""

বান্দরবানে বম জাতিসত্তার জনগণকে গণগ্রেফতার ও গণহয়রানি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া

গণগ্রেফতারের চিত্র

নিজস্ব প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০২৪

বান্দরবানে সম্পতি গত ২ ও ৩ এপ্রিল একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত [যাদেরকে কেএনএফ বলে দাবি করা হচ্ছে] কর্তৃক রুমা ও থানচি উপজেলায় পর পর ব্যাংকে ডাকাতি, ম্যানেজারকে অপহরণ ও পুলিশ-আনসারের অস্ত্র লুটে নেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী সম্মিলিতভাবে অভিযান পরিচালনা করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী প্রধানের রুমা-থানচি পরিদর্শন শেষে নির্দেশ জারির পরপরই এই অভিযান শুরু করা হয়েছে। আজ বুধবার (১০ এপ্রিল ২০২৪) পর্যন্ত রুমা ও থানচি এলাকা থেকে বম সম্প্রদায়ের অন্তত ৬০ নারী-পুরুষকে গ্রেফতারের খবর পাওয়া গেছে। তবে গ্রেফতারকৃতরা বেশিরভাগই রুমা এলাকার বাসিন্দা। যদিও অন্য একটি সূত্র মতে গ্রেফতারের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। অনেকেকে এখনো যৌথবাহিনীর হেফাজতে রাখা হয়েছে।

এসব গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, অন্তঃসত্তা নারী, খেলোয়াড়, চাকুরীজীবী, শিক্ষক, বাগানচাষী, দিনমজুরও রয়েছেন। ইতোমধ্যে নারীসহ ৫২ জনকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণের তথ্য পাওয়া গেছে।

এছাড়া সেনাবাহিনী ও প্রশাসন স্থানীয় জনগণকে চাউলসহ জিনিসপত্র কেনা ও পরিবহনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

যৌথ বাহিনী কর্তৃক এই গণগ্রেফতার ও গণহয়রানি বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অনেকে রুমা ও থানচিতে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত আখ্যায়িত করে এটি একটি সাজানো নাটক বলেও মন্তব্য করেছেন।

থুইক্যচিং মারমা তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, “টিনা বম, আজেম বমসহ (আরেকজনের নাম জানিনা) ৩ জন বম ছাত্রী ঢাকা সাভার সেন্ট যোসেফ কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্রী। উক্ত ৩ জন বম ছাত্রী পহেলা বৈশাখ ছুটিতে গ্রামের বাড়ি ফিরছিলেন এবং তাদের ৩ জনকে বিনা অপরাধে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কেএনএফ-এর সশস্ত্র নারী শাখা সদস্য হিসেবে ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদের অপরাধ কি? বম জাতি মানেই কেএনএফ হতে হবে এমন নয়! এটা কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? রুমা এবং থানচি উপজেলায় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় মোট ৮ টা মামলা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করুন এটা সবার দাবি। কিন্তু যারা নিরীহ নিরপরাধ তাদেরকে অযথা কেন হয়রানি করছেন? অবিলম্বে আটককৃত ৩ জন কলেজ ছাত্রীকে নি:শর্তে মুক্তি দিন”।

Dear kiki নামের একজন লিখেছেন, ‍“বম সম্প্রদায়ের হওয়াটা কি তাদের অপরাধ হয়ে গেল?

কেএনএফ জন্য সমগ্র জাতিকে কেন এর দায় বহন করতে হবে!

বলছি এই কারণে বিগত বছরে এইচ.এস.সি পরীক্ষা চলাকালীন আমি আমার কাজের সূত্রে যখন রুমায় বাসে করে যাচ্ছিলাম তখন একই বাসে অবস্থানরত বম সম্প্রদায়ের এক পরীক্ষার্থী ও অন্যান্য যাত্রী। তো ঘটনা ঘটল হচ্ছে চেক পোস্টে গিয়ে। বাসে অবস্থানরত সবাইকে চেক করার পর ছেড়ে দেওয়া হয় কিন্তু বম সম্প্রদায়ের কিছু লোক এবং ওই পরীক্ষার্থীকে অনবরত জেরা করতে থাকেন।

আর বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক লুট ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় রুমা থেকে আটককৃত করা হয় ৪৯ নারী ও পুরুষের নামের তালিকা। যার মধ্যে কিছু শিক্ষার্থীও রয়েছে। যা জনসাধারণকে হয়রানি ছাড়া কিছুই নয়।

এখন অনেকে বলতেই পারে নিরব ভূমিকা পালন করে, ওরা হয়তো সমর্থন দেওয়ার সমান তাই না? তাই বলে এই নয় যে আমি, আপনি আমাদের মত জনসাধারণকে গনহারে ধরার অধিকার রাখেন। এই মান হানির দায় কি প্রশাসন নিবেন?

এভাবে গণহারে না ধরে আসল অপরাধীকে ধরলে জনসাধারণ এবং পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসী শান্তিতে বসবাস করতে পারবে এবং প্রতিনিয়ত কোনোদিক থেকেই হয়ারানির শিকার হতে হবে না আর।

তিনি আরো লেখেন, অনেকে পাহাড়ের সম্পর্কে না জেনে গণহারে ধরাটাকে প্রশাসনকে সর্মথন করা বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু একবারও ভেবে দেখেছেন কি এ ধরাটার মধ্যে আমাদের মত জনসাধারন আমি,আপনি,আপনার পরিবারের কৈউ যদি থাকতো তাহলে আপনি কতটা যোক্তিক বলে মনে করতেন!

তাই প্রসাশনের প্রতি অনুরোধ বাবার,ছোট ভাই-বোনের সমতুল্য এদেরকে অপরাধী প্রমান না হওয়া অবধী প্রেসের সামনে এনে মানহানি না করা হোক এবং গনহারে না ধরে মূল অপরাধীকে ধরলে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে।

আমার মন্তব্যে যদি কারোর মনে আঘাত প্রাপ্ত হয় তাহলে এ ছোট মানুষটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

বিঃদ্রঃ আমি কখনো লিখালিখি করিনা।কিন্তু আজ পারলামনা।একজন শিক্ষার্থীর মনে ও তার জীবনে এটার প্রভাব যে কতটা ফেলতে পারে তা শুধু ওই নিরীহ ও নিরাপরাধ শিক্ষার্থীরা বুঝে”।

এশিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়ন সুর কৃষ্ণ চাকমা (Sura Krishna Chakma) লিখেছেন“বান্দরবানে কিছু নিরীহ মানুষকে ধরপাকড় করা হচ্ছে যতটুকু খবর নিয়ে জানতে পেরেছি। তার মধ্যে জাতীয় দলের একজন জিমন্যাস্টিক খেলোয়াড় রয়েছে এবং কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ছুটিতে বাড়িতে আসছে। অবিলম্বে নিরীহ মানুষদের স্ব-সম্মানে মুক্তি দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি”।

তিনি গ্রেফতার হওয়া জিমন্যাস্টিক খেলোয়াড় ও শিক্ষার্থীদের ছবিও জুড়ে দিয়েছেন তাঁর স্ট্যাটাসের সাথে।


সাইদিয়া গুলরুখ (Saydia Gulrukh) তাঁর ফেসবুকে লেখেন,  “সাম্প্রতিককালে নাটক লেখা এবং মঞ্চস্থ করার ক্ষেত্রে সরকার এবং তার আজ্ঞাবাহী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জুড়ি নাই। বান্দরবনে কুকিচিং [কুকি-চিন]-এর ব্যাংক ডাকাতি, তপরবর্তী সেনা অভিযান, আদিবাসীদের গ্রেপ্তারের হিড়িক প্রশ্নে সরকারি/সামরিক বয়ানই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ছবি দেখে এবং বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর নিপীড়নের ইতিহাস মাথায় রেখে বলছি: নাটক সাজিয়ে সাধারণ আদিবাসীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, হয়রানি জায়েজ করা যায় না। পাহাড়ে সেনাবাহিনীর দমন পীড়ন বন্ধ কর।“



Abdullah Mahfuj Ove নামের একজন লিখেছেন, ...বান্দরবানে যা হচ্ছে তা নিয়ে সচেতন-অচেতন কারোই কোন উদ্বেগ নাই। এইটা যেন আমোদ প্রমোদ আর ভ্রমনের এলাকা বাদে আর কিছুই না।

কেএনএফ ইস্যুতে সেখানে গণ গ্রেপ্তারের অভিযোগ উঠেছে। ছুটিতে গ্রামে যাওয়া শিক্ষার্থীদের হয়রানি-আটক-গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

তিনি কয়েকজনের অভিযোগ তুলে ধরে লেখেন, এশিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়ন সুরা কৃষ্ণ চাকমা লিখেছেন- অনেক নিরীহ মানুষের পাশাপাশি গ্রেপ্তার করা হয়েছে জাতীয় জিমনাস্টিকের খেলোয়ারকেও।

রিয়োং ম্রো নামে একজন লিখেছেন- পাঁচ কেজির বেশি চাল নিয়ে চিম্বুক রুমা থানচি রোড দিয়ে কোন গ্রামবাসীকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। এসব অঞ্চলের মানুষ ৫ কেজি চালের বেশি তার গ্রামে নিতে পারছে না। মাইলের পর মাইল পারি দিয়ে দূর্গম পাহাড় ঝিড়ি পাড়ি দিয়ে, পরিবহন খরচ বহন করে এই নিরীহ গ্রামবাসীকে কি তাহলে প্রতিদিন বাজারে আসতে হবে চাল কিনতে?


থুইক্যা সিং লিখেছেন, বৈশাখের ছুটিতে সাভার সেন্ট জোসেফ কলেজের তিন ছাত্রী বাড়ি ফিরছিলেন তাদেরও গ্রেপ্তার করে কোর্টে চালান দেয়া হয়েছে।

এখন পাহাড়ে উসবের সময়বৈসু/ বিহু/ বিজু / সাংগ্রাই। পাহাড় ছেড়ে যারা পড়তে এসেছে , কাজে এসেছে তারা যখন বাড়ি ফিরছে কিংবা ফিরতে চাইছে , তারা কি পৌছাতে পারবে? না পথেই আটক হবে এই আত্মঙ্ক এখন সর্বত্র। শুনেছি ভয়ে অনেক গ্রাম জন শূন্য।

সাংবাদিক হিমেল চাকমা তার এক স্ট্যাটাসে গ্রেফতারের বিষয়ে বলেন, ... ‍“ব্যাংক ডাকাতি ঘটনার পর ৪৫ জনের অধিক গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের অপরাধ তাঁরা বম। গ্রেফতার হওয়া অনেকের মধ্য গর্ভবতী আছেন। স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র আছে। সরকারি চাকরিজীবী আছে। কতিপয় সন্ত্রাসীর জন্য পুরো বম জনগোষ্ঠীকে গ্রেফতার হতে হবে কেন? আমি জানি বমদের চাওয়া পাওয়া একেবারে নগণ্য। তারা জেলখানায় যেতে চায় না। তারা শান্তি চায়”...।

রিয়োং ম্রো তার ফেসবুকে পর পর দুটি স্ট্যাটাসে জনগণকে হয়রানির অভিযোগ করেছেন।

প্রথম স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‍“বান্দরবান থেকে চিম্বুক, রুমা,থানচি রোড দিকে ৫ কেজি এর বেশি চাউল কিনে নিয়ে যেতে পারবেনা বলেই গাড়ি আটকে দিয়েছে বান্দরবানে মিলনছড়ি পুলিশ।  এটা কিছের ইঙ্গিত দিচ্ছে? সমস্যা যত কেএনএফ সাথে, সাধারণ জনগন কি এখন না খেতে পেয়ে মরবে? কেএনএফ কি সাধারণ জনগন দ্বারা পরিচালিত নাকি? এখন চিম্বুক, রুমা, থানচি এরিয়া প্রায় হাজার হাজার জনগন কি এই পাচঁ -পাচঁ কেজি চাউল নেওয়ার জন্য, বান্দরবানে বার বার যাবে? একটা পরিবার ৫ কেজি চাউল কতবেলা বা খাবে? কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়া, হঠা গাড়ি থামিয়ে চাউল ফেরত নিয়ে যেতে হচ্ছে এমনটা কেন?”



আরেকটি স্ট্রাটাসে একই অভিযোগ করে তিনি লেখেন, “চিম্বুক, থানচি,রু মা এরিয়া দিকে পাঁচ কেজি এর অধিক চাউল নিতে পারবেনা। আজ আবারো পুলিশ গাড়ি আটকে দিয়েছে, সরকার পক্ষ হতে যে ইঙ্গিত দিচ্ছে।  মনে হয়, সবাই মিলে সাড়া দেওয়ার দরকার। যেকোনো ইঙ্গিত এই সাড়া দেওয়াটায় জরুরি...। অনেকে বলবে, এই নিয়ে আমি খুব মাতামাতি করছি, দেখুন চিম্বুক থেকে বান্দরবান পর্যন্ত যাওয়া আসা করতে ২৬০ টাকা খরচ দরকার। তাহলেই, আমরা কি ২৬০ টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে প্রতিদিন ৫ কেজি করে চাউল নিয়ে আসবো?”


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।












0/Post a Comment/Comments