""

৩২ বছরেও বিচার হয়নি বর্বরোচিত লোগাঙ গণহত্যার

লোগাং পোড়াভিটায় অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ। ফাইল ছবি

বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০২৪

আজ ১০ এপ্রিল ২০২৪ বর্বরোচিত লোগাং গণহত্যার ৩২ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৯২ সালের আজকের এই দিনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় সেটলার বাঙালিরা খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাঙে পাহাড়িদের গুচ্ছগ্রামে বর্বর গণহত্যা চালায়। শান্তিবাহিনী কর্তৃক এক বাঙালি রাখাল বালককে হত্যার মিথ্যা অভিযোগে তারা এ গণহত্যা সংঘটিত করে। এতে কয়েকশত পাহাড়ি হতাহত হয়। অনেকে নিঁখোজ হয়ে যায়। সেদিন শিশু, বৃদ্ধ, নারী কেউই রেহাই পায়নি। অগ্নিসংযোগ করে ছাই করে দেওয়া হয় পাহাড়িদের ৭ শতাধিক ঘরবাড়ি। দীর্ঘ ৩২ বছরেও এ গণহত্যার বিচার হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উসব বৈ-সা-বি (বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু...) উসবের মাত্র দুই দিন আগে সংঘটিত এ গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পাহাড়িরা। বর্জন করা হয় বৈ-সা-বি উসব।

এই বর্বর গণহত্যার ফলে সে বছর বৈ-সা-বি’র আনন্দ উসব শোক সাগরে পরিণত হয়। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ১২ ও ১৪ এপ্রিল ’৯২ শোকসভা হয়। উসবের মূল দিন (মূল বিঝু) ১৩ এপ্রিল ’৯২ খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হাজার হাজার লোকের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা থেকে আগত রাজনৈতিক  সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, লেখক-সাংবাদিকরাও আনন্দ উসবের পরিবর্তে আপামর জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সামিল হয়। খাগড়াছড়ির হাজার হাজার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সেদিন বাঁধ ভাঙা পানির মতো রাজপথে নেমে সরকারের বর্বরতার প্রতিবাদ জানান। স্বতঃস্ফুর্তভাবে বৈ-সা-বি উসব বর্জন করা হয়। নিহতদের সম্মান জানাতে রান্না করা পাজন (মূল উসবের দিন হরেক রকমের সবজি দিয়ে তৈরি খাদ্য বিশেষ) চেঙ্গী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। নিহতদের স্মরণে হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।

লোগাঙ গণহত্যার প্রতিবাদ ও বৈসাবি বর্জন করে ‘সর্বস্তরের জনসাধারণ’ ব্যানারে মিছিল খাগড়াছড়ি কলেজের কড়ইতলা থেকে চেঙ্গি স্কোয়ারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। (১৩ এপ্রিল ১৯৯২)

বৈ-সা-বি উপলক্ষে ঢাকা থেকে আগত রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, লেখক-সাংবাদিকবৃন্দ ১২ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যাবার পথে পানছড়ি উপজেলা সদরে সেনাবাহিনী তাদের বাধা প্রদান করে। ফলে তারা ঘটনাস্থলে যেতে পারেননি।

এরপর ঢাকায় ফিরে গিয়ে তারা সংবাদ মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। এতে তারা বলেন, “খাগড়াছড়ি গিয়ে আমরা স্বভাবতঃই ঐ অঞ্চলে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করি ঘটনার সত্যাসত্য জানবার দায়িত্ববোধ থেকে। কিন্তু পরের দিন ১২ই এপ্রিল লোগাং যাবার পথে পানছড়িতে আমরা বাধাগ্রস্থ হই এবং আমাদের নিরাপত্তার কথা বলে নিরাপত্তাবাহিনী আমাদের ঘটনাস্থলে যেতে বাধাদান করে। ফিরবার পথে এবং খাগড়াছড়িতে বহু সংখ্যক প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঘটনার শিকার ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের সাক্ষা হয়। কর্তৃপক্ষীয় বিভিন্ন ব্যক্তির সাথেও এ নিয়ে আমাদের কথা হয়। এ সব কিছু থেকে আমরা এই স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, লোগাং গ্রামে একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। একজন বাঙালি কিশোর নিহত হওয়ার সূত্র ধরে সেখানে চাকমা ও ত্রিপুরা গুচ্ছগ্রামে গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ভিডিপি ও আনসার বাহিনী কিছু বাঙালি দুষ্কৃতিকারীর সহযোগিতায় হামলা চালায়। চারশরও বেশি ঘর সেখানে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয় এবং শিশু-নারী-বৃদ্ধসহ ২ শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। এ বর্বর গণহত্যার বর্ণনা শুনে আমরা স্তম্ভিত হই, এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। এ বর্বর গণহত্যার কারণে পুরো অঞ্চলে পাহাড়ি জনগণের বার্ষিক উসবের সকল কর্মসূচি পরিত্যক্ত হয়। আনন্দমুখর জনপদ শোক ও অশ্রুর জনপদে পরিণত হয়। ঘরছাড়া, মা হারানো, বাবা হারানো, সন্তান হারানো নিরীহ দুর্বল দরিদ্র জনগণের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ক্ষুব্ধ। একইসঙ্গে আমরা ক্ষুব্ধ প্রকৃত ঘটনা চেপে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের ন্যাক্কারজনক চেষ্টায়”।

এতে তারা আরো বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য জনগণের উসবের অংশীদার হতে গিয়ে আমরা তাঁদের শোকের ও ক্ষোভের অংশীদার হয়েছি। অঞ্চলের জনগণ ও কর্তৃপক্ষের বিভিন্নস্তরে কথা বলে এবং বাস্তব অবস্থা দেখে বুঝেছি সমগ্র এলাকায় কার্যতঃ একটি সামরিক শাসন চলছে। সমগ্র বেসামরিক প্রশাসন আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসনের অধীনস্ত এলাকায় সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের কোন স্বাধীন কার্যক্রম নেই। চলাফেরার স্বাধীনতা সাংঘাতিকভাবে সীমাবদ্ধ।”

বিবৃতিতে তারা লোগাঙ হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তসহ ৬ দফা দাবি জানিয়েছিলেন। দাবিগুলো হচ্ছে-
(১) অবিলম্বে লোগাং হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। পুরো ঘটনা বিস্তারিতভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে এতদিন যত হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, নিপীড়ন হয়েছে সেই ঘটনাবলীর বিচার বিভাগীয় তদন্তকার্য পরিচালনা করে সকল তথ্য প্রকাশ করতে হবে ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে।

(২) পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ২০ বছরে সৃষ্ট পরিস্থিতি, রাজস্ব ব্যয় ও তার ফলাফল সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।

(৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাধানের জন্য বলপ্রয়োগের নীতি বর্জন করে বিষয়টিকে সংসদের অধীনস্থ করতে হবে এবং ঐ সংসদে খোলাখুলি আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে।

(৪) সংসদ সদস্য ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি গঠন করে তার মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্টি-দল ও সামাজিক শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে এবং ঐ অঞ্চলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করবার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

(৫) প্রশাসনকে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে বেসামরিক নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন কার্যকর করতে হবে।

(৬) অঞ্চলের সমগ্র জনগণকে হাতেগোণা কিছু লোকের শান্তিবাহিনীর সঙ্গে এক করে দেখার বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন করতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ যাতে নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এ দেশের সব মৌলিক অধিকার ধারণ করে পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকতে পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লোগাং হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের শোক মিছিল, ১৮ এপ্রিল’৯২

হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ১৮ এপ্রিল ’৯২ ঢাকায় এক শোক মিছিলের আয়োজন করে এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের তকালীন সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে লোগাং হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।

এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং নিহতদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন ও শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালের ২৮ এপ্রিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় লোগাং অভিমুখে ঐতিহাসিক মৌন পদযাত্রা। হাজার হাজার নারী-পুরুষ এ পদযাত্রায় অংশ নেন। ঢাকা থেকে আসা রাজনৈতিক দলের নেতা, ছাত্র নেতা, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী-লেখকরাও পাহাড়ি জনগণের সাথে সংহতি জানিয়ে এই পদযাত্রায় অংশ নেন। সেনাবাহিনীর সকল বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে সেদিন লোগাং পোড়াভিটায় গিয়ে তারা ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

লোগাং অভিমুখে পদযাত্রা, ২৮ এপ্রিল ১৯৯২। ফাইল ছবি

এখানে আরো উল্লেখ্য যে, লোগাঙ গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ১০ এপ্রিল ’৯২ রাতে খাগড়াছড়ি শহরের চেঙ্গী স্কোয়ারের পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। উক্ত স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হলে স্থানীয় সেনা ও সিভিল প্রশাসনের ঘুম হারাম হয়ে যায়। এরূপ একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হউক তা স্থানীয় সেনা প্রশাসনের অন্ততঃ কামনার বিষয় ছিল না এবং সেনা প্রশাসনের নাকের ডগায় নির্মিত এ স্মৃতিস্তম্ভটি সেনা প্রশাসনের অসহ্যের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। তারা বিভিন্নভাবে নানা জনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত খাগড়াছড়ির সড়ক ও জনপদের নিবাহী প্রকৌশলী জনাব হাবিবুর রহমানকে দিয়ে এ স্মৃতিস্তম্ভটি সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, খাগড়াছড়ি জেলা শাখাকে নোটিশ দেয়া হয়। উক্ত নোটিশে ৭ দিনের মধ্যে স্মৃতিস্তম্ভটি সরিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেয়া হয়।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের ব্যাপার, উক্ত ৭ দিন সময় অতিবাহিত না হতেই খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমাণ্ডার হাসান মশহুদ চৌধুরীর অত্যন্ত কড়া নির্দেশে জনাব হাবিবুর রহমানকে ঘুম থেকে তুলে এনে তার বিভাগীয় বুলডোজার দিয়ে ২৫ এপ্রিল, ৯২ উক্ত স্মৃতিস্তম্ভটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। 

উক্ত ঘটনায় উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার জনাব হাসন মশহুদ চৌধুরী, সদর জোন কমাণ্ডার লেঃ কর্ণেল জন গোমেজ, এন, ডি, সি, জনাব আজিজুর রহমান, ওসি এ, এস, ইউ জনাব মেজর রেজা, ওসি খাগড়াছড়ি সদর থানা জনাব মইন উদ্দীন এবং সড়ক ও জনপদ ২ নং বিভাগের নিবাহী প্রকৌশলী জনাব হাবিবুর রহমান ও বুলডোজারের ড্রাইভার।

ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে ছাত্রজনতা ২৬ শে মে ‘৯২ খাগড়াছড়িতে এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল বের করে। (সূত্র: কেওক্রাডং)।

দীর্ঘ ৩২ বছরে দেশে ক্ষমতার নানা পালাবদল ঘটেছে। কিন্তু কোন সরকারই বর্বর এ গণহত্যার বিচার করেনি। শুধু এই গণহত্যা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের উপর এ যাবত ডজনের অধিক গণহত্যা ও আরো কয়েক ডজন সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু কোন ঘটনারই বিচার ও দোষীদের শাস্তি হয়নি। ফলে এখনো বার বার সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হতে হচ্ছে পাহাড়ি জনগণকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ চায় রাষ্ট্র লোগাং গণহত্যাসহ এ যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের উপর সংঘটিত সকল গণহত্যার শ্বেতপত্র প্রকাশ করে সুষ্ঠু বিচার করুক। তাই রাষ্ট্রের উচিত এর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণের ওপর অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটানো।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments