""

বান্দরবানে কেএনএফ-কে নিয়ে অস্বস্তিতে সরকারি বাহিনী ও জেএসএস

বান্দরবান প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ১৭ মার্চ ২০২৩

ছবিগুলো কেএনএফ-এর ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া হয়েছে।  -প্রতিনিধি

বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-কে নিয়ে চরম অস্বস্তিতে পড়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস। সরকারি বাহিনীগুলো যেভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে “বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গী দমন অভিযান” শুরু করেছে তা যেন ফাঁকা বুলিতে পরিণত হতে চলেছে। উল্টো এখন সাধারণ জনগণের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের ব্যাপক অভিযোগ উঠে আসছে।

জেএসএস-এর বরাবরই অভিযোগ ছিল কেএনএফ সৃষ্টির পেছনে সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। তবে কেএনএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা নাথাম বম এক সময় জেএসএস-এর ছাত্র সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। খাগড়াছড়িতে এমএন লারমার ভাস্কর্য নির্মাণেও রয়েছে নাথান বমের বিশেষ অবদান।

একটি নব্য ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠিকে প্রশিক্ষণ দানের অভিযোগে গত বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সেনাবাহিনী ও র‌্যাব কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে কম্বিং অপারেশন চালাচ্ছে। এই অপারেশন এখনো চলমান রয়েছে। এই অপারেশনে জেএসএসও পরোক্ষভাবে অংশীদার রয়েছে বলে বিশেষ সূত্রে জানা গেছে। মূলত জেএসএসই চাচ্ছে কেএনএফকে নির্মুল করতে। কিন্তু কেএনএফ’র সাথে তারা পেরে না উঠে সরকার, সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের শরণাপন্ন হয় দলটি। কেএনএফ’র তথ্য উপাত্ত সংগ্রহসহ নানাভাবে জেএসএস সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা প্রদান করছে বলে সূত্রটি জানায়। কিন্তু এই অপারেশন চলার মধ্যেই গত ১২ মার্চ রোয়াংছড়িতে কেএনএফ’র সশস্ত্র সদস্যদের আক্রমণে সেনাবাহিনীর একজন ওয়রেন্ট অফিসার নিহত ও আরো ২ জন সৈনিক আহত হয়েছেন। এছাড়া থানচি এলাকায় রাস্তা নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ ও ৪ জন শ্রমিক তুলে নিয়ে যাওয়া এবং বোমা মেরে সেতু উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে কেএনএফ। এসব ঘটনার পর আবারো নতুন করে রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় পর্যটক ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও সর্বশেষ গতকাল (১৬ মার্চ) কেএনএফ রুমা উপজেলার কেওক্রাডং এলাকা থেকে সড়ক নির্মাণ কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এক সার্জেন্ট ও অপর দুই শ্রমিককে তুলে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।

চলমান কম্বিং অপারেশনের মধ্যে কেএনএফের এমন সশস্ত্র তৎপরতা চরম অস্বস্তিতে ফেলেছে সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও জেএসএসকে। কারণ সেনাবাহিনী ও র‌্যাব যতই অপারেশন জোরদার করছে কেএনএফও তাদের সশস্ত্র কার্যক্রমের পরিধি বাড়াচ্ছে। দীর্ঘ ৫ মাসের অধিক কম্বিং অপারেশনে সেনাবাহিনী ও র‌্যাব ‘জঙ্গী’ ও ‌‘কেএনএফ সদস্য’ আটকের ‌‘নাটক’ ছাড়া বড় কোন সফলতা লাভ করতে পারেনি। কেএনএফকে নিবৃত্ত করা তো দূরের কথা এখন উল্টো তারা কেএনএফের হামলার শিকার হচ্ছেন। তবে এই অপারেশনের প্রত্যন্ত এলাকার বম জনগোষ্ঠি চরম অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়ে ইতোমধ্যে বম জনগোষ্ঠির নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধসহ ৩ শতাধিক লোক বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে ভারতের মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। অনেক নিরীহ লোককে আটক করে কেএনএফের সদস্য বানিয়ে জেলে আটক রাখা হয়েছে। এই ধরপাকড় এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি থানচিতে সেনা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে এক গর্ভবতী বম নারীকে ধর্ষণ-নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে, কেএনএফ’র বিরুদ্ধে জেএসএস’র প্রচারণা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তারা বরাবরই কেএনএফ-কে সেনাবাহিনীর সৃষ্টি বলে তাদের প্রচার মাধ্যম হিল ভয়েসে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। গত বছর অক্টোবর থেকে কেএনএফের বিরুদ্ধে র‌্যাব যত অভিযোগ উত্থাপন করেছে এবং ‍‘জঙ্গী আটকে’র ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করেছে তার প্রায় সব সংবাদ জেএসএস তাদের নিউজ পোর্টাল হিল ভয়েসে গুরুত্বসহকারে প্রচার করেছে। কিন্তু সম্প্রতি তারা তাদের সুর পাল্টাতে শুরু করেছে। ইদানিং হিল ভয়েসে প্রচারিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে এ পর্যন্ত র‌্যাব বান্দরবানে কেএনএফ’র ডেরা থেকে ‌'‌ইসলামী জঙ্গী আটকের’ যেসব ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশ করেছে সেসবই ‘ভূয়া’ বলে এখন তারা তুলে ধরছে! এতেই স্পষ্ট হয় যে, তারা (জেএসএস) যেভাবে র‌্যাব ও সেনাবাহিনীকে দিয়ে কেএনএফকে নির্মূল করতে চেয়েছে সেটা আর হচ্ছে না। এমনকি এ যাবত তারা কেএনএফকে সেনাবাহিনীর সৃষ্টি বলে যে প্রচারণা চালিয়ে এসেছে সেনাবাহিনীর সাথে সশস্ত্র সংঘর্ষের মাধ্যমে কেএনএফ তাও ভুল প্রমাণ করে দিচ্ছে। এতে জেএসএস এতদিন কেএনএফের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালিয়েছে বলেও জনগণের কাছে প্রতীয়মান হতে শুরু করেছে। ফলে এখন জেএসএস যে মস্তবড় বেকায়দায় পড়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

মূলত শাসকগোষ্ঠি তথা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘ভাগ করে শাসন করার’ কূটকৌশল প্রয়োগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। আর সরকারের এই কৌশলের প্রধান অংশীদার হচ্ছেন সন্তু লারমা ও তার দল জেএসএস। মূল দাবি পাঁচ দফা থেকে সরে এসে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ধুরন্ধর আওয়ামী লীগের সাথে চুক্তিতে উপনীত হয়ে সন্তু লারমা সরকারের সাথে সেই কূটকৌশলে অংশীদার হয়েছিলেন। তারপর থেকে তিনি জাতিকে ভেঙে চুরমার করা ছাড়া একতাবদ্ধ করতে পারেননি। ‘একমাত্র জেএসএস-ই পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজত্ব করবে’-- এমন মানসিকতা নিয়ে সন্তু লারমা ও তার দল জেএসএস পাহাড়ি জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে রেখেছেন। কেএনএফ ও জেএসএস’র মধ্যেকার দ্বন্দ্বটাও ঠিক সেখানেই।

একটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় যে, যিনি কেএনএফ সৃষ্টি করেছেন সেই নাথান বমকে এক সময় জেএসএস-এ যোগ দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতে যোগ না দিয়ে কুকি-চিন ভুক্ত জনগোষ্ঠির উন্নয়নের কথা বলে ‘কেএনডিও’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তুললে জেএসএস তাতে বাধ সাধে এবং নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এতে করে নাথান বম পুরোদমে বিগড়ে যান এবং জেএসএস’র বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। পরে তিনি তার সংস্থার নামটি বদল করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এ রূপান্তর করেন ও তার অধীনে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) নামে একটি সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে তোলেন। আর এতে কেএনএফ’র সাথে জেএসএস-এর সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। উভয় পক্ষ বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন এবং ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হন। এক পর্যায়ে কেএনএফ রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় হামলা চালিয়ে জেএসএস’র সশস্ত্র ঘাঁটি দখল করে নেয়। ওই হামলায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির ৩ জন নিহত ও দুই শিশু আহতের ঘটনা ঘটলে এ নিয়ে জেএসএস কেএনএফের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালায় এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠিকে ব্যবহার করে কেএনএফের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়ে জাতিগত সংঘাত উস্কে দেয়ারও চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও জেএসএস সফল হয়নি। কোনভাবেই কেএনএফকে নিবৃত্ত করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে শেষ পর্যন্ত জেএসএস সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কম্বিং অপারেশনে সম্পৃক্ত হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এতেও জেএসএস সুবিধা করতে পারবে না। একইভাবে জনগণের লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মাসের পর মাস অপারেশন জারি রেখে জনগণের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন চালানোর ফলে সেনা-র‌্যাবের চলমান যৌথ কম্বিং অপারেশন নিয়েও জনমনে নানা সন্দেহ, আশঙ্কা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, শাসকগোষ্ঠি তথা সরকার ও তার বাহিনীগুলো পাহাড়িদের বিরুদ্ধে ‘ভাগ করে শাসন করার’ যে কৌশল নিয়েছে তা চরম ভূল। এর থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এছাড়া সরকারের উচিত পাহাড়িদের ওপর চলমান অন্যায় দমন-পীড়ন ও জোর-জুলুম বন্ধ করে দেশের ও জনগণের মঙ্গলের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল পক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানপূর্বক শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments