![]() |
বাড়ি পুড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মন্টু চাকমাসহ তার পরিবারের সদস্যরা। |
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
গত সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে আগুনে একটি
বাড়ি পুড়ে যাচ্ছে- এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভিডিওর ক্যাপশনে
‘সেটলাররা পেট্রোল ঢেলে দিয়ে বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে’ বলে উল্লেখ করা হয়। মুহুর্তের মধ্যে
ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে পড়ে। অনেকে এ ঘটনাটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ঘটনার বিস্তারিত জানার
চেষ্টা করেন।
পরবর্তীতে খোঁজ খবর নিয়ে ঘটনাটি বগাছড়ির কৈলাশ পাড়ায় বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।
অগ্নিসংযোগের ঘটনা সম্পর্কে যা জানা গেল
স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা যায়, ঘটনার দিন সকাল
সাড়ে ৬টা-৭টার মধ্যে মন্টু চাকমার বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় মন্টু চাকমা
ও তার পরিবারের কেউই বাড়িতে ছিলেন না। তারা খুব ভোরে সবাই বিভিন্ন কাজে বাইরে গিয়েছিলেন।
পরে পাড়ার লোকজন আগুন লাগার শব্দ শুনতে পান। প্রথমে তারা মনে করেছিলেন আনারস বাগানের
জন্য হয়তো মন্টু চাকমা জঙ্গল পুড়ে ফেলছেন। কিন্তু পরে তারা গিয়ে দেখেন মন্টু চাকমার
বাড়িটি পুড়ে যাচ্ছে। বাড়ির চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। তারা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।
কিন্তু আগুনের মাত্রা বেশি হওয়ায় তারা আগুন নেভাতে সক্ষম হননি। আগুনে সম্পুর্ণ বাড়ি
ও জিনিসপত্র ভস্মীভূত হয়।
আগুন নেভাতে যাওয়া লোকজন মন্টু চাকমা ও তার
স্ত্রীর কাছ থেকে জেনে নিয়ে বাড়ির চুলায় কোন আগুন না থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হন এবং তাকে
তার বাড়িটি পুড়ে যাওয়ার ঘটনাটি জানান। এ সময় সেখানে অনেকে “এটি নিশ্চিত ‘বাঙালিরা”
করেছে” বলে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে শোনা যায় ভিডিওতে।
আগুনের মাত্রা দেখে অনেককে এও মন্তুব্য করতে
শোনা যায় (ভিডিওতে) যে, ‘নিশ্চয় পেট্রোল ঢেলে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। না হলে
এভাবে চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ার কথা নয়’।
আগুন নেভাতে যাওয়া পাড়ার এক নারী বলেন, আমরা কাজে গিয়েছিলাম। পরে আগুনের খবর পেয়ে এসে দেখি ততক্ষণে বাড়িটির চতুর্দিকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেও নেভাতে পারিনি।
ভুক্তভোগী মন্টু চাকমার ভাষ্য
সামাজিক মাধ্যমে ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর
সিএইচটি নিউজের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা জানার চেষ্টা করা হয় এবং
তাদের মাধ্যমে ভুক্তভোগী মন্টু চাকমার বক্তব্য জেনে নেওয়া হয়। স্থানীয় লোকজনের কাছে
দেওয়া তার (মন্টু) ভাষ্য মতে, কিছুদিন ধরে তাকে কয়েকজন বাঙালি (সেটলার) মোবাইলের মাধ্যমে
নানা হুমকি দিয়ে আসছিল। অবশ্য পরে তিনি নানা চাপের মুখে সে বিষয়টি আর বলার সাহস পাননি।
স্বামী-স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে মন্টু
চাকমার সংসার। অনেক কষ্ট করে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনাসহ জীবন নির্বাহ করে আসছেন তিনি।
তিনি জানান, ঘটনার দিন তারা স্বামী-স্ত্রী রাঙামাটিতে বিক্রির জন্য তরিতরকারি সংগ্রহ করতে খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। তার বড় ছেলেকে পালিত গরুটিকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে যান। আর মেজো ছেলেকে স্কুলে ও মেয়েকে প্রাইভেট পড়তে যেতে বলে যান। আগুনের খবর পেয়ে তারা যখন বাড়িতে ফিরে আসেন তখন বাড়িটি সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে যায়, বলেন তিনি।
ঘটনাটি নিয়ে কেন সেটলারদের দোষারোপ করা হচ্ছে?
নান্যাচরের বগাছড়ি ও আশে-পাশের এলাকায় রাষ্ট্রীয়ভাবে
পুনর্বাসিত সেটলার বাঙালিরা প্রায় সময়ই পাহাড়িদের জায়গা-জমি বেদখল করার চেষ্টা করে
থাকে। ইতোমধ্যে তারা বিশাল পরিমাণ জায়গা-জমি বেদখল করে নিয়েছে। ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর
বগাছড়ি এলাকার তিনটি পাহাড়ি গ্রামে সেটলার বাঙালিরা হামলা, ঘরবাড়ি-দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ,
ভাঙচুর, লুটপাট চালিয়েছিল। এতে ৬০টির অধিক বাড়ি-দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কাজেই,
এ অগ্নিসংযোগের ঘটনাটির জন্যও বাঙালিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠা স্বাভাবিক।
বুড়িঘাট ইউপি চেয়ারম্যান প্রমোদ খীসাও বলেছেন, অতীতের নানা ঘটনার কারণে এ এলাকায় কোন ঘটনা ঘটলে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করা হয়ে থাকে।
মামলার সাক্ষী হওয়ায় হুমকি
আগুনের সময় মন্টু চাকমা ও তার পরিবারের সদস্যরা
বাড়িতে ছিলেন না, ফলে কারা আগুন দিয়েছে তারা তা দেখেননি।
তবে মন্টু চাকমা বলেছেন, তার কাকার ভূমি বিরোধ
সংক্রান্ত একটি মামলা চলমান রয়েছে। সেই মামলায় তাকে সাক্ষী করা হয়েছে। মামলার সাক্ষী
হওয়ার কারণে বিবাদীরা তাকে ঝামেলা করার কথা তিনি বলেছেন।
উক্ত মামলার বিবাদীরা হলেন- আলীম শেখ ও জাহাঙ্গীর
শেখ। তাদের বাড়ি বগাছড়িতে।
জানা গেছে, অগ্নিসংযোগের ঘটনার দুই দিন আগে মন্টু চাকমা মামলার সাক্ষ্য দিতে আদালতে গিয়েছিলেন। আদালত থেকে বাড়ি ফেরার পর পরই বিবাদীরা তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছিল।
ঘটনার পর সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও বাঙালিদের তৎপরতা
স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা যায় যে, ঘটনার পরপরই
ঐদিন সকাল থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলের আশে-পাশে গিয়ে অবস্থান নেয়। তারা ভুক্তভোগী
মন্টু চাকমার পরিবারকে নজরদারির মধ্যে রাখে এবং পাড়ার লোকজন যারা অগ্নিসংযোগের ভিডিও-ছবি
মোবাইল ফোনে ধারণ করেছিলেন তারা সেগুলো মুছে ফেলতে বাধ্য হন। ভিডিও ধারণ ও ছবি তুলতে
বাধা দেওয়া হয়। আর মন্টু চাকমাকে ‘বাড়িতে কারা আগুন দিয়েছে তা তিনি দেখেন নাই’ এমন
কথা বলতে বলা হয়।
এমতাবস্থায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি করে মন্টু চাকমার জন্য বাড়ি তৈরি করে দেয়ার প্রচেষ্টা চলে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিএনপির নেতৃবৃন্দ ও একজন সাংবাদিক সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। প্রশাসন ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে ইউএনও মন্টু চাকমা’র পরিবারের জন্য অর্থ সহায়তাসহ নানা সহযোগিতা প্রদান করেন বলে জানা যায়। তারা ঘটনাটিকে ‘গুজব’ ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানি’ ইত্যাদি আখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। তবে তদন্ত ব্যতীত এভাবে ‘গুজব’ ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানি’ বলা প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে ধামাচাপা দেয়ার মতলব ছাড়া কিছুই নয় বলে মনে করছেন এলাকার সচেতন মহল।
ঘটনা কী আসলে সত্য নাকি গুজব?
মন্টু চাকমার বাড়ি আগুনে পুড়ে গেছে তা একটি সত্য ঘটনা। আর ‘সেটলার বাঙালি’রা মন্টু চাকমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে বলে যে কথা প্রচার হয়েছে সে বিষয়েও স্থানীয়দের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া থেকে বুঝা গেছে। অন্যদিকে, ঘটনার পরপরই সেনাবাহিনীর ভূমিকা, গ্রামবাসীরা ছবি-ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলে বাধ্য হওয়ার মধ্যেও ঘটনাটির সত্যতা মেলে। কাজেই এ ঘটনাকে ‘গুজব’ বলে চালিয়ে দেয়ার মধ্যে সত্য আড়াল করার যে সুগভীর মতলব রয়েছে তা সহজেই বুঝা যায়।
গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুন লাগার বিষয়টি কতটুকু সঠিক?
ঘটনার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ইউএনও এবং সাংবাদিক হিমেল চাকমা’র ভাষ্যমতে পোড়া বাড়িতে পুরোনো
একটি গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া গেছে। সেখান থেকেও আগুন লাগতে পারে।
তবে বাড়ির মালিক মন্টু চাকমা বলেছেন, তারা
২/৩ মাস ধরে ওই গ্যাস সিলিন্ডারটি ব্যবহার করছেন না। তার পরিবারের লোকজনের সাথে কথা
বলে স্থানীয়রা নিশ্চিত করেছেন সিলিন্ডারে কোন গ্যাস ছিল না। সুতরাং গ্যাস না থাকা অবস্থায়
সিলিন্ডার বিফোরণ হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। অথচ তারা গ্যাস সিলিন্ডারকে আগুনের সূত্রপাত
হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন।
আর বাড়িটি যেহেতু আগুনে পুড়ে গেছে সে কারণে বাড়িতে থাকা অন্যান্য জিনিসপত্রের সাথে গ্যাস সিলিন্ডারটিও অর্ধপোড়া অবস্থায় রয়েছে। প্রকৃত অর্থে বিস্ফোরণ হলে সিলিন্ডারটি আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতো। কাজেই, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে বাড়িতে আগুন লাগার যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে তাতেও ঘটনা আড়ালের উদ্দেশ্য রয়েছে তা স্পষ্ট।
ভূমি বিরোধই কী অগ্নিসংযোগের কারণ?
বগাছড়ি এলাকায় পাহাড়ি ও সেটলার বাঙালিদের
মধ্যে ভূমি বিরোধ বহু পুরোনো। মূলত সেটলাররা পাহাড়িদের জায়গা-জমি বেদখলের ফলে এ বিরোধটা
সৃষ্টি হয়েছে। বগাছড়িসহ নান্যাচরের বিভিন্ন জায়গায় সেটলাররা প্রায় সময় পাহাড়িদের জায়গা-জমি
বেদখলের চেষ্টা চালিয়ে থাকে। আর এতে পাহাড়িরা বাধা দিতে গেলে হয় সংঘর্ষ বাঁধে, নতুবা
হামলা ও ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। আর সেনাবাহিনী ও প্রশাসন বরাবরই সেটলাদের পক্ষাবলম্বন
করে থাকে। প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব ও সেটলারদের জোরপূর্বক ভূমি বেদখলের কারণে পাহাড়িরা
নিজেদের ভোগদখলীয় জায়গা-জমিগুলো প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে।
ঘটনার পর সাংবাদিক হিমেল চাকমা ঘটনাস্থলে গিয়ে ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের সাক্ষাতকার সংবলিত একটি ভিডিও তার ফেসবুকে দেন। এতে দেখা যায়, ভুক্তভোগী মন্টু চাকমা তার সাক্ষাতকারে বলেছেন যে, তার বসতভিটার জমি নিয়ে সেটলারদের সাথে বিরোধ না থাকলেও পাশের অন্য একজনের জায়গা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। তবে মন্টু চাকমা যখন জমি বিরোধ নিয়ে হিমেল চাকমার কথার উত্তর দিয়ে পাশের জমি নিয়ে বিরোধে কথা তুলে ধরেন তখন হিমেল চাকমা তার কথা থামিয়ে নিজেই কি যেন সমাধানের কথা উল্লেখ করেন। এতে মন্টু চাকমার কথা কেটে দিয়ে হিমেল চাকমা নিজের বক্তব্যটিকে প্রাধান্য দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, ভূমি বিরোধের কারণে মন্টু চাকমার বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়নি। তবে মন্টু চাকমা যেটুকু বলার চেষ্টা করেছেন তাতে মনে হয়েছে সেখানে সেটলারদের সাথে পাহাড়িদের ভূমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। সুতরাং, ভূমি বিরোধের কারণে অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি ঘটতে পারে তার ইঙ্গিত মেলে।
প্রশাসনের করণীয়
নান্যাচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল
পরিদর্শন করে ভূক্তভোগী পরিবারকে সহায়তা প্রদান করেছেন। এখন প্রশাসনের উচিত হবে নিরপেক্ষ
একটি তদন্ত কমিটি গঠনপূর্বক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অগ্নিসংযোগের রহস্য উদঘাটন করা।
ঘটনার সাথে যদি কেউ জড়িত থাকে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা। ভবিষ্যতে যাতে এ
ধরনের ঘটনা না ঘটে তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মন্টু চাকমা বর্তমানে
নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন। প্রশাসনকে অবশ্যই তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।