""

পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন নয়, স্বায়ত্তশাসন প্রয়োজন

মুক্তমত


সোহেল চাকমা





 ভূমিকা

ইতিহাস পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী ধারণা এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ব্রিটিশ সরকার, মধ্যবিত্তের শ্রেণীস্বার্থ ও ক্ষমতালোভ। ব্রিটিশরা শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যে একদিকে যেমন সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় পুরো ভারতবর্ষকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিল অন্যদিকে জনগণের সংগঠিত শক্তিকে ভয় ও চ্যালেঞ্জিং মনে করে তারা দেশটাকে ভাগ করতেও পিছপা হয়নি। প্রবর্তন করেছে দ্বিজাতিতত্ত্ব। সেসময়ে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিজাতিতত্ত্ব একটি ভ্রান্ত ও অমূলক ধারণা ছিল তা ব্রিটিশরাও বুঝেছিল। এমনকি তৎকালীন যারা ভারতবর্ষের জনগণের তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের এটাও দৃষ্টিগোচর না হয়ে উপায় ছিল না যে হিন্দু ও মুসলিম ছাড়াও ভারতবর্ষে বহুধর্ম ও বহু ভাষাভাষির মানুষের বসবাস ছিল।  কিন্তু শ্রেণী সংগ্রাম তথা সামাজিক বিপ্লবের ভয়ে তারা দ্বিজাতিতত্ত্বকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছে। 

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ মূলত একটি ক্ষমতালিপ্সু শ্রেণীর এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিনিধিত্বেরই প্রতিফলন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, জাতীয়তাবাদ একটি অনুভূতির ব্যাপার, যার ভেতর স্বপ্ন থাকে, আকাঙ্ক্ষা থাকে, কাজ করে স্মৃতি। জাতীয়তাবাদের একটা বস্তুগত ভিতও থাকে। সেই ভিতটি একাধিক উপাদান নিয়ে তৈরী হয়। যার মধ্যে রয়েছে ভাষার, স্থানের, ধর্মের ও অর্থনৈতিক জীবনের ঐক্য। তিনি বলেছেন, এ চারটি উপাদানের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ভাষা। মূলত এ ভাষার মাধ্যমেই একটি জাতির স্বতন্ত্রভাবে পরিচয় ঘটে। স্ট্যালিন বলেছেন, জাতিগঠনের জন্যে ভাষা এবং ভূমির ঐক্যের সঙ্গে দরকার হয় অর্থনৈতিক সংযোগ এবং মানসিক গড়নের ঐক্য,  যা সংস্কৃতিগত ঐক্যের মধ্যে দিয়ে তা প্রকাশিত হয়। ৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর জাতীয়তাবাদের যে ভাবধারা গড়ে ওঠেছে সেখানে ভাষা তো স্থান পায়নি উল্টো সাতচল্লিশে ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদের যে ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে দেশ ভাগ হয়েছিল সেভাবেই বাংলাদেশে ধর্মকে মূখ্য করে বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদ'কে গড়ে তোলা হয়েছে। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ও ঐ ভাষার ভিত্তিতেই ঘটেছে। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন যার প্রথম সূচনা। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বাঙালি মুসলিম ব্যতীত অপরাপর জনজাতি ও ভাষাভাষির মানুষকে উপেক্ষা করা হয়েছে। আমরা দেখতে পাই,  বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও ৪৫টির অধিক জাতিসত্তা বসবাস করে। তন্মোধ্য পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে ১০ ভাষাভাষী ১৩টি জাতিসত্তার বসবাস। যাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত উপাদান বাঙালিদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র। এছাড়াও পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত জনজাতিগুলোর মধ্যে একদিকে যেমন ভূমির সঙ্গে অর্থনৈতিক সংযোগ বিদ্যমান তেমনি সংস্কৃতিগতভাবেও পরস্পরের সঙ্গে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এ বোধ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক ও বহুভাষিক দেশ। 

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন দেশে গঠিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে যে আইন তৈরি করেছে সেই ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে পার্বত্য অঞ্চলের বসবাসরত জাতিগুলোর স্বতন্ত্র পরিচয়কে অস্বীকার করে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ চাপিয়ে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশে জাতিগত সমস্যা বৃদ্ধি তো পেয়েছেই তার পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত জনজাতিগুলোর উপর রাজনৈতিক সমস্যা জিইয়ে রেখে রাষ্ট্র পরিচালনায় কায়েম করা হয়েছে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি জাতিসত্তার জনগণ এ রাজনৈতিক উৎপীড়ন থেকে মুক্তি চায়। যার একমাত্র পথ পার্বত্য অঞ্চলে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রদান বা স্বীকৃতি।

যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন ঘটল

পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়নের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিদ্রোহ দমন। দেশের একটা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নিজেদের উচ্চাভিলাষী আকাঙ্ক্ষাকে জিইয়ে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। যার প্রধান কারণ প্রথমে স্বার্থগত, দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর গুরুত্বকে অক্ষুণ্ণ রাখা। পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নে সরকার- শাসকগোষ্ঠী কার্যত সেনাবাহিনীর উপরই নির্ভরশীল। বলা যায়, বাংলাদেশের পুরো রাষ্ট্র ব্যাবস্থাটাই এখন পুঁজিপতি শ্রেণী ও সেনাবাহিনীর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে, ১৮৬০ সালের পূর্বপর্যন্ত আজকের পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন স্বশাসিত রাজ্য ছিল। পার্বত্য অঞ্চল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবেও অতীতে কখনোই চট্টগ্রামের অংশ বা অন্তর্ভুক্তও ছিল না। কিংবা এটিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামেও অভিহিত করা হত না। পর্তুগিজ ঐতিহাসিক জোয়াও ডি ব্যারেজ অঙ্কিত ১৫৫০ সালের মানচিত্রে এ অঞ্চলটিকে ‘চাকোমাস’ নামে চিহ্নিত করেছেন। মুঘল কর্মকর্তারা রাজস্ব দলিল পত্রে পার্বত্য অঞ্চলকে ‘কার্পাস মহল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফার্সি দলিলে এ অঞ্চলটিকে ‘জুম বুঙ্গ বা জুম মহাল’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের প্রথম চীফ এবং জরিপ কর্মকর্তা হেনরি ভেরেল্ট এর বিবরণ অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চল উত্তরে ফেনী, দক্ষিণে শঙ্খ/সাঙ্গু এবং পশ্চিমে নিজাম রোড (বর্তমান ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড) থেকে পূর্বে কুকি রাজ্য ( বর্তমান মিজোরাম ও বার্মার চীন স্টেট) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পার্বত্য অঞ্চলে জেলা গঠনের সময় এর আয়তন ছিল ৬,৭৯৬ বর্গমাইল। লুসাই অভিযানের (১৮৯৩) পর পার্বত্য অঞ্চলকে মহকুমায় পরিণত করা হয়। চাকমা অধ্যূষিত ডেমাগ্রি এলাকা মিজোরামের সাথে জুড়ে দিলে এ জেলার আয়তন দাঁড়ায় ৫,১৩৮ বর্গমাইল। বাংলাদেশ আমলে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সময় ১৯৮৪ সালে রামু উপজেলা কক্সবাজারের সাথে যুক্ত করার ফলে বর্তমান আয়তন ধরা হয় ৫,০৯৩ বর্গমাইল।

স্বাধীন স্বশাসিত রাজ্যে পরাক্রমশালী মুঘল শাসকদের সাথে ১৭২৪ সালে এবং আধিপত্যবাদী ব্রিটিশদের সঙ্গে ১৭৭২ সালে এই অঞ্চলে প্রতিরোধ সংগ্রাম সংঘটিত হয়। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার বাংলার ইতিহাস : ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো গ্রন্থে ‘উপজাতিদের প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে দু-পৃষ্টার একটি আলোচনায় পার্বত্য অধিবাসীদের এই প্রতিরোধ সংগ্রামকে ‘সবচেয়ে চমকপ্রদ ও সুসংগঠিত সফল প্রতিরোধ- আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যাকে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ বলেছেন। দেশভাগের সময় ১৬ আগষ্ট মাউন্টব্যাটেন দিল্লীতে ভারত ও পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদেরকে নিয়ে সীমান্ত কমিশনের রোয়েদাদ বিষয়ে যে বৈঠকটি করেন তাতে নেহেরু পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত নয় তা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল পার্বত্য অঞ্চলে পাঁচ লক্ষের মতো অধিবাসীর শতকরা ৯৮% ই হচ্ছে অ-মুসলিম ; তাই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিবেচনায় অঞ্চলটির উচিত ভারতের অংশ হওয়া। মাউন্টব্যাটেন তখন র‌্যাডক্লিফ কমিশন কোন বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) সাথে যুক্ত করেছে তা উল্লেখ করে বলেন, প্রথম বিবেচ্য বিষয়টি হচ্ছে অর্থনৈতিক, অপরটি চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যত। মাউন্টব্যাটের ভাবনা চট্টগ্রাম বন্দরকে রক্ষা করার জন্য কর্ণফুলী নদীর রক্ষণাবেক্ষণ আবশ্যক এবং ঐ নদীটি যেহেতু পার্বত্য এলাকার ভেতর দিয়েই প্রবাহিত তাই অঞ্চলটিকে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করাই সঙ্গত। এছাড়া সভায় পাকিস্তান প্রতিনিধি ফজলুর রহমান পূর্ববঙ্গের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক সংলগ্নতার কথা উল্লেখ করেন। মাউন্টব্যাটেনের এই যুক্তি পূর্ববঙ্গের জন্যে আশির্বাদস্বরুপ হলেও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতবর্ষে শতকরা ৯৮ জনের অধিক অমুসলিম অধ্যূষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা কোন ন্যায়সঙ্গত বিষয় নয়। তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক বিষয়ে পূর্ববঙ্গের জন্যে যদি এতই ভাবতেন তাহলে ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে কেন দেশভাগ করা হল ? মূলত স্বার্থগত বিবেচনায় ব্রিটিশ শাসকরা গোপন বোঝাপড়া ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যচৌর্যের ভিত্তিতে শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ‘পাঞ্জাব’ কে ভারতের সাথে সংযুক্ত করার বদলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয়। কারণ ভারতের জন্যে পাঞ্জাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এরপূর্বে ব্রিটিশদের প্রদত্ত  Chittagong hill tracts regulation 1900 act আইনে পার্বত্য অঞ্চলকে excluded area বা বহির্ভূত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই আইন ১৮৬০ থেকে ১৮৯২ সালে প্রণীত আইনি বিধিসমূহ পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত আকারে সংকলিত হয়েছিল। এটি তৎসময়ের আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বের সাথে সামন্তপ্রথার মিশ্রণে প্রণীত এক আইন। যা সংক্ষেপে 1900 Act বা Hill tracts mannual নামে সমধিক পরিচিত। ১৯২১ সালেও পার্বত্য অঞ্চলকে ‘অনগ্রসর এলাকা’ এবং ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনে ‘সম্পূর্ণ বহির্ভূত এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাহাড়িদের জন্যে সংরক্ষিত রাখা হয়। এতদসত্ত্বেও ভারত-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্ত হওয়ার দু’দিন পর ১৭ই আগষ্ট পার্বত্য অঞ্চলকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করে তা ম্যাপে প্রদর্শন করা হয়। যা নিতান্তই পাহাড়িদের সাথে অন্যায় ও প্রতারণা। ব্রিটিশদের প্রতারণা পরবর্তীতে পাহাড়িদের জীবনে এক মস্তবড় অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। 

পার্বত্য অঞ্চল পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পর পাকিস্তান সরকার বছর পেরুতে না পেরুতেই ১৯৪৮ সালে ফ্রন্টিয়ার্স পুলিশ এ্যাক্ট (১৮৮১) বাতিলের মাধ্যমে পাহাড়িদের নিয়ে গঠিত পুলিশ বাহিনী ভেঙ্গে দেয়। যদিও পাকিস্তানের প্রবর্তিত প্রথম সংবিধানে পার্বত্য অঞ্চলকে ‘সম্পূর্ণ বহির্ভূত এলাকা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। ১৯৬২ সালের প্রণীত সংবিধানেও দেখা যায় পার্বত্য অঞ্চলের বিশেষ মর্যাদা আইন অক্ষুন্ন রাখা হয়। তবে এ পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে চিহ্নিত করা হয় ‘ট্রাইবাল এরিয়া’ হিসেবে। এরপর পাকিস্তান সরকার ১৯৬৩ সালে ঢাকা হাইকোর্ট হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েলের ৫১ ধারা বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বহিরাগত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ৬৪/৬৫ সালে পাহাড়ি অফিসারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে বদলী, এশিয়ার সর্ববৃহৎ কর্ণফুলী পেপার মিল, রেয়ন মিল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাহাড়িদের সাথে প্রতারণা করে। ষাট দশকের কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণও পাহাড়িদের জনজীবনে এক ভয়াবহ ট্রাজেডি! কোনটিতেই পাহাড়িদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়নি বরং তাদের জীবনচার সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ও সর্বনাশ হয়েছে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান আমলে যেটুকু প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা বজায় ছিল ৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাও রক্ষিত থাকেনি। 

শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে  ‘বিশেষ অঞ্চল’ হিসাবে মর্যাদাদান তো দূরের কথা, জাতিসত্তার স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয় নি। মহিউদ্দিন আহমদ তার শান্তিবাহিনী জিয়া হত্যা মনজুর খুন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “৪ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে তৎকালীন চাকমা রাজা রায় ত্রিদিব রায় যখন শেখ মুজিবের সঙ্গে ধানমন্ডির বাসায় দেখা করেন তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংবিধানিক মর্যাদার বিষয়টি আলোচনা করার চেষ্টা করলে শেখ মুজিব আলোচনা ঘুরিয়ে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কথা বলতে থাকেন। তিনি জানাচ্ছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য সাংবিধানিক রক্ষাকবচের ব্যাপারে শেখ মুজিবের আগ্রহ ছিল না।  ফলত দেখা যায় ১৯৭৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিব যখন প্রথমবারের মত রাঙামাটি যান, সেখানে পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং মাঠে এক বিপুল জনসভায় ভাষণে পাহাড়িদের বাঙালি হওয়ার নির্দেশ দেন। যা ছিল একটি অভূতপূর্ব ঘটনা।” তুরস্কের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তুর্কিদের পাশাপাশি কুর্দি জনগণও সমানভাবে অংশগ্রহণ করে। তার কারণ ছিল জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী কামাল আতাতুর্ক কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন প্রদানের অঙ্গীকার করেছিলেন। সেজন্য কুর্দিরা তাকে সমর্থন করেন। কিন্তু বিজয় অর্জনের পর কামাল আতাতুর্ক স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি ভূলে গিয়ে উল্টো কুর্দিদের উপর নিপীড়ন শুরু করেন। ৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামীলীগ পাহাড়িদের জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তো ছিলই না, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণেও দেখা যায় বিভক্তি, পাহাড়িদের উপর সন্দেহ, অবিশ্বাস ও বাধাদান। তারপরও স্বাধীন দেশে জীবনের নিরাপত্তার আশায় পাহাড়িরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে কার্পণ্যবোধ করেনি। দেশ স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব কামাল আতাতুর্কের মত নিপীড়কের পথ অনুসরণ করেছেন। ফলে পাহাড়িদের অস্তিত্বের সংকট দিনদিন ঘনীভূত হয়েছে এবং বর্তমানে দুর্দশাগ্রস্থ ও সংকটাপন্ন জীবনযাপনে পাহাড়ি’রা বাধ্য হচ্ছে।

ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পূর্বে ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের কাউন্সিলে গৃহীত লাহোর প্রস্তাবে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের জন্যে এ প্রস্তাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। সেখানে বলা হয়, প্রত্যেকটি ইউনিটের সংখ্যালঘুদের জন্যে সংবিধানে পর্যাপ্ত, কার্যকর এবং অবশ্যপালনীয় রক্ষাকবচ বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে, পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে তারা যাতে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকসহ অন্যান্য অধিকার আদায় করতে পারে। স্বাধীন দেশের সরকার প্রধান হওয়ার পর শেখ মুজিবের কাছে যেন সবকিছু গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তিনি সবকিছু বেমালুম ভূলে যান। এক জাতি, এক দল, এক নেতা নীতি গ্রহণের মাধ্যমে এককেন্দ্রীক ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। যা পরবর্তীতে তাকে বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ) গঠনে উদ্ভুদ্ধ করে। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা যেন অথৈ জলে তলিয়ে যায়। স্বাধীন দেশে তাদের অবস্থান হয়ে ওঠে নিপীড়িত, নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের ন্যায্য দাবী আদায়ের আন্দোলনকে সশস্ত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমনের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে সরকার ‘অপারেশন ড্রাগন ড্রাইভ’ নীতি গ্রহণ করে এবং পরিকল্পিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি সেনানিবাস স্থাপন ও সেনা মোতায়েন করে। মুঘল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকরা যা করেনি সেটা বাংলাদেশ সরকারের দলীয় শাসকরা নির্দ্বিধায় করেছে তা হলো ‘পার্বত্য চট্টগ্রামকে সামরিকায়ন, সামরিকায়নের মাধ্যমে বাংলায়ন’। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী একটি গোষ্ঠী নিজেদের কলেবর বৃদ্ধি, পদোন্নতি ও গোষ্ঠীশক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সামরিকায়ন ও বাংলায়ন করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। তাদের ভাবনা ছিল, পাহাড়িরা যখন নিজেদের অধিকার রক্ষায় আন্দোলন শুরু করবে এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মতোই অস্ত্র হাতে তুলে নেবে তখন এই গোষ্ঠীরই লাভ হবে। যখন পাহাড়িদের দমনের জন্যে সরকার উত্তরোত্তর সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে তখন বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের মতো অনেকটা বাধ্য হয়েই সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে (দেখুন, মহিউদ্দিনের শান্তিবাহিনী জিয়া হত্যা মনজুর খুন- পৃষ্ঠা ১৩৩-১৩৬)। এই ভয়াবহ, ঘৃণ্য পরিকল্পনাটির মূল হোতা ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। বাস্তবত হয়েছেও তাই। পার্বত্য চট্টগ্রামে জ্যামিতিক হারে সেনাবাহিনীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি সমতলের ভূমিলোলুপ সেটলার বাঙালিদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলকে ‘বাংলায়ন’ করার প্রচেষ্টা বহুদূর এগিয়েছে। যেখানে দেশ বিভক্তির সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলিম বাঙালির সংখ্যা ছিল ২%, ২০১১ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০%। পাহাড়ি জনসংখ্যার বিপরীতে অভূতপূর্ব এই মুসলিম বাঙালি সংখ্যা বৃদ্ধি আসলে ‘বাংলায়নেরই’ রুপান্তর। 

আমরা দেখতে পাই, জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই চার লক্ষ বাঙালিকে সমতল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের পর কাউখালি কলমপতিতে পাহাড়িদের উপর প্রথম সংঘটিত হয় নির্মম গণহত্যা। লোগাঙ, লংগদু, নানিয়াচরসহ এযাবৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে ডজনের অধিক গণহত্যা চালানো হয়েছে। যার কোনটির বিচার পাহাড়ি জনগণ পায়নি। খোদ কল্পনা চাকমা’র চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গঙদের দেশের আইন-আদালত গ্রেফতার ও বিচার করতে ব্যর্থ। জিয়াউর রহমান সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় সংবিধানের ৪টি মূল নীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি উপেক্ষা করে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেন এবং স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ অন্তর্ভুক্ত করে তা যথাযথ বাস্তবায়ন করেছেন। বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় একের পর এক শাসক এসেছে কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি জনগণের ভাগ্য বদলায়নি এবং রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানও হয়নি। স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর আঁকড়ায় পরিণত হয়। যার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে বিএনপির শাসনামলেও। আওয়ামীলীগের শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিণত হয়েছে সেনাবাহিনীর ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার কারাগার হিসেবে। ৯৭ সালে কথিত পার্বত্য চুক্তির নামে জেএসএসের সাথে প্রতারণা করে আওয়ামীলীগ সরকার কার্যত সেনা-আমলাতন্ত্রের উচ্চাভিলাষী, কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থকেই রক্ষা করেছে মাত্র। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এই ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারই ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পাহাড়িদের স্বতন্ত্র পরিচয়কে মুছে দিয়ে 'বাঙালি' বানিয়েছে। পক্ষান্তরে, ৭২ সালের সংবিধানে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারাটিকেই পুনরুজ্জীবিত করেছে।

Ø  শাসকগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনে কেন এত ভয়?

দেশের এক দশমাংশ এলাকাজুড়ে বসবাসরত পাহাড়ি জাতিগুলো ব্যবসায়িক পুঁজিপতি শ্রেণীর কাছে বোঝা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ তাদের কাছে অমূল্য রত্নভান্ডার হিসেবে লোলুপদৃষ্ট। সেজন্য বাংলাদেশ সরকার তথা শাসকগোষ্ঠীর কাছে পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে পাহাড়ি জনগণ অত্যাধিক মূল্যহীন। পুঁজিপতি, ব্যবসায়িক শ্রেণীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্রে শাসকগোষ্ঠীর প্রধান কর্তব্য পালন হচ্ছে পুঁজিবাদী অধিপতির শ্রেণীর স্বার্থসংরক্ষণ ও সহযোগিতার মাধ্যমে শ্রেণী স্বার্থকে ত্বরান্বিত করা। পার্বত্য চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোর কেন্দ্রস্থল যা পূর্বেই বলা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণও তাই পুরোপুরি সেনাবাহিনীর কায়েমী স্বার্থবাদী একটি গোষ্ঠীর হাতেই ন্যস্ত। ব্রিটিশ শাসক মাউন্টব্যাটেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে অর্থনৈতিক দিক থেকে পূর্ববঙ্গের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। তিনি পাহাড়িদের স্বার্থের দিকটি বিবেচনা করেননি। দেশের একমাত্র সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরটি যেহেতু কর্ণফুলী নদীর অববাহিকার উপর নির্ভরশীল এবং কর্ণফুলী নদীটির উৎস যেহেতু পাহাড়ি উপত্যকায়- সেহেতু পার্বত্য অঞ্চল'কে পূর্ববঙ্গে অন্তর্ভুক্তির দরকার বলে তিনি মনে করেছিলেন। এ যেন শেয়ালের মুরগী খাওয়ার ফন্দি আঁটার মতো। পার্বত্য অঞ্চলকে নিজ ভূমির জন্যে নিজেই শত্রুতে পরিণত হতে হয়েছে। বলা সঙ্গত যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিকই হচ্ছে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক।

ক. রাজনৈতিক

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোর উপর রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অন্যতম কৌশল হচ্ছে তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি। যার মূখ্য উদ্দেশ্য বিদ্রোহ দমন ও অর্থনৈতিক শোষণ। এই কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি কৌশলে রয়েছে দ্বিমুখী আচরণ। প্রথমত, পাহাড়িদের কাছে সেনাবাহিনীর বিশ্বাস অর্জন। এক্ষেত্রে তারা নামমাত্রিক চিকিৎসা, কম্বল বিতরণ, বিভিন্ন ক্রীড়া অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, সম্প্রীতি কনসার্ট ইত্যাদি কর্মসূচি হাতে নেয়। দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহ দমনে জনমনে আতঙ্ক তৈরী করার জন্যে নিরীহ পাহাড়িদের উপর ধরপাকড়, গ্রেফতার ও নির্যাতন চালায়। অপারেশন উত্তোলন, অপারেশন দাবানল, সাঁড়াশি অভিযান ইত্যাদির নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর বহু অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এতে সাধারণ পাহাড়ি জনগণকে মিথ্যা মামলা দিয়ে, সন্ত্রাসী খোঁজার নামে গ্রেফতার করে সবসময় শারীরিক, আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নে সেনাক্যাম্পের একদল সৈন্য অবাছড়ি গ্রামে গিয়ে দুই মারমা কিশোরীর একজনকে ধর্ষণ ও আরেকজনকে যৌন নিপীড়ন করে। ঘটনার বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায়, “ধর্ষণের পূর্বে ভিকটিমদের মা-বাবাকে অস্ত্র তাক করে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তারপর দুই সেনাসদস্য ঘরের ভিতরে গিয়ে কিশোরীদের ধর্ষণ ও নিপীড়ন করে।” এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেলেও ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট কোন সেনাসদস্যকে গ্রেফতার ও বিচার করা হয়নি। এমনকি মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় এর কোন সংবাদই প্রকাশ করা হয়নি। 

সম্প্রতি বান্দরবানে ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (সংক্ষেপে কেএনএফ) কে পুঁজি করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে নাটকীয় খেলায় মেটে ওঠেছে তা কাউন্টার ইন্সার্জেন্সিরই অংশ এবং তার সুস্পষ্ট উদাহরণ। যৌথ অভিযানের নামে স্কুল, কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ নিরীহ গ্রামবাসীদের সন্ত্রাসী তকমা লাগিয়ে গ্রেফতার, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। তাদেরই নিয়ন্ত্রিত মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এমনভাবে সবকিছুকে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন দেশের ব্যাপকতর জনগণ বিশ্বাস করতে পারে সামরিক বাহিনী সত্যিকার অর্থে তথাকথিত পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছে। যা যৌথ অভিযানের মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভবপর হতে পারে! স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আওয়ামী সরকারও নির্লিপ্তভাবে তা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এর আরেকটি বিশেষ দিকও রয়েছে। যা সচরাচর সাধারণ জনগণের চোখের আড়াল থেকে যায়। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে সেখানে RAB, POLICE, BGB-কে সম্পৃক্ত করার মূল কারণ হচ্ছে প্রথমত, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সাধারণ জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা এবং পারতপক্ষে সেনাবাহিনীর ইমেজ অক্ষুণ্ণ রাখা। RAB- কে ঘটনার সামনে টেনে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যটাও মূলত একই। দ্বিতীয়ত, পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়নের প্রয়োজনীয়তা দেশের জনগণের সম্মুখে তুলে ধরা এবং তথাকথিত নিরাপত্তা দেওয়ার নামে পাহাড়ে ক্যাম্প, মাউন্ট ব্যাটেলিয়ন স্থাপন করার নাটকীয় কাজটা সম্পন্ন করা। দেখা যাচ্ছে, এতে সাপও মরছে আর লাঠিও ভাঙছে না। অর্থাৎ শাসকগোষ্ঠীর উভয়দিকেই লাভ। রাষ্ট্র ও জননিরাপত্তার স্বার্থে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর এমন অতিনাটকীয়তার আড়ালে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বাংলা সিনেমার গল্পগুলোকেও হার মানায়! 

অন্যদিকে আসল সত্যটা চাপা পড়ে যায় শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার দাপটে। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন প্রদত্ত হলে কার্যত সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব কমে যাবে এবং নানামুখী অভিযানের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারলে সেনাবাহিনীর স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীটির ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে বসবে। ফলে পাহাড়ে পর্যটন, রিসোর্টসহ বিভিন্ন ব্যবসার সাথে জড়িত সেনাকর্মকর্তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠবে। আরেকদিকে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চনার কবল থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এই জায়গাতেই মূলত স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সবচে বড় ভয়!

খ. অর্থনৈতিক

রবীন মেন্দর পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক শোষণ ও প্রান্তিকীকরণ প্রবন্ধে বাংলাদেশ আমলে পাহাড়িদের অর্থনৈতিক প্রান্তিকীকরণে প্রধান কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হল: সেটলার পুনর্বাসন ও ভূমি বেদখল, ব্যবসা-বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ, তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি, বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন, তথাকথিত উন্নয়ন কর্মসূচি ও পুঁজিবাদী শোষণ। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য সংরক্ষিত ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির ৩৪ নং ধারায় পার্বত্য এলাকায় বহিরাগতদের জমি বন্দোবস্তির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তা তুলে নেয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩০,০০০ বাঙালি পরিবারকে পুনর্বাসন করে। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে চার লক্ষাধিক বাঙালিকে পুনর্বাসন করা হয়। যার ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং যা নিতান্তই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রেও পাহাড়িরা শোষণ-বঞ্চনার নির্মম শিকার। জুমনির্ভর অর্থনীতি থেকে বাজার নির্ভর অর্থনীতিতে রুপান্তরিত হওয়ায় বাজার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পরিবহণ, ব্যাংকিং, ঠিকাদারি,  সেবাখাত সবকিছু বহিরাগতদের একচেটিয়া দখলে। ফলে পাহাড়িদের জীবন-ধারণ দিন দিন হয়ে ওঠছে দুর্বিষহ ও কঠিন। ব্যবসা-বানিজ্যের বাইরে উন্নয়নের ফর্মূলা ব্যবহার করে পাহাড়িদের জনজীবনকে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। বিগত কয়েক দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত উন্নয়নের যে চিত্র আমরা দেখতে পাই, তা একইসাথে সামরিক ও বানিজ্যিক। জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম বা বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী ‘উন্নয়ন কৌশল’কে বিদ্রোহ দমনের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। আশির দশক থেকে যেদিকেই উন্নয়ন ফর্মূলা বাস্তবায়ন করা হয়েছে সেদিকেই পাহাড়ের বনাঞ্চল উজার হয়েছে। সীমান্ত সড়ক ও উন্নয়নের নামে পাহাড়কে কারাবেষ্টনী দিয়ে ঘিরে ফেলা, পাহাড়িদের বাগানবাগীচা ধ্বংস করে রাস্তাঘাট নির্মাণ, জমি দখল করে বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল, রিসোর্ট, সুইমিংপুল স্থাপনা আদৌতে পাহাড়িদের নিরাপত্তা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কোন সুফল বয়ে আনে নি। কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তার বদলে  পাহাড়িদের জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। মূলত, এই উন্নয়ন ফর্মূলা ব্যবসায়িক ও সেনাবাহিনীর কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর একান্তই একটি সুবিধাজনক ফর্মূলা। যা দিয়ে নিষিদ্ধ ও অবৈধ সবকিছুকে বৈধতা দেয়া যায়। দেশের ব্যাপকতর জনগণের সম্মতি আদায় করা যায়। স্থানীয় ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদ করে দেশের একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থেই শিল্প ও পুঁজির শোষণে পাহাড়িদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে যদি পাহাড়ি জনগণের যৌক্তিক দাবী ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’ মেনে নেয়া হয় তাহলে দেশের কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ভেস্তে যাবে। একইসাথে আপামর জনগণের সার্বজনীন সিদ্ধান্তে শাসকগোষ্ঠী খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে বাধ্য হবে। সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ ও পরিস্থিতি জিইয়ে রেখে শাসকগোষ্ঠী চায় দেশের অভ্যন্তরে পাহাড় হউক সেনাবাহিনীর ঔপনিবেশিক কারাগার।



 পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন কেন জরুরী?

প্রত্যেকটি রাষ্ট্রে কমবেশি জাতিসমস্যা বিদ্যমান রয়েছে। এই জাতিসমস্যা অনেকটা নির্ভর করে শ্রেণী সংগ্রামের উপর। শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতিসমস্যার সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব নয়। জাতীয়তাবাদ আদতে একটি অনুভূতির নাম। এই অনুভূতি যখন প্রবল হয় তখন অনেক ঘটনা ঘটে যায়। জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকে দুরকমের বলা যায়, একটি হচ্ছে আগ্রাসনকারী অন্যটি প্রতিরোধকামী। বস্তুত, এই জাতির সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে বিশেষত নির্ভর করতে হয় জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান ভাষার উপর। ভাষার স্বীকৃতির উপরই একটা জাতির স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাগুলোর পরিচয়কে ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। এক জাতি এক রাষ্ট্র গঠনের মডেল অনুসরণ করে। যা সর্বপ্রথম দেখা যায় ঊনিশ শতকে ইউরোপে। কিন্তু এ তত্ত্বের মূল সমস্যাটা দাঁড়ায় প্রত্যেকটি দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ভিন্ন অপরাপর সংখ্যালঘু জাতির জন্য। ফলে ইউরোপে পরবর্তীতে এক-জাতি রাষ্ট্রের পরিবর্তে বহুজাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। মূলত বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু জাতিগুলোর জন্যে বিভিন্ন মাত্রার স্বায়ত্তশাসন প্রদান শুরু হয়। ইউরোপের কোন কোন দেশের সংখ্যালঘু এলাকায় স্বায়ত্তশাসনের পরিধি এত ব্যাপক যে এগুলোকে অনেকেই রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তন্মোধ্য ফিনল্যান্ডের আলান দ্বীপ, ডেনমার্কের ফারো দ্বীপ, ডেনমার্কের গ্রীনল্যান্ড ও স্পেনের কাটালোনিয়া, বাস্ক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফিনল্যান্ডের আলান দ্বীপপুঞ্জে সংখ্যালঘুর জাতির জনগণ ১৯২০ সাল থেকে Demalitarized and autonomous stauts ভোগ করার অধিকার পায়। যে সকল ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে সেগুলো হল: সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্য ও হাসপাতাল, শিক্ষা,  কারিগরি প্রশিক্ষণ, পেশার নিয়ন্ত্রণ, গৃহ ও সমাজ কল্যাণ, সংরক্ষণ, গণ বিনোদন এবং জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। তারা নিজস্ব সংসদের মাধ্যমে সেগুলো পরিচালনা করে থাকে। 

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও রয়েছে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের জন্য নিজস্ব স্বায়ত্তশাসিত এলাকা। বিশেষ করে সেভেন সিস্টার্স এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ভারতের এসব স্বায়িত্বশাসিত অঞ্চলগুলোতে বেশ কয়েকটি বিষয়ে সংখ্যালঘু জাতির জনগণ আইন ও বিধিবিধান তৈরি করতে পারে। এসবের মধ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ব্যবস্থাপনা, পানিসম্পদ, কৃষি ও চাষাবাদ, গ্রাম এবং শহর পর্যায়ে পুলিশিং, জনস্বাস্থ্য, অর্থ, ঋণ এবং বানিজ্য ও খনিজ শিল্প অন্যতম। এছাড়া ভবন ও ভূমি, প্রাণী, যানবাহন, সেতু, কর্মসংস্থান ও রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণসহ বেশ কিছু বিষয়ে তাদের কর ও রাজস্ব আদায় করার ক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে মায়ানমারেও (Myanmar) দেখা যায় দেশটির বামার প্রধান কেন্দ্রীয় এলাকাগুলোকে ‘রিজন’ (৭টি) এবং বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিসত্তা অধ্যূষিত সীমান্তবর্তী অ-বামার এলাকাগুলোকে ‘স্টেইট’ (৭টি) ইউনিয়ন টেরিটরি এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা প্রধান এলাকাকে ‘স্বশাসিত এলাকা’ স্বীকৃতি দিয়ে ভাগ করা হয়। এই সাতটি স্টেইট ও সাতটি রিজনের বাইরে দেশটিতে যে ছয়টি স্বশাসিত অঞ্চল রয়েছে সেগুলো হল: নাগা, পা লাউঙ, ককাঙ, ওয়া, দানু এবং পা-ও স্বশাসিত অঞ্চল। বার্মার প্রশাসনিক ভাষায় এগুলোকে বলা হয় ‘সেল্ফ-অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ জোন’। আবার বার্মার কিছু অঞ্চলকে ‘ফ্রন্টিয়ার এলাকা’ নামে অভিহিত করা হয়। যার মধ্যে পড়ে কাচিন ও শ্যান স্টেইট। বার্মার এই স্বশাসিত অঞ্চলগুলোতে সংখ্যালঘু জাতির জনগণ কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে নিজেদের মতো করে বাঁচার ও অধিকার ভোগ করার ক্ষমতা অর্জন করে থাকে। মিয়ানমারে বামার, চিন, কারেন, কারেন নি, কাইয়ান, মঙ, রাখাইন ও শ্যান এই আটটি জাতিগোষ্ঠীকে মূল জনজাতি এবং ১৩৫টি জনগোষ্ঠীকে 'উপ-জনজাতি' হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যা তাদেরকে নাগরিকত্বের পাশাপাশি স্বতন্ত্র পরিচয়কে ভিন্নভাবে তুলে ধরে। যদিও বার্মায় বর্তমানে সামরিক জান্তা সরকারের শাসন চলছে।

মূলত দেখা যায়, যে রাষ্ট্র ও সমাজ যত বেশী গণতান্ত্রিক সেই রাষ্ট্র ও সমাজে নারী ও সংখ্যালঘু জাতির জনগণ ততবেশী অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। তৎকালীন ভারতবর্ষে আমেরিকার মতো ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের মডেল  অনুসরণ করা হলে আজ ভারতবর্ষ খন্ডিত, দ্বিখণ্ডিত হত না। একইভাবে পূর্ব বাংলা স্বাধীনতার পর দেশের আপামর জনগণের যেমন মুক্তি আসেনি তেমনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যে শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে তাতে দেশের ‘গণতান্ত্রিকতা’কেও  প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা হয়েছে। এর মূল কারণ দেশের সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে স্বতন্ত্র স্বীকৃতি দিতে অপারগতা, বাঙালি মুসলিম ধর্মীয় গোঁড়ামি ও চিন্তাধারার সংকীর্ণতা। ব্রিটিশরা ৯৮% সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলিম অধ্যূষিত পার্বত্য অঞ্চলকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়ে প্রতারণা করেছিল, পাকিস্তান সরকার পাহাড়িদের স্বার্থ সংরক্ষণের রক্ষাকবচ ১৯০০ সালের রেগুলেশন ‘বহির্ভূত এলাকা’র মর্যাদা বাতিলের মাধ্যমে পাহাড়িদের সাথে প্রতারণা করেছে, বাংলাদেশ সরকার পাহাড়িদের বাঙালি বানিয়ে, পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক সামরিকায়ন ঘটিয়ে, দমন-পীড়ন জারি রেখে পার্বত্য অঞ্চলকে বাংলায়ন করার প্রচেষ্টায় পাহাড়িদের সাথে বিভিন্ন ধরণের নাটক ও তামাশা করে যাচ্ছে। সর্বশেষ তামাশা আমরা দেখেছি, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার জেএসএস এর সঙ্গে ৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর অন্তঃসারশূণ্য এক ‘পার্বত্য চুক্তি’ সম্পাদনের মাধ্যমে। এই চুক্তির মাধ্যমে জেএসএস তাদের বিশ্বস্ত বন্ধু আওয়ামীলীগের কাছে একদিকে প্রতারণার স্বীকার হয়েছে অন্যদিকে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনে বাধ্য হয়ে অস্ত্র সমর্পণ করে সন্তু লারমা’র নেতৃত্বাধীন জেএসএস কার্যত সমগ্র জুম্ম জনগণের সাথেই প্রতারণা করেছে। 

বলাবাহুল্য, ৯৭ এ জেএসএস পরাজিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনগণ বর্তমানে শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন- নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেছে। তারা ইউপিডিএফ এর নেতৃত্বে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন বুনছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল, পাহাড়িদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন এবং দেশের আপামর জনগণের উপর শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আপোষহীন সংগ্রামই ইউপিডিএফ' কে জনগণের ভরসা ও বিশ্বস্ততার প্রতীকে পরিণত করেছে।

দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও অধিক সময় ধরে সেনাশাসনের অধীনে থাকা পাহাড়ি জনগণ মুক্তি চায়। আসলে কি সেই মুক্তি? পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ পূর্ণস্বায়ত্তশাসন চায়, চায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। লেনিন তার  Right of nations to self determination গ্রন্থে বলেছেন, “জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলিতে বুঝায় ভিন্ন জাতি হইতে উহাদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইবার এবং নিজস্ব স্বাধীন সার্বভৌম জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের অধিকার।” সেই অর্থে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ এখনো বাংলাদেশ থেকে সরাসরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দাবি তোলেনি। তারা স্বতন্ত্র পরিচয়ে বাঁচার তাগিদেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেছে মাত্র। সুপ্রকাশ রায় তার জাতিসমস্যায় মার্কসবাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “স্বাধীনভাবে নিজ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রত্যেক জাতির সহজাত ও মৌলিক অধিকার। কোন ব্যক্তির যেমন অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করিয়া নিজ জীবন গড়িয়া তুলিবার পূর্ণ অধিকার আছে, তেমনি একটি জাতিরও ঠিক সেই অধিকার আছে। একইভাবে জাতীয় জীবন গঠনের ও পরিচালনার জন্য প্রয়োজন মনে করিলে প্রত্যেকটি জাতি অন্য জাতি হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকিতে পারে। ইহা প্রত্যেকটি জাতির মৌলিক অধিকার, শ্বাশত মানবিক অধিকার।” পৃথিবীর কোন দেশেই জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও মানুষের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা কারোর নেই। এমনকি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ভিন্নভাষী, ভিন্ন বর্ণমালা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বলীয়ান জাতিসত্তাগুলোর উপর জোরজবরদস্তিমূলক আচরণ, জমি দখল, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ লুন্ঠন ও হরণের অধিকার স্বাধীন বাংলাদেশে ‘মুষ্টিমেয় স্বার্থবাদী গোষ্ঠ’ তথা শাসকগোষ্ঠীকে দেয়া হয়নি। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন, সেনাশাসন ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দেশের জাতিগত সমস্যা ও সংখ্যালঘু জাতিসমূহের অধিকার সংরক্ষণে কখনো সমাধান হতে পারে না। গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই দেশের স্বার্থে  পাহাড়িদের জীবন-ধারণের নিশ্চয়তা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা,  ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ এবং জাতিসত্তা বিকাশের প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন কিংবা সেনাশাসন নয় ; পাহাড়ি গণমানুষের প্রাণের দাবী পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রদান অত্যন্ত জরুরী।

✒ তথ্য সহায়ক গ্রন্থ:

১. জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি ১৯০৫-১৯০৭ - সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (বিশেষভাবে দেখুন পৃষ্ঠা ৬২৮, ৬৯০-৬৯৯)

২. পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিবাহিনী জিয়া হত্যা মনজুর খুন - মহিউদ্দিন আহমদ

৩. ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম (১৭৭২-১৭৯৮)- অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো

৪. এথনো- পলিটিক্স ইন সাউথ এশিয়া: তিন বার্মা জাতিগত সংঘাতের সাত দশক (ঐতিহ্য প্রকাশন)- আলতাফ পারভেজ

৫. জাতিসমস্যায় মার্কসবাদ -সুপ্রকাশ রায়

৬. বাংলার ইতিহাস: ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো ( সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ( দেখুন পৃষ্ঠা ৩০৩-৩০৬)

৭. পার্বত্য চট্টগ্রামে সংগ্রামী ঐতিহ্য, ইউপিডিএফ ও নতুন দিনের লড়াই - প্রসিত খীসা ( প্রকাশ ১২ এপ্রিল ২০১১)

৮. পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস - রবি শংকর চাকমা

৯. পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক শোষণ ও প্রান্তিকীকরণ- রবীন মেন্দর (বুকলেট)

১০. ইউরোপের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসমূহ- উবাই মারমা (প্রকাশ : আগষ্ট ২০১৬)


 লেখক পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয়  শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক । 


[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত ]


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments