ভূখন্ডের রাষ্ট্রের সাথে বার বার লড়াই, সংগ্রাম ও যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীদের। কালের পরিক্রমায় আগেকার রাজ্য ক্ষমতা কিংবা রাজনৈতিক অধিকার সবকিছু থেকেই পিছিয়ে বর্তমানে অস্তিত্বহীনতার সম্মুখে পাহাড়ের সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও তাদের প্রজন্মরা। একের পর এক রাষ্ট্রের নিপীড়ন ও শোষণ প্রায় পঙ্গু করেছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠিকে। তার সাথে রাজনৈতিক অসচেতনতা, পুঁজিবাদের আগ্রাসন, দালাল-ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী সৃষ্টির মাধ্যমে প্রজন্মকে বানানো হচ্ছে রাজনীতি বিমুখ।

অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক আগে থেকেই কিছু মুভমেন্ট বা আন্দোলন শুরু হলেও মূলত ১৯৭২ সালের পর থেকে এম.এন.লারমা তথা পিসিজেএসএস এর নেতৃত্বে ‘শান্তিবাহিনী’র সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, যেই সংগ্রাম ও আন্দোলনের ধস নামে ১৯৯৭ সালে চুক্তির মাধ্যমে। 

এই চুক্তি একদিকে যেমন সরকারের জন্য ফলপ্রসূ ছিল, অন্যদিকে পাহাড়ের জাতিসত্তাদের জন্য ছিল এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের প্রতিফলনের নব অধ্যায়, যার ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান। 

১৯৮৩ সালে পিসিজেএসএস-এর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা শহীদ হওয়ার পর স্বায়ত্তশাসন তথা জুম্মল্যান্ডের স্বপ্নও অনেকটাই অমলিন হয়ে পড়ে পার্বত্য চুক্তির পরে। 

আশির দশকের শেষ দিকে গঠন হওয়া পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) ও পাহাড়ি গণ পরিষদের নেতা কর্মীরা ‘৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় এই চুক্তির দুর্বলতা দিক তুলে ধরে সমলোচনা করেন। তারা এই চুক্তিকে আপোষ চুক্তি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে ’৯৮ সালের ৪ এপ্রিল খাগড়াছড়ির পানছড়িতে প্রদীপ লাল-কুসুমপ্রিয় চাকমাকে হত্যার মাধ্যমে পিসিজেএসএস শুরু করে এক রক্তক্ষয়ী প্রতিহিংসার অধ্যায়।

পরবর্তীতে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে ’৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর গঠন করা হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে একটি নতুন দল। এই দলটি সৃষ্টির পরপরই রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নানা চক্রান্তে মেতে ওঠে। এই দলকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে শুরু করা হয় অন্যায় দমন-পীড়ন। সমান তালে পিসিজেএসএসকে দিয়ে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের হত্যা, গুম করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং উভয় দলের বিপুলসংখ্যক প্রতিভাবান তুখোড় নেতা ও মেধাবী বিপ্লবীদের হারাতে হয়। 

অন্যদিকে, এরই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয় নতুনভাবে সেটলার পুনর্বাসন, সেনাক্যাম্প সম্প্রসারণ, পর্যটন বাণিজ্য, ভূমি দখল, ধর্ষণ, হত্যা, গুমসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজ। নামে বেনামে বিভিন্ন দালাল, ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী দিয়ে সাধারণ জনগণকে হুমকি, উদীয়মান রাজনৈতিক নেতা ও প্রতিভাবান লোকদের হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত দমন-পীড়নের স্টিম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর উপর।

সাজেক থেকে চিম্বুক কিংবা ফুরোমোন থেকে গাল্লেমোন শুধুই হাহাকার আর আর্তনাদ। প্রজন্মের চোখে মাদকের নেশা, ব্লগিং কালচার, রাজনৈতিক বিমুখতার জন্য প্রোপাগান্ডা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে অন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। 

একটি জাতিসত্তার উত্থান ও পতন দুটোই নির্ভর করে নতুন প্রজন্মের উপর। প্রজন্ম যদি দায়িত্ববোধ ও জাতীয় চেতনাবোধ সম্পন্ন হয় তবেই একটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষা পায়। কিন্তু আজকে পাহাড়ের প্রজন্ম বিরাট একটি ভুল পথে পা দিচ্ছে। 

যার কারণ হল- চুক্তির পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে যে একটি এলিট শ্রেণির সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র এই এলিট শ্রেণিকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে সুবিধাবাদী শ্রেণিতে পরিণত করেছে। আর এই সুবিধাবাদী শ্রেণিটিই এখন শাসকগোষ্ঠীর সাথে মিলে পাহাড়ের দরিদ্র ও সর্বহারা মানুষের শোষকের অংশ হিসেবে কাজ করছে। 

কথা ছিল এই চুক্তির সুফল ভোগ করবে পুরো জুমিয়ারা। তারা ন্যায্য অধিকার পাবে, শিক্ষা পাবে, চিকিসা পাবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এসব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে শহরের অট্টালিকায় অবস্থান করা সুবিধাবাদীরা, যারা অধিকাংশ সময়েই সরকারের পা-চাটা ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে থাকে। কিন্তু পাহাড়ের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো ঠিক মতো ভাত খেতে পায় না জুমিয়ারা, বিদ্যু নেই, একটি হাসপাতাল নেই। 

যেই জুমিয়াদের কথা ভেবে এম.এন. লারমারা জুম্মল্যান্ডের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তার অর্জনতো হয়নি, বরং সেই জুমিয়ারা আজো নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

আর সে সময়ে অধিকারের প্রশ্নে যারা ভেঙচি কেটে মুখ লুকিয়েছিল, যারা এরশাদ সরকারের চাকরিতে মশগুল হয়েছিল ঠিক তারাই আজ চুক্তির গুণগান গাইছে। তারাই আজ চুক্তির সুবিধা পাচ্ছে আর তাদের উত্তরসূরীরাই বর্তমান প্রজন্মকে পথভ্রষ্ট করে বিপথগামী করছে এবং লড়াইয়ে মাঠ থেকে দূরে সরে নিয়ে গিয়ে পাহাড়ি জাতিসত্তাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। 

আক্ষরিক অর্থে পৃথিবীতে সেসব জাতিগোষ্ঠীরাই আজ পৃথিবীকে শাসন করছে যারা প্রজন্মকে জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনায় গড়ে তুলতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রজন্মরা যেনো বিপরীতমুখী হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে আমাদের সামনের দিনগুলো আরো দুঃসময়ে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সুতরাং, প্রজন্মকে জাতীয় চেতনাবোধের মধ্যে উজ্জীবিত রাখার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। 

প্রজন্মকে জানাতে হবে আমাদের পাহাড়ের উত্তরসূরীদের সংগ্রামের আত্মগাঁথা। তারই সাথে নতুন প্রজন্মকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে রাষ্ট্রের ফাঁদে পা দিয়ে আমাদের মতো সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্বকে হুমকির দিকে যাতে না ঠেলে দিই। পূর্বের উত্তরসূরীদের ভুলের মাশুল যেমন এখনকার প্রজন্মকে দিতে হচ্ছে, তেমনি ভবিষ্যত প্রজন্মদেরও যাতে এর মাশুল দিতে না হয় সে বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে। আর রাজনৈতিক মহল ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উচিত হবে প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষাদান ও আদর্শের অধিকারী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করা।

পাহাড়ের অধিকার আদায়ের পথে প্রজন্মকে আরো সম্পৃক্ত হতে হবে এবং এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একটি লড়াইকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে নিতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার নিয়ে বাঁচার এই লড়াইয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম যাতে অবিচল থাকে এটিই সকলের কাম্য।

অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, পাহাড়ের ভূমি রক্ষার সংগ্রাম, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তথা পাহাড়ের শেকড়কে রক্ষা করার সংগ্রামের দায়িত্ব প্রজন্মকে নিতে হবে। এই লড়াই জারি থাকুক প্রতিটি প্রজন্মের রক্তে রক্তে, শিরায় শিরায়। রক্তে প্রবাহিত হোক শহীদ বিপুল, লিটন, সুনীলদের আত্মত্যাগের মহিমা, দ্রোহের আগুন জ্বলুক দালালের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে।

পাহাড় একদিন মুক্তি পাবেই। ব্যারিকেড ভাঙবে রাজপথে এই প্রজন্মের হাত ধরেই।

লড়াই লড়াই লড়াই চাই...

লড়াই করে বাচঁতে চাই!


[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত ]


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments