""

কেএনএফ বিরোধী সেনা অভিযান ও আমাদের করণীয়



সচিব চাকমা, সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, ইউপিডিএফ


একটি অতি পরিচিত গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। গল্পটি যদিও অনেকের জানা, তারপরও প্রাসঙ্গিক কারণে এখানে নতুন করে বলা প্রয়োজন মনে করছি। গল্পটি হলো এ রকম: এক বৃদ্ধ পিতার ৪ ছেলে ছিল। তারা প্রতিদিন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকত। একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য তারা সবকিছু করত। আর প্রতিবেশিরা তাদের এই অনৈক্য ও দ্বন্দ্বের সুযোগ নিত এবং লাভবান হত। এভাবে তাদের স্বচ্ছল পরিবারটি এক সময় সর্বস্বান্ত হওয়ার উপক্রম হল। একদিন বৃদ্ধ পিতা তার সব ছেলেকে ডাকল এবং প্রত্যেকের হাতে একটি করে কাঠি দিয়ে সেটা ভাঙতে বলল। তারা প্রত্যেকে অতি সহজে যার যার কাঠি ভেঙে ফেলল। এবার বৃদ্ধটি সব কাঠি এক করে প্রত্যেককে ভাঙতে বলল। কিন্তু একসাথে এতগুলো কাঠি কেউ ভাঙতে পারল না। এরপর বৃদ্ধ তাদের শিক্ষা দিয়ে বলল, ‘তোমরা যদি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া কর, তাহলে তোমাদের মধ্যে অনৈক্য হবে এবং অন্যেরা সহজে সেই সুযোগ নিতে পারেবে, আর তোমরা কেউ অন্যের সাথে পেরে উঠবে না।’ ছেলেরা তাদের ভুল বুঝতে পারল এবং ঝগড়া বন্ধ করল। এরপর থেকে প্রতিবেশিরা আর সুযোগ নিতে পারল না। ছেলেরা সর্বদিক দিয়ে উন্নতি করতে লাগল।

কেএনএফের সাথে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে চার শিশুসহ ৩ বম নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২ মাস বয়সী এক দুধের শিশুও রয়েছে। সংগৃহিত ছবি

অন্য যে কোন সময়ের চাইতে বর্তমানে এই গল্পটি আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। কেননা, সরকার এখন বম জাতিগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের ওপর জাতি নির্মূলীকরণ অভিযান চালাচ্ছে। তাদের প্রচারণায় এখন কেবল বমরাই খারাপ। (অতীতে তাদের দৃষ্টিতে বমরা “ভালো” ছিল, কারণ তখন তারা তাদেরকে চাকমা বা মারমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।)। এভাবে এক জাতিকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ধ্বংস করার চেষ্টা শাসকগোষ্ঠীগুলো হামেশা করে থাকে। তারা বমদের ধ্বংস করার পর একে একে অন্যদেরও ধ্বংস করবে। তারা আমাদের সব জাতিগুলোকে বিনাশ করবে। এটাই হলো শাসকগোষ্ঠীর নীতি।

যাই হোক, বর্তমানে সেনাবাহিনী বম জাতিকে টার্গেট করে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। এর ফলে তাদের জীবনে ঘোর দুর্যোগ নেমে এসেছে। গণহারে নিরীহ লোকজনকে গ্রেফতার, নানাভাবে হয়রানি, চাল-শুটকিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যবস্তু ক্রয় ও বহনের ওপর বাধা-নিষেধ এখন রুমা ও থানচিতে জীবনের অংশ হয়ে গেছে। নিরীহ গ্রামবাসীকে খুন করে তাকে কেএনএফ সদস্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। দুধের শিশুসহ অসহায় বম নারীদের ধরে জেলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সত্যিই বেদনাদায়ক।

সেনাবাহিনীর ছোঁড়া মর্টার শেলের টুকরো বিদ্ধ হয়ে আহত এক বম নারী। ছবি: সংগৃহিত

তথাকথিত অভিযানের কারণে সব সক্ষম পুরুষ, এমনকি নারীরাও গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছে। বলতে গেলে অনেক বম গ্রাম এখন জনশূন্য। সেখানে এখন সেনারা বাংকার বানিয়ে অবস্থান করছে।  এর আগের এক অভিযানে ৫ শতাধিক বম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সামান্যতম উদ্যোগও আজ পর্যন্ত সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। চলমান দ্বিতীয় অভিযানেও অনেকে গভীর অরণ্যে পালিয়ে গেছে; সেখানে তারা অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। অনেকে হয়তো সীমান্ত অতিক্রম করে থাকতে পারে। সবকিছু দেখে ও বিচার করে মনে হয়, শাসকগোষ্ঠী বমদেরকে তাদের স্বদেশভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করতে চায়।

আমরা জানি, বম জাতির জনগণের দীর্ঘ দিনের বঞ্চনা ও ক্ষোভ রয়েছে। এদেশে তারা অবহেলিত। কিন্তু এটাও সত্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কেবল তারা নয়, ম্রো, খুমি, খিয়াং, চাক, তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ সবাই অধিকারহারা জাতি। তারাও শোষণ ও বঞ্চনার শিকার; তাদের সবার জাতীয় অস্তিত্ব আজ সংকটাপন্ন। এদেশের সংবিধান তাদের আলাদা পরিচয় স্বীকার করে না। তারা সবাই উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী শাসকগোষ্ঠীর নিষ্ঠুর জাতিগত নিপীড়নের শিকার। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সব জাতিসত্তার অবস্থা ও ভাগ্য একই।

কিন্তু এর থেকে বাঁচার উপায় কী? আমরা প্রত্যেক জাতি গোষ্ঠী যদি অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদাভাবে সংগ্রাম করি, তাহলে কি এ নিপীড়ন থেকে মুক্ত হতে পারবো? অধিকার অর্জন করতে পারবো? আমরা যদি একে অপরের সাথে বিবাদ করি, তাহলে কি শাসকগোষ্ঠী তার সুযোগ নেবে না? আমাদের অবশ্যই উপরে বর্ণিত গল্পটি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমরা যদি সকল জাতিসত্তা এক হয়ে শাসকদের সামনে দাঁড়াই, সংগ্রাম করি, তাহলে তারা কখনই আমাদের পদানত করতে  পারবে না; বরং আমাদের ন্যায্য অধিকার দিতে বাধ্য হবে। এটা এমনই এক সরল সত্য, যার সামান্যতম চিন্তা করার ক্ষমতা আছে তার পক্ষেও বোঝা সম্ভব।

সেনা অভিযানের কারণে ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাচ্ছে শিশুসহ বম পরিবারের লোকজন। ছবি: সংগৃহিত

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা যদি সবাই নিপীড়িত হই, আমাদের সবার ভাগ্য যদি এক হয়, তাহলে আমাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম হচ্ছে না কেন? এটা ঠিক, আমাদের আন্দোলনে সকল জাতিসত্তার এবং সকল শক্তির মধ্যে ঐক্য হওয়ার পথে বাধা রয়েছে। একটি হলো, বাংলাদেশ সরকারের ভাগ করে ধ্বংস করার নীতি। শাসকগোষ্ঠী তার শাসন-শোষণ ও উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী আধিপত্য বজায় রাখার জন্য পাহাড়ি জাতিগুলোর মধ্যে সব সময় বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে থাকে। এক জাতির বিরুদ্ধে অন্য জাতিকে ক্ষেপিয়ে তোলে, তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা করে। তারা চায় না পাহাড়ের সকল জাতিসত্তা এক হোক। তারা এক জাতিকে অন্য জাতিগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায়। কারণ তারা জানে ১৯৯০ দশকে যখন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণের জনগণ এক হয়েছিল, সকল জাতিসত্তা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তখন সেনা-শাসকগোষ্ঠী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। সে কারণে শাসকরা সব সময় চায় আমাদের মধ্যে ভাইয়ে ভাইয়ে, এক জাতির সাথে অন্য জাতির মধ্যে সব সময় দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগে থাকুক।

আমাদের মধ্যে ঐক্যের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রধান অন্তরায় হলো জেএসএস, বা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে সন্তু লারমা। তার স্বেচ্ছাচারী ও ফ্যাসিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ কেবল ঐক্যের পথে বাধা নয়, তা অনেক বিভেদ ও সংঘাতেরও কারণ হয়েছে। তার কারণে ১৯৮০ দশকে জেএসএস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে লাম্বা-বাদি গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি হয়েছে। তার কারণে পার্বত্য চুক্তির প্রাক্কালে ও পরে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্তি এসেছে। সর্বশেষ তার নিজের দল জেএসএসের মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভাঙন ও সংস্কারবাদীদের জন্মের পেছেনেও তার স্বেচ্ছাচারী আচরণই দায়ি।

শুধু তাই নয়, সন্তু লারমার ফ্যাসিস্ট নীতি অন্যান্য জাতিসত্তাগুলোকে আন্দোলনে কাছে টানার বদলে দূরে ঠেলে দেয়। ১৯৮০ দশকে শান্তিবাহিনী নিজেদের কৃত ভুল স্বীকার না করে উল্টো একটি ম্রো গ্রামে বর্বরোচিত সশস্ত্র হামলা চালিয়ে অনেক ম্রোকে হত্যা করেছিল। এতে স্বাভাবিকভাবে জেএসএসের আন্দোলন সম্পর্কে ম্রোদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা জন্মে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তখন এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নেয়। অপরদিকে জেএসএস আর কোন কালে ম্রোদেরকে আন্দোলনে তাদের পাশে পায়নি।

আজ যে কেএনএফ সৃষ্টি, তার পেছনেও রয়েছে সন্তু লারমার উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট নীতি। অনেকের হয়তো মনে থাকবে, কয়েক বছর আগে তিনি আঞ্চলিক পরিষদ থেকে একটি নির্দেশনামা জারি করেছিলেন, যাতে বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল পাহাড়ি সম্প্রদায়কে চৈত্র সংক্রান্তি উসবকে ‘বিজু’ নামে পালন করতে হবে। নিঃসন্দেহে এই নির্দেশ ছিল তার উগ্র চাকমা জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিরই নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ, যা মানাবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে শেখ মুজিবর রহমানের দেয়া বাঙালি হয়ে যাওয়ার নির্দেশকেই মনে করিয়ে দেয়। তবে আমাদের সৌভাগ্য হলো, ইউপিডিএফ ও অন্যান্যদের তীব্র প্রতিবাদ ও বিরোধীতার মুখে সন্তু লারমা তার উক্ত উগ্রজাতীয়তাবাদী নির্দেশ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। (আমাদের প্রশ্ন হলো, বৈসাবি নাম দিয়ে জাতিসত্তাগুলো নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হলে, তাদের মধ্যে এভাবে কমন কালচারাল বন্ড সৃষ্টি হলে, তাতে তার ক্ষতি বা সমস্যা কী? সেও কি বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদী শাসকগোষ্ঠীর মতো জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি করে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে চায়?)

যাই হোক, আমাদেরকে বাঁচতে হলে অবশ্যই ঐক্যের পথের এই প্রতিবন্ধকতাগুলো মোকাবিলা করতে হবে। অর্থা একদিকে শাসকগোষ্ঠীর ভাগ করে ধ্বংস করার বা জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির নীতি এবং অন্যদিকে সন্তু লারমার উগ্রজাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাচারী ও ফ্যাসিস্ট নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। পাহাড়ের সকল জাতিসত্তার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে দমন করা কোন শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব হবে না।

শেষে বলবো, বমরা হলো একটা কাঠি; অনুরূপ ম্রো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ... প্রত্যেক জাতিসত্তাও হলো এক একটা কাঠি। আলাদা আলাদা করে এই প্রত্যেকটি কাঠি যে কোন সরকার সহজে ভেঙে ফেলতে পারবে। কিন্তু তারা অর্থা পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি কাঠি যদি এক জোট হয় এবং সংগ্রাম করে, তাহলে কে সেই কাঠিগুলো ভাঙতে পারবে? United We Stand, Divided We Fall. এ কথা যেন আমাদের সব সময় মনে থাকে। (সমাপ্ত)

* লেখাটির সৌজন্যেইউপিডিএফের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments