""

কেন আমরা ইউপিডিএফ গঠন করলাম



সচিব চাকমা, সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, ইউপিডিএফ


সত্যি বলতে কী, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আগে আমরা কেউ ভাবিনি যে আমাদেরকে নতুন একটি পার্টি গঠন করতে হবে। আমরা মানে বর্তমানে যারা ইউপিডিএফে (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) দায়িত্ব পালন করছি এবং চুক্তির আগে তিন পাহাড়ি সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাথে যুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলাম।

সে সময় এই তিন গণ সংগঠনের সাথে জেএসএসের ভালো সম্পর্ক ছিল, যদিও এই সংগঠনগুলো জেএসএসের কোন অঙ্গ সংগঠন ছিল না। আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জেএসএস নেতৃত্ব ও তিন সংগঠনের নেতৃত্বের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল। কাজেই আমরা মনে করতাম গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় আমাদেরকে এক সময় জেএসএসে যোগ দিতে হবে। এটা আমরা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিয়েছিলাম। নতুন পার্টি গঠনের চিন্তাভাবনা আমারতো ছিলই না, আমার সহযোদ্ধাদের কারো কথায়ও সে ধরনের কোন আভাস ইঙ্গিত কোনদিন পাইনি।

তিন সংগঠন ও জেএসএস নেতৃত্বের মধ্যে সম্পর্ক প্রথম খারাপ হতে শুরু করে যখন সন্তু লারমা ১৯৯৫ সালের ১৫ জুন পানছড়ির ধুদুকছড়ায় এক সমাবেশে তিন সংগঠনের আন্দোলনের পদ্ধতি বা কর্মসূচিকে সমালোচনা করে বলেন, “গুলতি মেরে, জঙ্গী আন্দোলন করে স্বায়ত্তশাসন কায়েম করা যায় না।” তার এই বক্তব্য ছিল বজ্রাঘাতের মতো এবং একেবারে অপ্রত্যাশিত। কারণ তার এই বক্তব্যের কয়েকদিন আগেই প্রসিত খীসা ও রবি শংকর চাকমা (বর্তমানে ইউপিডিএফের যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পতাছড়া গ্রামে সন্তু লারমার সাথে সাক্ষাত করেছিলেন এবং তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনের কী কী কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে তা তাকে অবহিত করেছিলেন। সন্তু লারমাও “আ ঠিগ আগে দ” (সব ঠিকই তো আছে) বলে তার সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। অথচ তার কয়েকদিন পরই তিনি তার সুর পাল্টিয়ে ফেলেন। হঠাৎ কেন সন্তু লারমার এই ডিগবাজী, কেন তিনি তিন সংগঠনের আন্দোলন কর্মসূচির বিরোধীতা/সমালোচনা করেছিলেন, তা আমাদের কারোর বোধগম্য হয়নি। তিনিও আজ পর্যন্ত তার কোন ব্যাখ্যা দেননি।

তবে তিনি তার ওই বিতর্তিক বক্তব্য দিয়েছিলেন অলি আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারী প্রতিনিধি দলের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে ফিরে আসার পর। হেলিকপ্টার থেকে নামার পরই অপেক্ষমান জনতার উদ্দেশ্যে ছিল তার ওই বক্তব্য। পরবর্তী ঘটনা বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যায়, সন্তু লারমা তিন সংগঠনের নেতৃত্ব যাতে তার বিকল্প হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য তিনি অলি আহমদের সাথে ষড়যন্ত্র করে থাকতে পারেন। তার ধুদুকছড়ার বক্তব্য ছিল সরকারের উদ্দেশ্যে একটি গ্রীন সিগন্যাল। এই “গুলতি” বক্তব্যের কয়েক মাস পরই সেনা গোয়েন্দারা খাগড়াছড়িতে মুখোশ বাহিনী গঠন করে দেন। (মুখোশ বাহিনীর সরকারী নাম ছিল “পিসিপি-পিজিপির সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি বা পিপিএসপিসি) সেনাবাহিনী এই মুখোশদের দিয়ে তিন সংগঠনের নেতাকর্মীদের খুন, অপহরণ ও নির্যাতন করে আন্দোলন স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। তখন সে এক ভয়াবহ অবস্থা, যার বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। তবে এটা বলা অপ্রসাঙ্গিক হবে না যে, তিন সংগঠনের ওপর মুখোশদের এত দমনপীড়ন সত্ত্বেও জেএসএস নেতৃত্ব তার নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি পর্যন্ত সে সময় দেয়নি।

যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। জেএসএস ও তিন সংগঠনের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। এর আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। জেএসএস নেতা সন্তু লারমা পিজিপি, পিসিপি ও এইচডব্লিউএফের নেতাকর্মীদের ডেকে দেখা করে তাদেরকে প্রসিত খীসার বিরুদ্ধে উস্কে দিতে থাকেন এবং তার বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ তিন সংগঠনকে বিভক্ত করে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করেন।

এখানে একটা কথা বলে রাখি। আমি ১৯৯৭ সালের জুন কি জুলাই মাসের দিকে জেএসএস সদস্য ক্ষিতিশ চাকমার সাথে পতাছড়ায় গিয়ে সন্তু লারমার সাথে দেখা করেছিলাম। সন্তু লারমা আমার কাছে অভিযোগের সুরে বলেছিলেন, বাইরে জেএসএসের বিপক্ষে একটি প্যারাল্যাল নেতৃত্ব তৈরি করা হচ্ছে। আমি তো শুনে একেবারে অবাক হয়ে যাই। কারণ সে ধরনের কোন চিন্তা-ভাবনা, কোন ধরনের আলাপ-আলোচনা, বা কোন ধরনের কার্যকলাপ আমাদের মধ্যে কস্মিনকালেও হয়নি। আসলে পরে জানতে পারি, সন্তু লারমা অত্যন্ত সন্দেহপ্রবণ। তার সব সময় সন্দেহ কেউ তার কাছ থেকে সভাপতির পদ বা ক্ষমতা কেড়ে নেয় কীনা, কেউ তার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে কীনা। তিনি তো তার সহকর্মীদেরও সন্দেহ করে থাকেন বলে শুনেছি। অথচ একজন সত্যিকার বিপ্লবী তো কখনো ক্ষমতার জন্য লালায়িত হতে পারে না। সংগঠনে তার পদকে সে কখনেই ক্ষমতা বলে মনে করে না, দায়িত্ব বলেই জ্ঞান করে। অথচ সন্তু বাবুকে দেখে মনে হয় না তিনি বিপ্লবীর এই নীতি গ্রহণ বা ধারণ করেন।

সন্তু লারমা বা জেএসএস নেতাদের কি উচিত ছিল না প্রসিত খীসা ও অন্যান্য উঠতি ছাত্র যুব নেতাদেরকে ভবিষ্যতে জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বের হাল ধরার জন্য তাদেরকে উৎসাহিত করা, সহযোগিতা দেয়া? এক কথায় তাদেরকে যোগ্য নেতা হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করা। অথচ সেটা না করে তিনি তাদেরকেই তার নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করলেন। শুধু তাই নয়, এই উঠতি নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন। এটা কি কোনভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? নেতৃত্ব তো এমনি এমনি সৃষ্টি হয় না, বা এত সহজে গড়ে উঠে না। ৯০ দশকের ছাত্র-গণআন্দোলনে পোড় খেয়েই আমাদের প্রজন্মের নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। সেই নেতৃত্বকে তিনি জেএসএসের পরিপূরক মনে না করে প্রতিপক্ষ ধরে নিয়ে তাকে ধ্বংসের উদ্যোগই গ্রহণ করলেন। কোন সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন নেতা কী আসলে সেটা করতে পারে? তার তো এটা মেনে নেয়া উচিত যে, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই প্রসিত খীসা বা আমাদের প্রজন্মের যে কাউকে পুরো জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার একদিন গ্রহণ করতে হবে।

যাই হোক, তিন সংগঠনকে বিভক্ত করে দেয়ার জন্য বাইরের গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। সশস্ত্র সংগ্রাম তো বহু আগেই সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালের ১০ আগস্ট জেএসএসের একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার পর আর তাদের বন্দুক থেকে একটি গুলিও বের হয়নি। অস্ত্র জমাদান ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার ও নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

জেএসএস নেতৃত্ব কেবল তিন সংগঠনকে বিভক্ত করে দিয়ে ও বাইরের আন্দোলন ”দমন” করে ক্ষান্ত হয়নি। তারা (মূলত সন্তু লারমা) প্রসিত খীসাসহ তিন সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতার হিটলিস্ট তৈরি করেন এবং যেখানে পাওয়া যায় সেখানে তাদেরকে “গ্রেপ্তার” করার জন্য তার কর্মী বাহিনীকে নির্দেশ দেন। জেএসএস নেতাদের এইসব পদক্ষেপ কী তাদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা, নাকি অপরিণামদর্শীতা, নাকি সুবিধাবাদীতা, নাকি এসবের সমষ্টি, তা পাঠক বিবেচনা করবেন। তবে আমি যা বলতে চাই তা হলো – বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী বছরের পর বছর ধরে বহু চেষ্টা করেও বাইরের যে গণআন্দোলন দমন করতে পারেনি, জেএসএস নেতারা নিজেরাই ষড়যন্ত্র করে তিন সংগঠনকে বিভক্ত ও দুর্বল করে সেই আন্দোলন ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। যেখানে ভেতরে-বাইরে (অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ড – ওভারগ্রাউন্ড) একতাবদ্ধ হয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত ছিল, যাতে আলোচনার টেবিলে সরকার জনগণের দাবির ব্যাপারে ছাড় দিতে বাধ্য হয়, সেটা না করে জেএসএসের সুবিধাবাদী মূর্খ নেতৃত্ব বা সন্তু লারমা ভেতরের সশস্ত্র সংগ্রাম এবং বাইরের গণতান্ত্রিক আন্দোলন উভয়কেই ধ্বংস করে দেন। মানুষ যুদ্ধে যায় একতাবদ্ধ হয়ে। সরকারের সাথে সংলাপও একটি যুদ্ধ  বা যুদ্ধের অংশ। আর আমাদের জেএসএস নেতারা সেই সংলাপ-যুদ্ধে গেলেন নিজেদের শক্তিকে বিভক্ত করে। এই চাইতে মূর্খতা, কাণ্ডজ্ঞানহীনতা আর কি কিছু থাকতে পারে?

আগেই বলা হয়েছে, চুক্তি-পূর্ব সময়ে তিন সংগঠনের নেতাদের মনে কখনই আলাদা নতুন পার্টি গঠনের কোন চিন্তা-ভাবনা ছিল না। আমি নিজেও জেএসএসে যোগ দিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম এবং সত্যি বলতে কী যোগ দিতে রওনাও হয়েছিলাম। তখন আমার সাথে ছিল কুতুকছড়ি থেকে অভিলাষ চাকমা। সেও পিসিপি ও পিজিপির সাথে যুক্ত ছিল। পরে ইউপিডিএফে যোগ দিয়ে কয়েক বছর সক্রিয় থাকার পর দল ছেড়ে দেয়।

আমরা দু’জনে ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে জেএসএসে যোগ দেয়ার জন্য রওনা হই। খাগড়াছড়িতে পৌঁছে অভিলাষ চাকমা তার এক আত্মীয় জেএসএস নেতাকে (সোনম বাবু) ফোন করে আমাদের যোগদানের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানায়। তিনি অর্থাৎ সোনম বাবু আমরা জেএসএসে যোগ দিতে যাচ্ছি শুনে “কী মত্তাগি” (কেন মরতে আসছো) বলে আমাদেরকে নিরুৎসাহিত করেন। ফলে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি এবং আর উত্তর দিকে অগ্রসর না হয়ে বাড়িতে ফিরে আসি।

এখানে উল্লেখ করা দরকার, জেএসএসে যোগ দেয়ার জন্য রওনা হওয়ার আগে আমি ঢাকায় বর্তমানে ইউপিডিএফের সভাপতি প্রসিত খীসা ও সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমার সাথে দেখা করেছিলাম। তারাও উভয়ে জেএসএসে যোগদানের বিষয়ে আমাদেরকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। তাদের ভাষ্য ছিল, “জেএসএস আর আগের জেএসএস নেই। জেএসএস নেতারা যদিও বলছেন প্রয়োজনে তারা এক দফায় (স্বাধীনতা ঘোষণার অর্থে) যাবেন এবং যদিও তারা তরুণ যুবকদেরকে শান্তিবাহিনী বা জেএসএসে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন, তারা আসলে আর আন্দোলন করবেন না। এটা নিশ্চিত তারা সরকারের সাথে বোঝাপড়া করবে।” জেএসএসের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতার কাছ থেকে তারা নাকি এমন আভাস পেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাদের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। জেএসএস ঠিকই এক দফা গ্রহণ করেছিল, তবে সেই এক দফা বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতার ডাক নয়, তাদের এক দফা ছিল অস্ত্র জমাদানের মাধ্যমে আত্মসমর্পন।

যাই হোক, জেএসএসে যোগ না দেয়ায় জেএসএস নেতারা আমাদের ওপর ক্ষুদ্ধ হলেন। আমাকে এবং শান্তিদেব চাকমাকে (তিনিও তখন পিজিপির সাথে যুক্ত ছিলেন, পরে ইউপিডিএফ নেতা, দু বছর আগে স্ট্রোকে মারা যান) রাঙ্গামাটি শহর থেকে অপহরণ করা হয়। তারিখ মনে নেই, তবে সেটা খাগড়াছড়ি থেকে ফেরার কয়েকদিন পরের (১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাস) ঘটনা। আমরা রাঙ্গামাটি শহরের ফরেস্ট অফিসের পাশের একটি দোকানে কেনাকাটা করছিলাম। আমাদের সাথে বর্তমানে ইউপিডিএফ সংগঠক রঞ্জন মনি চাকমাও ছিলেন। শান্তি দেব চুল কাটাচ্ছিল। এমন সময় আসীন চাকমার নেতৃত্বে জেএসএসের সমর্থনপুষ্ট ১০-১২ জন ছেলে সেখানে এসে আমাদেরকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। প্রথমে বনরূপাস্থ পরাণ জুরানী স্টোরে, তারপর সেখান থেকে বন্দুকভাঙায় আমাদেরকে নেয়া হয়।

আমাদেরকে ছাড়াও সে সময় পানছড়িতে পিসিপি নেতা অনিমেষ চাকমা রিংকু (বর্তমানে বিএনপির সাথে যুক্ত), কুসুম প্রিয় চাকমা ও সুপায়ন খীসাকে জেএসএস অপহরণ করেছিল। খুব সম্ভব তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতনও চালানো হয়। ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৭ সালের ৫ আগস্ট। (স্বাধিকার, বুলেটিন নং ৭) তাদেরকে ধুদুকছড়ায় নেয়ার পথে জনগণ সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ করে তাদেরকে অপহরণকারী জেএসএস সদস্যদের কাছ থেকে উদ্ধার করে। তবে সে সময় বেঁচে গেলেও কুসুমপ্রিয় চাকমা শেষ পর্যন্ত জেএসএসের হাত থেকে রক্ষা পাননি। চুক্তির পর ১৯৯৮ সালের ৪ এপ্রিল পাহাড়ি গণ পরিষদের নেতা প্রদীপ লাল চাকমাসহ তাকে খুন করা হয়।

কিন্তু কী দোষ ছিল তাদের? তারা এমন কি করেছে যে, যার জন্য জেএসএস তাদেরকে হত্যা করবে? জেএসএস নেতারা আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেননি। তাদের সাথে কোনভাবে মতের অমিল হলে কিংবা কাউকে তারা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষ মনে করলে তাদেরকে মোকাবিলার জন্য জেএসএস নেতাদের একমাত্র অথবা প্রধান পদ্ধতি হলো তাদের জীবন নাশ করে দেয়া। এমনকি তাদের কোন কুকর্মের সাক্ষী হলেও তারা তাদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়। যেমন চাবাই মগের খুন। তিনি জেএসএস নেতার কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার কারণে তাকে শেষ করে দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়।

এতক্ষণ যা বর্ণনা করা হয়েছে তা সবই ঘটেছে চুক্তি ও আত্মসমর্পনের আগে। চুক্তির পর তিন সংগঠনের ওপর জেএসএসের এই আক্রমণ আরও বেশি বেড়ে যায়। তিন সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদেরকে জোড়ায় জোড়ায় তারা খুন করতে থাকে। প্রদীপ লাল ও কুসুম প্রিয় চাকমার খুনের কথা একটু আগে বলা হয়েছে। এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে হরেন্দ্র চাকমা ও হুরুক্যা চাকমাকে এবং তার কয়েক দিন পর ৮ ফেব্রুয়ারি দীঘিনালায় আনন্দ ময় চাকমা ও মৃণাল চাকমাকে অপহরণ করে মেরে ফেলা হয়।

জেএসএসের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারও তিন সংগঠনের ওপর দমনপীড়ন বৃদ্ধি করে। ১৯৯৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নানিয়াচরে পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। এটা ঘটেছিল খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শান্তিবাহিনী সদস্যদের অস্ত্র জমাদানের পরদিন। সন্তু লারমা ১০ ফেব্রুয়ারি একটি একে-৪৭ রাইফেল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়ে অস্ত্র জমাদানের অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন।

আমাকে গ্রেপ্তারের পর তিন সংগঠনের আরও অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়, যার উল্লেখ পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের রিপোর্টে পাওয়া যাবে। চুক্তির পর জেএসএসের নেতাকর্মীরা দাপটে বেড়াচ্ছিল, আর অন্যদিকে আমরা তিন সংগঠনের নেতাকর্মীরা বাড়ি থেকেও বের হতে পারছিলাম না। জেএসএস ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ আক্রমণে আমাদের অবস্থা তখন অত্যন্ত নাজুক।

কিন্তু তারপরও তিন সংগঠনের নেতাকর্মীরা দমে যাননি। কারণ আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম রাজনৈতিকভাবে আমাদের অবস্থানই সঠিক। আমাদের সোজা হিসেব ছিল, জেএসএসের পক্ষে আর আন্দোলন করা সম্ভব নয় এবং তাদের সেই ইচ্ছা বা সামর্থ্য কোনটাই নেই। তাই আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এবং অগ্রসর করে নিতে হলে একটি নতুন পার্টি গঠন করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। এটা সময়ের দাবি এবং আমাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। কারণ রাজতান্ত্রিক যুগের অবসানের পর বর্তমান যুগে পার্টি না থাকলে জনগণের কিছুই থাকে না। জনগণ সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। তাই যুগের প্রয়োজন মেটাতে তিন সংগঠন ১৯৯৮ সালের ২৫-২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি পার্টি প্রস্তুতি সম্মেলনের আয়োজন করে এবং অনেক আলোচনার পর ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।

নয়া যুগের এই পার্টির প্রাথমিক ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে: “পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্ভাগা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সত্যিকারভাবে জনপ্রতিনিধিত্বশীল অপর কোন পার্টি বা দলের অস্তিত্ব পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকলে, আমাদের নতুন করে আর কোন পার্টি গঠনের প্রয়োজন হতো না। ’৮৯-এর ছাত্র জাগরণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা গণতান্ত্রিক শক্তি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন জনস্বার্থের প্রতিনিধিত্বশীল পার্টিতে যুক্ত হয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যৌক্তিক ভূমিকা পালন করতো।

”কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সে ধরনের কোন পার্টির অস্তিত্ব নেই। জনসংহতি সমিতি এতদিন যাবৎ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে আন্দোলন সংগ্রাম করলেও, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে চুক্তি ও আত্মসমর্পন করে পুরোদস্তুর রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়েছে।” (স্বাধিকার, বুলেটিন নং ৯, ১৫ মার্চ ১৯৯৯)

২৭-২৮ বছর আগে ইউপিডিএফ যা বলেছে তা আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছে। ইউপিডিএফ আন্দোলনের সঠিক পথে রয়েছে এটা আজ সবার কাছে স্পষ্ট। এজন্য শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ি জনগণকে নেতৃত্বহীন করতে ইউপিডিএফকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ইউপিডিএফকে ধ্বংস করা কোন অপশক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। ইউপিডিএফের নেতৃত্বে পাহাড়ে জনগণের অধিকার একদিন অর্জিত হবেই হবে।

(২৫ ডিসেম্বর ২০২৫)



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments