সাজেক প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
বিগত ২০১০ সালের ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি সাজেকে সেনা-সেটলাররা পাহাড়িদের ওপর এক
বর্বরোচিত সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। এতে লক্ষী বিজয় চাকমা ও বুদ্ধপুদি চাকমা নিহত
হন। এর আগে ২০০৮ সালে খুন হয়েছিলেন লাদুমনি চাকমা।
উক্ত হামলার ১৫তম বার্ষিকীতে আজ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার সাজেকের
উজোবাজারে সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহত লক্ষী বিজয় চাকমা, বুদ্ধপুদি চাকমা ও সেটলারদের
হাতে খুন হওয়া লাদুমনি চাকমার স্মরণে স্থায়ীভাবে নবনির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক
অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন, স্মরণসভা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটি, সাজেক গণঅধিকার রক্ষা কমিটি, ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদ, সাজেক জুমচাষী কল্যাণ সমিতি ও সাজেক কার্বারি সমিতি যৌথভাবে এই কর্মসূচির আয়োজন করে।
আজ সকাল সাড়ে ৭টায় উজোবাজারে ইউপিডিএফের কার্যালয়ের সামনে নবনির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে
পুস্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তুয়েল
চাকমা ও উদয়ন চাকমা; সাজেক গণঅধিকার রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে মেহেন্দ্র ত্রিপুরা ও বিদ্যুৎ
আলো চাকমা; সাজেক ভূমিরক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে নতুন জয় চাকমা ও অজয় চাকমা; সাজেক কারবারী
সমিতির পক্ষ থেকে নতুন জয় চাকমা ও প্রভাত কারবারী; সাজেক জুমচাষী কল্যাণ সমিতির পক্ষ
থেকে জ্যোতি লাল চাকমা ও জ্ঞান কার্বারি; পরিবেশ রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে ধারজ চাকমা
ও শুভরঞ্জন কার্বারি; সাজেক ও বঙ্গলতলী ইউপি’র এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে পুস্পস্তবক অর্পণ
করেন ৩৬ সাজেক ইউপি চেয়ারম্যান অতুলাল চাকমা ও উদয়ন চাকমা; গণসংগঠনের পক্ষ থেকে যৌথভাবে
পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন যথাক্রমে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর বাঘাইছড়ি উপজেলা সভাপতি
পলেন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের বাঘাইছড়ি উপজেলা সভাপতি বীর চাকমা ও সাজেক শাখার
সাংগঠণিক সম্পাদক শুক্র চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য
উজ্জ্বলা চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বাঘাইছড়ি শাখার সহসভাপতি সুখী চাকমা; শহীদ
পরিবার পক্ষ থেকে পুস্পস্তবক করেন শহীদ লক্ষী বিজয় চাকমার ছেলে লিটন চাকমা, বুদ্ধপুদি
চাকমার ছেলে জুয়েল চাকমা, লাদুমনি চাকমার পরিবারের পক্ষে বুদ্ধপুদির ছেলে জুয়েল চাকমা
ও লাদুমনি চাকমার ছেলে পতুল চাকমা এবং উজোবাজার কমিটির পক্ষ থেকে পুস্পস্তবক অর্পণ
করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন উজোবাজার কমিটির সভাপতি বিলাস কারবারী।
এরপর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।
“জাতীয় অস্তিত্ব ও ভূমি রক্ষায় সংগ্রাম ছাড়া বিকল্প নেই” এই শ্লোগানে
আয়োজিত স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টা কমিটির প্রধান
বিশ্বজিৎ চাকমা।
ছাত্র জনতার সংগ্রাম পরিষদের সদস্য বিশ্ব জ্যোতি চাকমার সঞ্চালনায় সভায়
আরো বক্তব্য বক্তব্য রাখেন, সাজেক ভূমিরক্ষা কমিটির সদস্য সচিব রতন চাকমা, সাজেক গণ
অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মেহেন্দ্র ত্রিপুরা, জুমচাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি জ্যোতি
লাল চাকমা, সাজেক পরিবেশ রক্ষা কমিটির সম্পাদক ধারজ চাকমা, কার্বারি সমিতি সভাপতি নতুন
জয় চাকমা ও ৩৬নং সাজেক ইউপি চেয়ারম্যান অতুলাল চাকমা।
সার্বিক বিষয় তুলে ধরে সভায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ছাত্র জনতা সংগ্রাম
পরিষদের সদস্য ও সাজেক গণঅধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব বাবু ধন চাকমা।
স্মরণসভা শুরুতে উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন
করেন।
সভায় রতন চাকমা বলেন, সাজেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। পিছনে যাবার কোন সুযোগ
নেই। সাজেকে ভূমি রক্ষায় বুদ্ধপুদি, লক্ষী বিজয় ও লাদুমনি যেভাবে প্রাণ দিয়েছেন তাদের
সেই চেতনাকে ধারণ করে আগামী দিনে এই সাজেক ভূমি রক্ষার্থে আমাদেরও ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই
সংগ্রাম করতে হবে।
মেহেন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, পৃথিবীতে জন্ম হয়েছি। তাই নিজের ও জাতীয় স্বার্থে
আমাদের কাজ করে যেতে হবে। ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়ে অমর হয়েছেন, সাজেক ভূমি
রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ লাদুমনি, লক্ষী বিজয় ও বুদ্ধপুদি চাকমাও সাজেকবাসীর
কাছে অমর হয়ে থাকবেন।
তিনি আগামীতে আরো সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে সাজেকের ভূমি রক্ষার সংগ্রাম জোরদার
করার আহ্বান জানান।
ধারজ চাকমা বলেন, আমাদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হলে লড়াই-সংগ্রাম করতে
হবে, রক্ত দিতে হবে। এ সময় তিনি সাজেক ভূমি রক্ষা করার জন্য বিগত দিনে শহীদদের মত রক্ত
দিতে পারবো কিনা এমন প্রশ্ন করলে উপস্থিতি জনতা সবাই হাত উঁচিয়ে তার কথার সমর্থন জানান।
জ্যোতি লাল চাকমা বলেন, আমাদেরকে অতীতের মত ঐক্যবদ্ধ থেকে লড়াই সংগ্রাম
করে বেঁচে থাকতে হবে।
সাজেক ইউপি চেয়ারম্যান অতুলাল চাকমা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে পূর্ববর্তী
বক্তাগণের বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানান।
নতুন জয় চাকমা বলেন, প্রকৃতি থেকে প্রাণের জন্ম। বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশ
সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক পরিবেশ অনুসারে রাজনৈতিক পরিস্হিতি উদ্ভব হয়। ব্যক্তি, পরিবার,
সামাজিক ও জাতীয় জীবনে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন হয় সংগ্রামের। সাজেকের ভূমি রক্ষার
সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন তাদেরকে ধারণ করে আগামী দিনের লড়াই সংগ্রাম বেগবান করার
আহ্বান জানান তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে বিশ্বজিৎ চাকমা বলেন, পৃথিবীতে সবাই মরে। কিন্তু মরনমাত্রই
শহীদ নয়। যারা সমাজ, জাত রক্ষায় জীবন দেন তারাই শহীদ, তারা মরেও অমর। আজকে সাজেক ভূমিরক্ষা
আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ বুদ্ধপুদি, লক্ষী বিজয় ও লাদুমনির স্মরণসভা করছি। স্মরণসভা
মানে সেই বীর শহীদদের স্মরণ করে বেঁচে থাকার লড়াই সংগ্রামকে উজ্জীবিত করা।
তিনি আরো বলেন, যৌবন যার যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ট সময় তার। সমাজ, জাতীর অস্তিত্ব
রক্ষায় যুবসমাজকে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ যুব সমাজই হচ্ছে একমাত্র লড়াই-সংগ্রামের
মূল শক্তি।
তিনি বলেন, সাজেকবাসী বিগত ২০০৮ ও ২০১০ সালে সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে
ও ভমি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ সংগ্রামের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সাজেকবাসীর এই ভূমি
রক্ষার আন্দোলন পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে ভুমি ও জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামকে প্রভাবিত
করবে আগামী দিনেও।
বক্তারা হামলার ১৫ বছরেও সুষ্ঠু বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
স্মরণসভা ছাড়াও ধর্মীয় দানানুষ্ঠান, ভিক্ষু সংঘের
ধর্মীয় সভা এবং সন্ধ্যায় ফানুস উত্তোলন কর্মসূচি থাকার কথা জানিয়েছেন আয়োজকরা।
বেলা ১:০০টায় ধর্মীয় সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে পার্বত্য ভিক্ষু ও বনভিক্ষু
সংঘ অংশগ্রহণ করেন।
ধর্মীয় সভায় শহীদ পরিবার পক্ষ থেকে শহীদ লক্ষী বিজয় চাকমার ছেলে লিটন চাকমা
শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলী পাঠ করেন। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান
সুমিতা চাকমা। এতে ধর্মদেশনা প্রদান করেন, বাঘাইহাট বনানী বনবিহার অধ্যক্ষ কৃপারত্ন
মহাস্থবির, দীঘিনালা বনবিহার অধ্যক্ষ শুভবর্ধন মহাথেরো, বালুখালী বালুরামপাড়া বৌদ্ধবিহার
অধ্যক্ষ কল্যাণ মিত্র এবং রাজবনবিহার অধ্যক্ষ প্রজ্ঞালংকার মহাথেরো।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।