""

ঢাকায় কারামুক্ত পিসিপি নেতা কুনেন্টু চাকমার সংবাদ সম্মেলন, ৭ দফা দাবি

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করছেন কুনেন্টু চাকমা।

ঢাকা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ৩ নভেম্বর ২০২৪

হাইকোর্টের জামিন পদদলিত করে জেলগেইটে দুই বার পুনঃআটক, পাহাড়ে সেনা-গোয়েন্দা সংস্থার খবরদারি ও দীর্ঘ ৫ বছর ৮ মাসের কারাজীবনের বিবরণ তুলে ধরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সদ্য কারামুক্ত কুনেন্টু চাকমা।

আজ রবিবার (৩ নভম্বর ২০২৪) সকাল ১১টায় ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ২য় তলাস্থ জহুর হোসেন চৌধুরী হল রুমে তিনি এই সংবাদ সম্মেলনে করেন।

সংবাদ সম্মেলন থেকে কুনেন্টু চাকমা অবিলম্বে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি কারাগারে আটক ইউপিডিএফ ও তার সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মুক্তি, আদালত থেকে জামিন লাভের পর জেল গেইট থেকে পুনরায় গ্রেফতার বন্ধ এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে ইউপিডিএফ ও তার সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নামে দায়ের করা সকল মিথ্যা মামলা ও হুলিয়া প্রত্যাহারসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে নিকট ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে কুনেন্টু চাকমা তাকে গ্রেফতার ও নির্যাতনের বিবরণ দিয়ে বলেন, ২০১৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাঙমাটি জেলা সদর উপজেলা কুদুকছড়ি আবাসিক এলাকায় সাংগঠনিক কাজে অবস্থান করার সময় একটি দোকান থেকে সেনা-গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এসে আমাকে গ্রেফতার করে। আমাকে গ্রেফতারের সময় সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট ঠ্যাঙাড়ে নব্যমুখোশ বাহিনীর দু’জন সদস্যও ছিল, যাদেরকে আমি চিনতে পারি। গ্রেফতারের পর আমাকে রাঙামাটি সেনা ব্রিগেডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নেয়ার পর সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা দুপুর ২ টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত আমার ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনে সময় সেনাবাহিনী সদস্যরা আমাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। সেনাবাহিনী অমানুষিক নির্যাতনের পর আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আমার প্রাণপ্রিয় সংগঠন পিসিপি ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ’র বিরুদ্ধে জোরপূর্বকভাবে সেনাবাহিনীর নির্দেশিত স্বীকারোক্তিমূলক মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বক্তব্য দিতে বাধ্য করে। এই স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যটি সেনা সদস্যরা ভিডিও করে রাখে এবং পরবর্তীতে সেই বক্তব্য তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাওভাবে প্রচার করে। মূলত পাহাড়-সমতলে এবং সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আমার সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ’র ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করতে সেনাবাহিনী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই স্বীকারোক্তি আদায় করেছে। রাঙামাটি রিজিয়নের সেনাবাহিনী সদস্যদের উক্ত জোরপূর্বক স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য ঘৃণ্যভাবে প্রত্যাখ্যান করছি এবং সেনা সদস্যদের এহেন কার্যকলাপকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।


সেনা-গোয়েন্দা কর্তৃক জেল গেইট গ্রেফতার ও হত্যার হুমকি দেয়ার ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী সদস্যরা নির্যাতন করার পর তাদের কাছ থেকে অস্ত্র গুজে দিয়ে আমাকে রাঙামাটি কতোয়ালি থানায় সোপর্দ করে। পরের দিন পুলিশ আমাকে ‘অস্ত্র ও চাঁদাবাজি’র মিথ্যা মামলা দিয়ে আদালতে নিয়ে যায় এবং আদালত থেকে কারাগারে প্রেরণ করে। উক্ত অস্ত্র ও চাঁদাবাজি মামলায় আমি এক বছরের অধিক রাঙামাটি কোর্টে জামিন আবেদন করি। যখন জামিন চাওয়া হয় প্রতিবারে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের পিপি তা তীব্র বিরোধিতা করে এবং আমাকে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে বিচারককে বলে আমাকে জামিন দেওয়া যাবে না, জামিনে বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে আপত্তি আছে... ইত্যাদি। পরে আমাকে ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে প্রায় ৩২ মাস পরে নিম্ন আদালত থেকে জামিন দেয়া হয়। কারা কর্তৃপক্ষ জামিন পত্র পাওয়ার পর বিকাল আনুমানিক ৫টায় কারাগারের কার্যালয়ে আমাকে ডেকে নেওয়া হয়। কারাগারের জেলারসহ অফিসের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা আমাকে সাফ জানিয়ে দেন যে, পাহাড়ি বন্দিদেরকে মুক্তি দেয়া হবে কিনা তা রাঙামাটি ব্রিগেড থেকে অনুমতি নিতে হয়। ঠিক সে মুহূর্তে রাঙামাটি ব্রিগেডের জি-টু মেজর নাজমুল যতক্ষণ পর্যন্ত কারাগারে পৌঁছাবে না ততক্ষণ আমাকে কারাগারের অফিসে বসিয়ে রাখার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। রাত ৮:৩৫টায় কারাগারে সেনা-গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন উপস্থিত হলে কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে বাহির করে দেয়। কারাগার থেকে বের হয়ে দেখি কারাগারের ফটকের ভিতরে সিভিল ড্রেসে ৫-৬ জন গোয়েন্দা সংস্থার লোক। এদের মধ্য থেকে প্রথমে একজন আমাকে ধরে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে দেয়। তখন আমি একজনকে বলতে শুনি সামনে সিসি ক্যামেরা আছে চোখের কাপড় খুলে দাও। তারপর তারা আমাকে কারাফটক থেকে রাস্তায় নিয়ে যায়। সেখানে দেখলাম তিনটি সেনাবাহিনীর পিকআপ দাাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে সাদা রংয়ের, যেখানে “UN” লেখা, আর পিছনের দুইটি পিকআপে আনুমানিক ২০-২২ জন সেনাবাহিনী ছিলো। তারা আমাকে “UN” লেখা পিকআপে তুলে নিয়ে রাঙামাটি সদর জোনে নিয়ে যায়। জোনে আমাকে সারারাত চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ছোট রুমে আটকে রেখে পরেরদিন ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ বিকালে রাঙামাটি জোন থেকে আবারো অস্ত্র গুজে দিয়ে আমাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং পুলিশ আমাকে আদালতে নিয়ে গেলে আদালত আমাকে দ্বিতীয়বারের মত কারাগারে প্রেরণ করে। যখন আমাকে “UN” লেখা গাড়ীতে তোলা হচ্ছিল তখন আমি মনে মনে ভাবলাম যে, জাতিসংঘ মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করে, সেই জাতিসংঘের গাড়ী ব্যবহার করে সেনাবাহিনী আমাকে বেআইনীভাবে কারাফটক থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, এটি সেনাবাহিনী আমার উপর চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এমনিতো জেলগেইট থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনাও সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন।

লিখিত বক্তব্যে তিনি দ্বিতীয়বার জেলগেইট থেকে গ্রেফতার ও মুক্তির পাওয়ার বিষয়ে বলেন, আমি কারাগারে থাকার সময় বেশ কয়েকবার জামিন চাইলে নিম্ন আদালত আমাকে জামিন দেয়নি। এরপর প্রায় ১৮ মাস পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাই। জামিন হওয়ার দুইদিন পর শুনি রাষ্ট্র পক্ষের আবেদনে আমার জামিন স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আমি সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে গিয়ে দীর্ঘ আইনী লড়াই করে ৬ মাস পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ থেকে আমার হাইকোর্টের জামিন পুনর্বহাল রাখা হয়। সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের জামিন বহাল রাখলে বিগত ৩ আগস্ট ২০২৩ সালে আমার জামিনের কাগজপত্র রাঙামাটি কারাগারে আসলে কারা কর্তৃপক্ষ সেদিন সন্ধ্যা ৬ টায় জামিনের জন্য অফিসে ডেকে নিয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তখন আমি আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম। কারণ এর আগেও সেনাবাহিনী আমাকে জেলগেইট থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এবারও হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না, আমাকে আবারো কারাফটক থেকে তুলে নিয়ে যাবে-- এমন আশঙ্কায় ছিলাম। সন্ধ্যা ৭:২৫ টায় আমাকে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় যে, সেনাবাহিনী সদস্যরা তোমাকে ব্রিগেডে নিয়ে যাবে। সে পর পর সিভিল ড্রেসে ৩ জন ডিজিএফআইয়ের লোক এসে আমাকে বললো আমার সাথে নাকি রাঙামাটি ব্রিগেডের রিজিয়নের স্টাফ মেজর পারভেজ কথা বলবেন। তাই এখন তোমাকে আমাদের সাথে ব্রিগেডে যেতে হবে। তারা আমাকে পুনরায় জেলগেইট থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় করে তুলে নিয়ে যায়। ব্রিগেডে পৌঁছানোর আগে রাঙামাটি সরকারি কলেজ গেইট পৌছালে আমাকে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে দেয়। আগেকার মতো সেনাবাহিনী সদস্যরা আমাকে ব্রিগেডের ছোট্ট একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেনাদেরকে আমি ওয়াশরুমে যাবার কথা বললে তখন তারা আমার চোখ খুলে দেয়। এসময় আমি দেখি আমাকে একটি টর্চার সেলের ভিতরে রাখা হয়েছে। কক্ষগুলো মাঝারি সাইজের এবং সেখানে ৬টি কক্ষ দেখতে পাই। ঐ টর্চার সেলের বাইরে থেকে কোনো কিছু শব্দ শোনা যায় না এবং দেখাও যায় না। তারপরে রাত ১০ টা বাজে জি-টু মেজর পারভেজ আমার সাথে দেখা করে। তখন তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন- গত ১ জানুয়ারি ২০২৩ সালে জাতীয় মানবাধিকার চেয়ারম্যান রাঙামাটি কারাগার পরিদর্শনের সময় চেয়ারমানের কাছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন করেছিলে? তুমি তো সেনাবাহিনীকে কলঙ্কিত করেছো, এখন কি তোমাকে মানবাধিকার চেয়ারম্যান বাঁচাতে পারবে? আরেকটা মামলা দিয়ে দেবে বলে হুমকি প্রদান করে। পরে তিনি আমাকে একটি শর্ত দেন যে, তাদেরকে নাকি একটি একে-৪৭ অস্ত্র দিতে হবে। অস্ত্র যদি দিতে না পারি তাহলে হয় মাটির ভিতরে চলে যেতে হবে, নয় আজীবন অন্ধকার কারাগারে থাকতে হবে। তখন আমি তাকে বলি, আমিতো কোনো অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের কাছে অভিযোগ করিনি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেনের কাছেই অভিযোগ করেছিলাম। তাঁকে তো সরকার নিয়োগ দিয়েছে, সে কারণে আমি তার কাছে অভিযোগ করেছি। কারণ আমাকে ২০২১ সালে একবার জেলগেইট থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

রাঙামাটি ব্রিগেডের টর্চার সেলে (বর্তমানে আয়নাঘর হিসেবে পরিচিত) ২ দিন আটক রাখার পর ৫ আগস্ট ২০২৩ তারিখে রাত ১২ টার সময় সেনাবাহিনী সদস্যরা আমাকে বলে ‘যদি তুমি আমাদেকে একে-৪৭ অস্ত্র দিতে না পার তাহলে তোমাকে এনকাউন্টারে দেওয়া হবে’ এটা নিশ্চিত এবং এটি সরাসরি উপর মহল থেকে নির্দেশ এসেছে বলে হুমকি দেয়। আমি তখনও তাদেরকে বলেছিলাম ঠিক আছে আমাকে ক্রসফায়ারে দাও, তবুও আমাকে দ্বিতীয়বার কারাগারে দেবেন না। কারণ কারাগারে আমি মানসিকভাবে কষ্ট পাই, এরকম মানসিক কষ্টের মধ্যে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। সেনাবাহিনী সদস্যরা রাত আনুমানিক ৩টার পরে আমাকে কাউখালীর ঘাগড়া আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং থানা পুলিশকে ক্যাম্পে আসতে বলে। তখন আমি জানতে পারি আমাকে আরও একটি অস্ত্র মামলা দেওয়া হবে। পরবর্তীতে তারা আমাকে কাউখালি থানায় নিয়ে গিয়ে একটি মিথ্যা অস্ত্র মামলা দেয়। সকালের দিকে আমাকে আদালতে নিয়ে গেলে আদালত পুনঃবার কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। এই মিথ্যা মামলায় আমি ৩ মাস ১৫ দিন পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাই। জামিন পাওয়ার একদিন পরে রাষ্ট্র পক্ষের এটর্নি জেনারেলদের তীব্র বিরোধিতার কারণে আমার জামিন স্থগিত করে দেওয়া হয়। পরে আপীল করলে সুপ্রীম কোর্ট আমার জামিন পুনর্বহাল রাখে এবং গত ১৬ অক্টোবর ২০২৪ আনুমানিক রাত ৭:৩০ টায় দীর্ঘ ৫ বছর ৮ মাস ১৪ দিন পর আমি রাঙামাটি জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পাই।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-গোয়েন্দা সংস্থার অন্যায় নিপীড়নের হাত থেকে পাহাড়ি বন্দীরা মুক্ত হতে চায় উল্লেখ করে কুনেন্টু চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কারাগারে শুধু আমি নয়, কিংবা কেবলমাত্র রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা নয়, সেখানে আরো অনেক নিরীহ পাহাড়ি বন্দীদের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা লোকজন কর্তৃক দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এভাবে আটক রাখা হয়েছে। বহু পাহাড়িকে কারাগারের ফটক থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নতুন মামলায় জড়িয়ে দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। এখনো বহু পাহাড়ি বন্দীকে রাঙমাটি কারাগারে অন্যায়ভাবে আটক করে রাখা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ২০১৮ সাল থেকে রাঙামাটি কারাগারে সেনা-গোয়েন্দা কর্তৃক কারাফটক থেকে তুলে নিয়ে পুনঃগ্রেফতারের ঘটনা ঘটতে থাকলেও কোন পত্রিকা ও গণমাধ্যমগুলোতে তা প্রকাশ হয়নি কিংবা প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে বন্দীদের উপর চলা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কথা দেশের মানুষকে জানতে দেওয়া হয়নি। ফলে কারাফটক থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনা এখনো অব্যাহত রেখেছে সেখানকার সেনা-গোয়েন্দা সংস্থা লোকজন। আমরা এর সুরাহা চাই, প্রতিকার চাই এবং সেনা-গোয়েন্দা সংস্থার এই অন্যায় নিপীড়নের হাত থেকে পাহাড়ি বন্দীরা মুক্ত হতে চায়।

ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে কুনেন্টু চাকমা বলেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণভ্যুত্থানের ফলে আজকে আমি বন্দীদশা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। যদি এই আন্দোলন সফল না হতো কিংবা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসন অবসান না ঘটতো তাহলে আমি মুক্ত হতে পারতাম না বলে আমি মনে করি। তাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, জুলাই-অগাস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তীতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির এখনো পর্যন্ত কোন পরিবর্তন ঘটেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন এখনো অব্যাহত রয়েছে। দেশের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের রদবদল করা হলেও হাসিনার আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন-গুমে জড়িত সেনা-প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে নব্যমুখোশ বাহিনী ভেঙ্গে দেয়া হয়নি। যার কারণে হাসিনার দোসর সেনা কর্মকর্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হত্যার মিশনে নেমেছে। সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে গত ৩০ অক্টোবর ২০২৪ খাগড়াছড়ির পানছড়িতে ৩জন ইউপিডিএফ কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, নিরাপত্তা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা পাহাড়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল রাখার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। গত ১২ আগস্ট ২০২৪ খাগড়াছড়ি সদরস্থ সাধারণ শিক্ষার্থীরা খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ ও চেঙ্গী স্কয়ার এলাকায় গ্রাফিতি অঙ্কনের সময় খাগড়াছড়ি জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মো. আবুল হাসনাত এর নেতৃত্বে হামলা ও লাঠিচার্জ করা হয়। ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক হামলা করে কয়েক শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনী নির্বিচার গুলি করে দুই জনকে হত্যা করা হয় এবং দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনে একজন পাহাড়ি নিহত হন। অন্যদিকে রাঙ্গামাটিতে একজন পাহাড়ি শিক্ষার্থিকে সেটলাররা কুপিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে গত ১ অক্টোবর ২০২৪ খাগড়াছড়ি সদরে পাহাড়িদের ওপর আবারো সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়, বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। সেনা-প্রশাসনের উপস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক হামলা এবং সেনাদের হাতে নিরীহ পাহাড়ি নিহতের ঘটনা এবং সেনাসৃষ্ট সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে ধারাবাহিকভাবে ইউপিডিএফ সদস্যদের হত্যার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির মূলে রয়েছে সেনা-প্রশাসন।

সংবাদ সম্মেলনে কুনেন্টু চাকমা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো:

১) অবিলম্বে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি কারাগারে আটক ইউপিডিএফ ও তার সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মুক্তি দিতে হবে; আদালত থেকে জামিন লাভের পর জেল গেইট থেকে পুনরায় গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে; এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে ইউপিডিএফ ও তার সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নামে দায়ের করা সকল মিথ্যা মামলা ও হুলিয়া প্রত্যাহার করতে হবে।

২) সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে নব্য মুখোশ সন্ত্রাসী কর্তৃক গত ৩০ অক্টোবর ২০২৪ খাগড়াছড়ির পানছড়িতে ৩ জন ইউপিডিএফ কর্মীকে হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার করতে হবে।

৩) পার্বত্য চট্টগ্রামে জারিকৃত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দমনমূলক “১১ দফা” নির্দেশনা বাতিল করতে হবে।

৪) গত ১৯, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ৪ জন পাহাড়িকে হত্যার সাথে জড়িত সেনা-সেটলাদের গ্রেফতার ও বিচার করতে হবে। এছাড়াও নিহত এবং অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের যথাযথা ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।

৫) ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে নব্য মুখোশ বাহিনী ভেঙে দিতে হবে এবং তাদের মধ্যে যারা খুন, গুম, অপহরণ ও সন্ত্রাসের সাথে জড়িত তাদেরকে গ্রেফতারপূর্বক শাস্তি দিতে হবে।

৬) খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক সোহেল রানা গণপিটুনিতে মারা যাওয়ার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের নামে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

৭) পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ‘অপারেশন উত্তরণ’ বাতিলপূর্বক সেনাশাসন প্রত্যাহার করতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি অঙ্কন চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


 






0/Post a Comment/Comments