""

লংগদু গণহত্যার ৩৫ বছরে বম জাতিসত্তাদের হত্যা

 মুক্তমত 


 অগ্নিগর্ভ চাকমা 

সদস্য, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


প্রতীকি ছবি




৪ঠা মে ছিল লংগদু গণহত্যা দিবস। ঠিক ৩৫ বছর আগে এই দিনে সেনা-সেটলারদের যৌথ হামলায় লংগদুতে সংঘটিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক ভয়াল দিন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, সেদিন তৎকালীন লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকারকে দূর্বৃত্তরা হত্যার আড়াই ঘন্টা পর সেনাবাহিনীর যোগসাজশে প্রায় ৩৬ জনের অধিক পাহাড়ি নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করে সেটলার বাঙালিরা।  রিপোর্টে এটাও উল্লেখ করা হয় যে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরোও বেশি হতে পারে।  ৬টির অধিক পাহাড়ি গ্রামের শতশত ঘর-বাড়ি, প্যাগোডা ও গির্জায় অগ্নিসংযোগ করা হয়।  

সেই গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া অনেকেই পার্শবর্তী দেশ ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম সহ বেশ কিছু জায়গায় আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন।  সেসময় এই গণহত্যার প্রতিবাদে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, প্রাক্তন সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা, প্রাক্তন সংসদ সদস্যা সুদীপ্তা দেওয়ান, প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান, তৎকালীন রাঙামাটির স্থানীয় সরকার পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান ও রাঙামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মায়াধন চাকমাসহ ২২ সদস্য বিশিষ্ট পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন।  কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সেসময় স্বৈরশাসক এরশাদের সরকার ক্ষমতাসীন থাকায় এই ঘটনা সম্পর্কে কোনো সংবাদমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেনি, কিংবা করতে পারেনি।  

এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদের জের ধরে ১৯৮৯ সালের ২০ শে মে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের আলোচনার মাধ্যমে জন্ম লাভ করে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)।  প্রতিষ্ঠার একদিন পর পিসিপির নেতৃত্বে ঢাকায় মৌন মিছিল করা হয় লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে। কিন্তু দীর্ঘ ৩৫ বছরে দেশে ক্ষমতার নানা রদবদল হলেও কোন সরকারই এই গণহত্যার বিচার ও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার শাাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবৎ সংঘটিত ডজনের অধিক গণহত্যারও কোন বিচার হয়নি। এমনকি এসব গণহত্যার সঠিক তদন্ত রিপোর্টও আজ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত এসব হত্যাযজ্ঞের বিচার না হওয়ায় বার বার সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হতে হচ্ছে পাহাড়ি জনগণকে।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে গত বৃহস্পতিবার বান্দরবানে যৌথ বাহিনীর কেএনএফ-বিরোধী অভিযানের সময় রোয়াংছড়ি উপজেলার পাইক্ষ্যং পাড়া থেকে ২১ জন সাধারণ গ্রামবাসীকে আটক করা হয়, যাদের খোঁজ এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।এদের মধ্যে গতকাল চ্যানেল ২৪ নামে একটি টিভি চ্যানেলে ১ জনের লাশ উদ্ধারের তথ্য জানানো হলেও বাকীদের সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। 

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আটককৃতদের মধ্য থেকে অন্তত ৫ জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে।  অপরদিকে যে ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের তথ্য পাওয়া গেছে তার নাম লালমিন তলুয়াং বম (২৫)। তিনি একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলে তার পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত করেছেন। তাই এটা সুনিশ্চিত যে এইসব হত্যার পিছনে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ রয়েছে। যার কারণে রাষ্ট্র চায় না এইসব মানবাধিকার বিরোধী অপকর্মের বিচার হোক।

লংগদু গণহত্যার ৩৫ বছরে কোন বিচার তো দূরের কথা উপরন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো বমসহ অন্য সংখ্যালঘু জাতিসসত্তাগুলোর উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলছে, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

তাই সরকার তথা রাষ্ট্রের উচিত অবিলম্বে লংগদু গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ওপর এযাবৎ সংঘটিত সকল গণহত্যার শ্বেতপত্র প্রকাশ করে যথাযথ বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা। 

তারই সাথে রোয়াংছড়ির পাইক্ষ্যং পাড়া থেকে সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক করে নিয়ে যাওয়া গ্রামবাসীদের সন্ধান দেয়া, চলমান যৌথ বাহিনীর অভিযানের নামে নিরপরাধ বমসহ অন্যান্য জাতিসত্তার ওপর অন্যায় দমন-পীড়ন বন্ধ, গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি প্রদান, সকল খুনের বিচার এবং ভয়ভীতিমুক্ত স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাচ্ছি। মনে রাখতে হবে, যতদিন পর্যন্ত বিচার হবে না ততদিন পর্যন্ত জনগণ এসব হত্যাযজ্ঞের বিচারের দাবি জানাতেই থাকবে।

[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত]


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।









0/Post a Comment/Comments