""

বান্দরবানে যৌথ অভিযানের নামে নিরীহ গ্রামবাসীদের গণগ্রেফতার : রাষ্ট্রের দায়হীনতা

মুক্তমত


সোহেল চাকমা


পার্বত্য অঞ্চলে বম জাতিগোষ্ঠী তথা পাহাড়ি জনগণ দেশের নাগরিক হিসাবে তাদের নিরাপত্তা ও ভালোমন্দ দেখাশোনা করার দায়িত্ব সরকার তথা রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। অথচ তা না করে সরকার সেনাবাহিনীর একপাক্ষিক ঘৃণ্য কার্যক্রমকে প্রকাশ্যে মদত দিয়ে যাচ্ছে। যা রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বহীনতারই পরিচয়। দেশের আপামর জনগণও বম জাতিসত্তার উপর বর্বরোচিত নিপীড়ন-নির্যাতনকে মুখবুঝে সহ্য করে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। যা দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু জাতির উপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অন্যায়, অবিচারকে বৈধতা দেওয়ার সামিল! আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। 

রুমায় নারীদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। #ফাইল ছবি

গত ২ ও ৩ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় ব্যাংক ডাকাতি ও পুলিশ-আনসারদের অস্ত্রলুটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী বেশ তপর হয়ে ওঠেছে। তথাকথিত ‌‘কেএনএফ সন্ত্রাসী’ ধরার নামে ৫ এপ্রিল থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান। এ অভিযানকে কেন্দ্র করে প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলোকেও বেশ সরব দেখা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাংক ডাকাতির খবর নানাভাবে ছড়িয়েছে। যার ফলে দেশের ব্যাপক জনসাধারণের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানাধরণের বিভ্রান্তি। জনমনে তৈরি করেছে বিভিন্ন প্রশ্নও। এ ঘটনার সত্যতার যাচাই-বাছাই জনসম্মুখে আসা প্রয়োজন।

প্রথমে বলে রাখা দরকার, বান্দরবানের সংঘটিত ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা পুরোটাই সেনা-প্রশাসনের কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এবং তা আজ দিবালোকের মতই পরিস্কার। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর যৌথ সাঁড়াশি অভিযানের মূখ্য উদ্দেশ্যই হল নিরীহ বম জাতিসত্তার উপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন। কেননা এতে সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাইয়ের কোন সুযোগ নেই। তার অর্থ হল এই, যেখানে নিপীড়নই একমাত্র মূখ্য সেখানে দেশের আইন-আদালত, সংবিধান কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে। ৬ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বান্দরবানে গিয়ে এক মতবিনিময় সভায় কেএনএফ দমনের নামে রাষ্ট্রীয় যৌথ অভিযানের ঘোষণা দিয়ে কার্যত নিরীহ বম জাতিসত্তাদের ওপর সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনকেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে আসলেন। যা তীব্র নিন্দনীয় ও দুরভিসন্ধিমূলক। এখন অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, যৌথ অভিযানের শেষ পরিণতিও সেনাবাহিনীর উপরই নির্ভর করছে। তারা যেভাবে চায় সেভাবেই এই অভিযানের ইতি ঘটানো হবে!

বিশেষত, নাটকীয় ব্যাংক ডাকাতির পরবর্তী যৌথ অভিযানের নামে বান্দরবানের বম জাতিসত্তাগুলোর ওপর নির্বিচারে গণগ্রেফতার, ধরপাকড়, মিথ্যা মামলা একদিকে যেমন নিরপরাধ গ্রামবাসীদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যপণ্য ক্রয়ের নিষেধাজ্ঞা, সেনাবাহিনী চেকপোস্টে আটকিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি তাদের জীবনকে দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দিয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চিম্বুক, থানচি ও রুমা এলাকার দিকে ৫ কেজির অধিক চাউল ক্রয় ও বহন না করার নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে। ভাতের উপর নির্ভরশীল পাহাড়িদের জন্যে ৫ কেজি চাউল দিয়ে বড়জোর ৩-৪ দিন যোগান দেওয়া সম্ভব হতে পারে। চিম্বুক থেকে বান্দরবান শহর পর্যন্ত যাতায়াত বাবদ খরচ হয় ২৬০ টাকা করে। দুর্গম অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়ি জাতিগুলোর জন্যে আয়ের দিক থেকে প্রত্যেকবার ২৬০ টাকা খরচ করে বান্দরবান শহরে এসে ৫ কেজি চাউল ক্রয় করে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

তথ্যমতে, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ সাঁড়াশি অভিযানের নামে কেএনএফ আখ্যা দিয়ে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের অনেকের মধ্যে রয়েছে স্কুল, কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী। যারা রোজার ছুটিতে বাড়িতে এসেছে ছুটি কাটানোর জন্যে। এ পর্যন্ত ৬০ জনের অধিক বম জাতিসত্তার নারী-পুরুষকে গ্রেফতার করে হাজতে পাঠানো হয়েছে। যেখানে একজন জাতীয় দলের জিমনাস্টিক খেলোয়াড় ও একজন গর্ভবতী মহিলাও রয়েছেন। palian 4 নামে এক ফেসবুক পেইজে এমনও তথ্য রয়েছে, ১১ এপ্রিল নবজাতক থেকে শুরু করে ৭০ বছরের বয়োবৃদ্ধ নারীদের তীব্র রোদে দাঁড় করিয়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। যা ছবিসহ সেখানে প্রকাশ করা হয়েছে। বস্তুত, তথাকথিত কেএনএফ সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে বম জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণপ্রেফতার ও দ্রব্যপণ্য ক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপণ-রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এমন অমানবিক নির্যাতন ৭১ সালের পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানায়!

গণগ্রেফতারের শিকার শিক্ষার্থীরা। #সংগৃহিত ছবি

চ্যানেল ২৪ নিউজের ভাষ্যমতে, রুমা ও থানচিতে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় রুমায় ৫টি ও থানচিতে ৪টি করে মোট ৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৯টি মামলায় মোট ৬৬ জনকে আটক করা হয়েছে। তন্মোধ্য রুমা ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্রলুট মামলায় ৫২ জনকে এবং থানচিতে ২ জনকে ২দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে বান্দরবান চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। সবকিছু যেন রাষ্ট্রের নাকের ডগায় নীরবে ঘটছে। এতজন মানুষকে আটক করা হল, কারাগারে পাঠানো হল অথচ কেউ কিছুই বলতে পারল না! এটাকে ঠিক কি বলে আখ্যায়িত করা যায়? উদ্ভট সেনার পীঠে চলছে স্বদেশ?

রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কথিত যৌথ সাঁড়াশি অভিযানের নামে বান্দরবানে ঢালাওভাবে কোন বাছ-বিচার ছাড়া নিরপরাধ গ্রামবাসীদের যেভাবে ধরপাকড় ও গ্রেফতার করা হচ্ছে তাতে ব্যাংক ডাকাতির প্রকৃত ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে বম জাতিসত্তাগুলোর ওপর রাজনৈতিক দমন-পীড়নই মূখ্য হয়ে ওঠছে। সর্বশেষ দেখা গেছে, ১৭ই এপ্রিল রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের ধুপানিছড়া এলাকা থেকে সেনাবাহিনী কর্তৃক ৮জন ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে আটকের ঘটনাটি তার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গ্রেফতারকৃত ত্রিপুরা গ্রামবাসীদেরকে সরাসরি কেএনএফ সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করা হয়। এবং কিছু গাদা বন্দুকসহ ৮জনের ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে ১৮ এপ্রিল প্রথম আলো সংবাদপত্রপত্রে প্রকাশিত এক রিপোর্টে ৮জন ত্রিপুরার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে র‌্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন বলেন, ত্রিপুরাদের মধ্যে কেউ কেএমএফের সঙ্গে জড়িত কিনা, তা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮ জন ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের আটক করা হয়েছে। পরবর্তীতে জানা গেছে, সেনাবাহিনীর আটককৃত ৮জন ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে নিরীহ গ্রামবাসীদের ধরে তথাকথিত কেএনএফ সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা এবং শারিরীক ও মানসিকভাবে হয়রানি করে, নির্যাতন করে কোন জবাবদিহিতা ছাড়া ছেঁড়ে দেওয়া এটা নিছক সাধারণ পাহাড়ি জনগণের উপর রাজনৈতিক দমন-পীড়ন উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু নয়!

১৮ এপ্রিল জাগো নিউজ ২৪ ডটকমে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্ডকার আল মঈনকে RAB থেকে ছড়িয়ে নৌবাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এর পূর্বে র‌্যাবের মুখপাত্র হিসেবে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বান্দরবানের ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, কেএনএফ সদস্যরা অর্থ সংকটে ভুগছিলেন এবং সেটা তারা আমাদেরকে অবগত করেছেন। এরপরই দেখা যায় তাকে র‌্যাবের মুখপাত্র জায়গা থেকে ছড়ানো হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে কথিত যৌথ অভিযানের নামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী বান্দরবানে বম জাতিসত্তাগুলোর ওপর যা করছে দেশের আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তা নিতান্তই বর্বরতা। এছাড়া হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রামবাসীদের গণগ্রেফতার, কারাগারে প্রেরণ ও সাজানো নাটক প্রদর্শন করে দেশের আপামর জনগণের সম্মুখে তা উপস্থাপন একটি হাস্যকর ব্যাপার! একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্যে এটি কলঙ্কজনকও বটে।

ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুন্ঠনের প্রকৃত ঘটনার রহস্য উদঘাটন না করে এভাবে নির্বিচারে নিরপরাধ গ্রামবাসীদের ধরপাকড়, গণপ্রেফতার ও হয়রানির পর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রের প্রতি, রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলার প্রতি পাহাড়ি জনগণের অনাস্থা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ তৈরি হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়! পুলিশ ও বিজিবি'র কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে প্রকাশ্যে দিবালোকে এমন ভয়াবহ সাহসী ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা আমরা ইতিহাসে খুব কমই দেখতে পাই। রাষ্ট্রের উচিত ঢালাওভাবে নিরীহ গ্রামবাসীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন না করে ব্যাংক ডাকাতির প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করা। যে কেএনএফ এর বিরুদ্ধে এর পূর্বেও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে সেই কেএনএফ সদস্যরা গাদা বন্দুক হাতে কীভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর রেঞ্জের মধ্যে প্রকাশ্যে ব্যাংক ডাকাতি করার সাহস পায়? সর্ষের মধ্যে যদি ভূত না থাকে এটা তো অকল্পনীয় ব্যাপার! কিংবা যদি কোন সুযোগ উন্মুক্ত থাকে তাহলে এ রকম ঘটনা ঘটাতাই স্বাভাবিক বরঞ্চ না ঘটাতাই তখন অস্বাভাবিক বলে মনে হবে। ব্যাংক ডাকাতির পেছনে প্রকৃত কারা জড়িত? কাদের অঙ্গুলি হেলনা তা ঘটল- দ্রুত তদন্ত করা হোক এবং ঘটনায় সম্পৃক্ত অপরাধীদের গ্রেফতার ও যথাযথ বিচার কার্যকর করা হউক।

পার্বত্য অঞ্চলে বম জাতিগোষ্ঠী তথা পাহাড়ি জনগণ দেশের নাগরিক হিসাবে তাদের নিরাপত্তা ও ভালোমন্দ দেখাশোনা করার দায়িত্ব সরকার তথা রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। অথচ তা না করে সরকার সেনাবাহিনীর একপাক্ষিক ঘৃণ্য কার্যক্রমকে প্রকাশ্যে মদত দিয়ে যাচ্ছে। যা রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বহীনতারই পরিচয়। দেশের আপামর জনগণও বম জাতিসত্তার উপর বর্বরোচিত নিপীড়ন-নির্যাতনকে মুখবুঝে সহ্য করে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। যা দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু জাতির উপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অন্যায়, অবিচারকে বৈধতা দেওয়ার সামিল! আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। অবিলম্বে তথাকথিত যৌথ অভিযানের নামে বম জাতিগোষ্ঠীর উপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমন-পীড়ন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা হোক। একই সাথে নির্বিচারে গ্রেফতারকৃত নিরীহ, নিরপরাধ গ্রামবাসীদের ওপর দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, ধরপাকড় ও তাদেরকে জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া হোক। অধিকন্তু, পাহাড়িদের উপর জুলুম, জোরজবরদস্তি না করে নির্ভয়ে, নিরাপদে থাকতে দিন। এতে দেশের ভাবমূর্তি ও শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ থাকবে। #


[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত]


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments