""

পানছড়িতে ইউপিডিএফের আলোচনা সভা, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান

পানছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর ২০২২

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলন জোরদার করতে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরী। এই লক্ষে পাহাড়ের ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। পাহাড়ি জনগণকে চলমান এই সংঘাত বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলতে হবে

আজ শুক্রবার (২রা ডিসেম্বর ২০২২) দুপুর ১২ টায় খাগড়াছড়ির পানছড়িতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর পানছড়ি ইউনিটের উদ্দ্যোগেবর্তমান পরিস্থিতি, পার্টি জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধে জনগণ-বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকাশীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

আন্তঃ জুম্ম ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের বিপক্ষে জনমত গড়ে তুলুন’ এই আহ্বানে আয়োজিত সভায় ইউপিডিএফ পানছড়ি ইউনিটের সমন্বয়ক আয়চুক ত্রিপুরার সভাপতিত্বে পিসিপির নেতা সংগঠক মিথন চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মিসেস মনিতা ত্রিপুরা, ১নং লোগাং ইউপি চেয়ারম্যান  জয় কুমার চাকমা, ২নং চেঙ্গী ইউপি চেয়ারম্যান  আনন্দ জয় চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বরুণ চাকমা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা সাধারণ সম্পাদক শান্ত চাকমা

এছাড়াও সভায় উপস্থিত ছিলেন ৩নং পানছড়ি সদর ইউপি চেয়ারম্যান উচিত মনি চাকমা, ৪নং লতিবান ইউপি চেয়ারম্যান  বাবু ভূমিধর রোয়াজা, বিশিষ্ট মুরুব্বি অরুণ চন্দ্র চাকমা, দেব মিত্র ত্রিপুরা, বিশিষ্ট মুরুব্বি বাবু মিলন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক মিসেস পরিণীতা চাকমা প্রমূখ।

আলোচনা সভায় ইউপিডিএফ-এর নেতা আইচুক ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার হারা পাহাড়ি জনগণের মুক্তির লক্ষে পার্টি জনগণের সম্পর্ক সুদৃঢ় এক মন এক প্রাণ হওয়া উচিৎ।  যাতে আমাদের সু-মহান লক্ষে এগিয়ে যাওয়ার পথে শাসকগোষ্ঠীসহ কোন অপশক্তি রোধ করতে না পারে। সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ রেখে জাতি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার করতে পারি।

সংঘাত বন্ধের লক্ষে জনগণ বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে মন্তব্য করে ইউপিডিএফ নেতা বলেন, প্রত্যেকটি দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে জনগণ, লেখক-বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী লোকেরাই কোন না কোন ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দিকে তাকালে আমরা  অবস্থা দেখতে পাই। পার্বত্য চট্টগ্রামে অতীতে কিছু বুদ্ধিজীবী ভূমিকা রাখলেও বর্তমানে খুবই কম সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে লড়াই-সংগ্রাম নিয়ে ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে। একটি পরিপূর্ণ জাতি সমাজ গঠনের জন্য এবং জাতীয় মুক্তির লক্ষে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এগিয়ে না আসলে কিংবা ভূমিকা পালন না করে জাতি আরো অনেক পিছিয়ে পড়ে যাবে, সমাজ রসাতলে যাবে।

পাহাড়ে ভ্রাত্বিঘাটি সংঘাতকে শাসকগোষ্ঠী উস্কে দিচ্ছে মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী চাই পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত অব্যাহত থাকুক। তারা সংঘাত জিইয়ে রেখে তাদের স্বার্থ হাসিল করে। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ভ্রাত্বিঘাতি সংঘাতকে নানাভাবে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে।

সংঘাত বন্ধে ইউপিডিএফ-এর অবস্থান সম্পর্কে তুলে ধরে তিনি বলেন, ইউপিডিএফ জাতির স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পাহাড়ি জনগণকে সাথে নিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে গড়ে তুলতে চাই। আমাদের পার্টি চাই শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষনের কবলে থেকে পাহাড়ি জনগণকে মুক্তি করতে। আর লক্ষে পার্টি সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে, নেতা-কর্মীদের আত্মবিসর্জন দিয়েও সংঘাত বন্ধের জন্য নানানমুখী চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

জেএসএস সন্তুপন্থীদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, শাসকগোষ্ঠির ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে জেএসএস ইউপিডিএফের সাথে ২০১৮ সালে হওয়া সমঝোতা লঙ্ঘন করে দীঘিনালায় ইউপিডিএফ কর্মী জীবন ত্রিপুরাকে হত্যার করে পাহাড়ে আবারো ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত শুরু করেছে। এর মাধ্যমে তারা রাজনৈতিক অপরিপক্কতা পরিচয় দিয়েছে এবং জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা তথা সংঘাত বন্ধের আহ্বানকে উপেক্ষা করেছে। জেএসএস যদি শাসকের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারে, জনগণের স্বার্থে আন্দোলন না করে তাহলে এর পরিণাম তাদের দলের সকলকে ভোগ করতে

তিনি, অবিলম্বে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ জেএসএস (সন্তু) ইউপিডিএফ নির্মূল নীতি পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

আলোচনা সভায় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মনিতা ত্রিপুরা বলেন, যারা পাহাড়ে ভ্রাত্বিঘাতি সংঘাত চাই তারা প্রকৃত পক্ষে জনগণের বন্ধু হতে পারে না। বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিস্থিতি এটাই বলে যে হিংসা, বিদ্বেষ, সংঘাত বন্ধ করে অধিকারের জন্য লড়াই করা। পাহাড়ি জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলতে না পারলে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না।

তিনি দল-মত পার্থক্য ইতি না টেনে ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি বন্ধ করে সকলকে জনগণের সেবক হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য আহ্বান জানান।

আলোচনা সভায় চেঙ্গী ইউপি চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমা বলেন, সরকার উন্নয়ন করছে তাতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু উন্নয়নের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাহাড়িদের নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, রাস্তাঘাট নির্মাণের নামে ভূমি বেদখল করা হচ্ছে সর্বোপুরি পাহাড়িদের অস্তিত্বকে ধ্বংস করার জন্য একের পর ষড়যন্ত্র পরিচালনা করছে তাাতে আমাদের সকলের অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের আপত্তি রয়েছে। তাই জনগণ ভূমি অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে থাকে।

তিনি বলেন, শুধুমাত্র আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল নয়, এদের পাশাপাশি সমগ্র জাতির শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাহাড়িদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে এবং জাতির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে  সামিল হওয়া প্রয়োজন।

লোগাং ইউপি চেয়ারম্যান জয় কুমার চাকমা বলেন, বর্তমান  সরকার ১৯৯৭ সালেরপার্বত্য চুক্তিকথা ভূলে গিয়েছে। চুক্তি ২৫ বছর পূর্ণ হলেও চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন করা হয়নি। অপরদিকে চুক্তি স্বাক্ষরকারী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস (সন্তু) চুক্তি পূর্ণবাস্তবায়নের দাবি নিয়ে সরকারকে চাপ দেয়ার মত কোন কর্মসূচি বা আন্দোলন আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

তিনি আরো বলেন, শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণকে ধ্বংস করার জন্যভাগ করে, শাসন করনীতি প্রয়োগ করছে। শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ি জনগণকে বিভক্ত করে জুম্মো দিয়ে জুম্মো  ধ্বংস করার এক সু-গভীর  ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। ফলে পাহাড়ি জনগণ উদ্বেগ, উৎকন্ঠা নিয়ে প্রতিনিয়ত জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

তিনি বলেন, ভ্রাত্বিঘাতি সংঘাত পাহাড়ি জনগণের জন্য সুখকর নয়, এই সংঘাত আমরা কেউ চাই না। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পাহাড়ে রাজনৈতিক দলসমূহ এই সংঘাত বন্ধের জন্য আন্তরিকতার সাথে সকলকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংঘাতের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা প্রয়োজন।

সভায় বরুন চাকমা বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশের সংবিধানে পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকার স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে নামে-বেনামে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ক্যাম্প সম্প্রসারণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে সমতল থেকে নিয়ে আসা সেটলার বাঙালিদের লেলিয়ে দিয়ে পাহাড়িদের ভূমি বেদখল করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তিতে পাহাড় থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও সরকার উল্টোটা করছে। কয়েক বছর আগে থেকে আরো নতুন করে সেনাক্যাম্প পুনঃস্থাপন করেছে এবং পাহাড়ে পরিত্যক্ত সেনাক্যাম্পে স্থলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হচ্ছে। এটি সরকার ভূমি বেদখলের আরেক নতুন কৌশল হাতে নিয়েছে মন্তব্য করেন।

পিসিপি নেতা শান্ত চাকমা বলেন, দেশের বতর্মান শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখমুখি। আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকার নানান অজুহাতে শিক্ষার উপকরণের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব পার্বত্য চট্টগ্রামে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা ব্যবস্থা এমন একপ্রান্তে পৌছে গেছে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষাগ্রহণের কোন সুযোগ নেই। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট, জেলা পরিষদের শিক্ষক নিয়োগের প্রবল দুর্নীতি এখনো চলমান রয়েছে। ফলে এবারে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে পাহাড়ে অকৃতকার্য সংখ্যায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজীতে ফেল করেছে। এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, নিজেদের ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলনে সামিল হতে হবে।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সরকার, রাষ্ট্রীয় বাহিনী জনগণের অধিকার খর্ব করতে প্রতিনিয়ত একের পর এক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি জনগণকে টিকে থাকতে হলে আগামী দিনগুলোতে আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়া কোন বিকল্প নেই।





0/Post a Comment/Comments