বিশেষ প্রতিবেদন, সিএইচটি নিউজ
মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
আজ ২০ মে ২০২৫ বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর
৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৮৯ সালের এদিন ঢাকায় পাহাড়ি ছাত্র
পরিষদের জন্ম। মূলত ওই বছর ৪ঠা মে লংগুদু গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে
সেদিনের পাহাড়ি ছাত্র সমাজ এ সংগঠনের জন্ম দিয়েছিলেন। সংগঠনটি আপোষহীন সংগ্রামের
তিন যুগ পূর্ণ করলো।
লংগুদু হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানাতে প্রথম বৈঠক হয় ’৮৯ সালের ২০ মে বিকেলে
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের [বুয়েট] রশীদ হলের ২০০২ রুমে। সে মিটিঙ রাত
পর্যন্ত গড়িয়েছিলো। মিটিঙে বুয়েট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজশাহী, ময়মনসিংহ আর ঢাকার মোহাম্মদপুর
হোষ্টেলে অবস্থানরত পাহাড়ি শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সে মিটিঙেই
অনেক আলাপ আলোচনার পর গঠিত হয় ‘বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’।
পরদিন ২১ মে লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথে এই সংগঠনের ব্যানারে
প্রথম ও ঐতিহাসিক মৌন মিছিল বের করা হয়েছিল। এরপর থেকে বহু চড়াই উত্রাই
পেরিয়ে, বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে অব্যাহত দমন-পীড়ন, ধরপাকড়, ভূমি বেদখল, নারী
নির্যাতনসহ বিভিন্ন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসহ সকল জাতিসত্তার
মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকারসহ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে এবং
পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সোচ্চার ভূমিকা পালন
করে যাচ্ছে।
১৯৮৯ সাল এবং তার আগে পরে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশে চলছিল সামরিক
শাসন। কোনো ধরনের সংগঠন ও মিছিল মিটিঙ করার পরিবেশ তখন ছিল না।
সামরিক সরকার পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনা ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে তৈরী করে
রেখেছিল। শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রাম দমন করার নামে এলাকায় এলাকায় জারি
রেখেছিল দমন পীড়ন। সে সময় জুম্ম জনগণের ওপর চলছিল নিপীড়নের স্টিম রোলার।
জ্বালাও পোড়াও, হত্যা, গুম, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
প্রায় ৬০ হাজার পাহাড়ি তখন ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত। জনসংহতি সমিতির
সশস্ত্র আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার মতো অবস্থায়। অনেকে আন্দোলন ছেড়ে হয় সরকারের
কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পন করেছে, নতুবা পালিয়ে শরণার্থী শিবিরে লুকিয়ে
থেকেছে। জেলা পরিষদের নির্বাচন বানচাল করতে ব্যর্থ হলে জেএসএস-এর কলাকৌশলও তখন
জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের রঙ বেরঙের চর, দালাল ও প্রতিক্রিয়াশীলরা তখন
বেপরোয়া। তাদের লাগামহীন দাপটে সাধারণ জনগণ ছিল অসহায়। গুচ্ছগ্রাম, আদর্শগ্রাম নামের বন্দীশালায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠছিল। সেনাদের পাশ ছাড়া
কোথাও যাওয়া যেত না, বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা যেত না। এ সময় জুম্ম
জনগণের মধ্যে চরম হতাশা ও অনিশ্চয়তার ঘোর অমানিশায় ছেয়ে গিয়েছিল।
এমনি এক দমবন্ধ করা, শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন
ছাত্র সমাজের লড়াকু-প্রতিবাদী অংশটি কাজ শুরু করে। গোপনে নানা ধরনের কাজের মাধ্যমে জুম্ম
ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করাসহ সকল ধরনের নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের
প্রতিবাদ প্রতিরোধ তারা বজায় রেখেছিল। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সংগঠন
তৈরী করে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। ‘৮৯-র ২০ মে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ গঠন করা হলে
এই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সংগঠনসমূহ পিসিপি’র পতাকাতলে লীন হয়ে যায়।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের গঠন জনমনে আশার আলো জ্বেলে দেয়। তারা নতুন করে
স্বপ্ন দেখার সাহস ফিরে পায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ
হয়।
১৯৯১ সালে প্রসিত বিকাশ খীসা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত
হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিপুল গতি সঞ্চারিত হয়। তার
নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে।
সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদী মিছিল, মিটিং ও শোভাযাত্রায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৯৯২ সালের ১০
এপ্রিল লোগাং গণহত্যার প্রতিবাদে বৈ সা বি উৎসব বর্জন ও ২৮ এপ্রিল লোগাং অভিমুখে
পদযাত্রা, রাঙামাটিতে প্রথম স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন সে সময়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য
ঘটনা, যা পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম কাঁপিয়ে দেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এই নতুন ধরনের ছাত্র-গণআন্দোলনে সেনাবাহিনী দিশেহারা
হয়ে পড়ে। তাদের হাতে ছিল তখনকার শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অস্ত্র ও
কলাকৌশল। কিন্তু জনগণের ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলন মোকাবিলার জন্য তারা ছিল
নিরস্ত্র। ফলে তারা পর্যায়ক্রমে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
তবে শাসকগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনী পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা
আন্দোলন অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। তারা তথাকথিত সম অধিকার
আন্দোলন, পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ গঠন করে
এবং সেগুলো পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে।
বিনা কারণে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা কর্মী ও সমর্থকদের গ্রেফতার ও হয়রানি করা
হয়। কিন্তু এতে আন্দোলন থেমে না গিয়ে বরং আরো বেশী ব্যাপকতা লাভ করে। এভাবে
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করতে ব্যর্থ হলে সেনারা ১৯৯৫ সালের শেষের
দিকে বখাটে ও উচ্ছন্নে যাওয়া পাহাড়ি যুবকদের দিয়ে মুখোশ বাহিনী গঠন করে। কিন্তু ব্যাপক গণপ্রতিরোধের মুখে পরে তারা মুখোশ বাহিনী ভেঙে দিতে বাধ্য
হয়।
পিসিপিকে সংগঠনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুবিধাবাদীতার বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হয়েছে। সুবিধাবাদী আপোষকামীরা সংগঠনকে নিজেদের আখের গোছাবার জন্য, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই আপোষকামী অংশটিকে সংগঠন থেকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আপোষহীন লড়াকু নেতৃত্ব।
![]() |
রাঙামাটির কাউখালী এলাকায় পিসিপি’র একটি দেয়াল লিখন। |
পিসিপির লড়াই সংগ্রাম অব্যাহত গতিতে ছাত্র সমাজসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও সংগঠনটি দেশের প্রগতিশীল অংশের সমর্থন ও সহমর্মিতা আদায় করতে সক্ষম হয়। ছাত্রসমাজের সক্রিয় ভুমিকার কারণে সরকারের দালালসহ সুবিধাবাদী আপোষকামী প্রতিক্রিয়াশীল অংশটি অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই অংশটি ফ্যাসিস্ট হাসিনার আজ্ঞাবাহীতে পরিণত হয়ে বিতর্কিত ‘পার্বত্য চুক্তি’র পক্ষালম্বন করে, তারা “সরকারপন্থী” হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে এই অংশটি এখনো নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নাম ব্যবহার করে তারা আন্দোলনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য সরকারের বি-টিম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
পিসিপি’র প্রধান ধারাটি সংগঠনের মূল আদর্শ ও পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিকে উর্ধ্বে তুলে ধরে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই সংগ্রাম অবিচল রয়েছে। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানেও অংশ নিয়ে পিসিপি’র এ ধারাটি সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল পতাকা সমুন্নত রেখেছে। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামে পোড় খেয়ে লড়াকু জনতা ও ছাত্র সমাজ আজ বুঝতে সক্ষম হয়েছে সত্যিকার লড়াকু ধারার ছাত্র সংগঠনটি হল পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াইরত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ বা পিসিপি।
পার্বত্য চুক্তির পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত সমাধান হয়নি। জনগণের ন্যায্য অধিকার অর্জিত হয়নি। নিপীড়ন-নির্যাতন-হত্যা, সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখল, নারী নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। জনগণের জীবনে আজও শান্তি ফিরে আসেনি। কাজেই আন্দোলন ছাড়া জনগণের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। আর যেখানেই আন্দোলন সেখানে ছাত্র সমাজের রয়েছে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা। পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াইরত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদই ছাত্র সমাজের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারে।
তাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের প্রকৃত অধিকার আদায়
না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র সমাজ ও জনগণকে সাথে নিয়ে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনকামী এই পাহাড়ি
ছাত্র পরিষদকেই আপোষহীনভাবে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
এদিকে, সংগঠন প্রতিষ্ঠার ৩ যুগ পূর্তি উপলক্ষে পিসিপি পোস্টার ও লিফলেট প্রকাশ
করেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে পোস্টারিং, দেওয়াল লিখন করেছে পিসিপির
নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। এবারের পোস্টারের আহ্বান হচ্ছে, “জাতীয় ঐক্যের পথে বাধা ছাত্রবেশী দালাল, শাসকগোষ্ঠীর
লেজুড়, সুবিধাবাদী ও আপোষকামীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন, আসুন, জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে
পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের লড়াই জোরদার করি”।
![]() |
তিন যুগ পূর্তি উপলক্ষে পিসিপি’র প্রকাশিত পোস্টার। |
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে
আজ (২০ মে) সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম মহানগরের চেরাগী পাহাড় মোড়ে ছাত্র সমাবেশ ও র্যালির
আয়োজন করা হয়েছে। এতে
ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে নিহত শহীদ পরিবারবর্গের
প্রতিনিধিগণ উপস্থিত থাকবেন এবং সম্মিলিতভাবে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন।
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখবেন জাতীয় ছাত্র সংগঠনের
আমন্ত্রিত নেতৃবৃন্দ। এতে তিন পার্বত্য জেলা এবং দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা সমাবেশে অংশগ্রহণ করবেন
বলে পিসিপি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।