""

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করে যৌথ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে: ডা. সুশান্ত বড়ুয়া

পিসিপি’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে চট্টগ্রামে র‌্যালি ও সমাবেশ

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ২০ মে ২০২২


বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রাম নগরীতে আয়োজিত সমাবেশে প্রগতিশীল চিকিসক ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলেছেন, যারা নিপীড়িত জনগণের পক্ষে কথা বলে, মাতৃভূমি-পিতৃভূমির রক্ষার জন্য যারা আন্দোলন করে তাদের জীবন বৃথা যেতে পারে না। আমাদের মা যখন ধর্ষিত হয়, আমাদের ভূমিকে যখন কেড়ে নেওয়া হয় তাহলে আমাদের বেঁচে থাকা আর না থাকার কোন কোন পার্থক্য থাকে না। পাহাড়ি জনগণকে লড়াই সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণকে ভাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে হলেও নিজেদেরকে সংগঠিত হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে যৌথভাবে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে।

আজ শুক্রবার (২০ মে ২০২২) বিকাল সাড়ে ৪ টায় র‌্যালী পরবর্তী অনুষ্ঠিত সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।

সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন ডা. সুশান্ত বড়ুয়া

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। শরীরে যতক্ষণ পর্যন্ত রক্ত থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। পাহাড়িদের হারাবার আর কিছুই নেই। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে হবে। শাসক গোষ্ঠী পাহাড়ে ভাগ করা শাসন করে নীতি গ্রহণ করেছে। পাহাড়ে প্রতিটি জাতিত্তাদের সংগঠন করে দিয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি সৃষ্টি করে যাচ্ছে। 

সমাবেশের আগে চট্টগ্রাম নগরীর ডিসি হিল থেকে এক র‌্যালী বের করা হয়। র‌্যালীটি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব প্রদক্ষিণ করে চেরাগী পাহাড় মোড়ে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হয়।


‘শাসকচক্রের নীল নক্সা ভেস্তে দিতে ছাত্র-জনতা এক হোন, দালাল প্রতিক্রিয়াশীল ও লেজুড়দের মুখোশ উন্মোচন করে দিন, পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের লড়াই জোরদার করুন’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে র‌্যালী পরবর্তী সমাবেশে পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি সুনয়ন চাকমার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সুনীল ত্রিপুরার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল চট্টগ্রাম পূর্ব-৩ অঞ্চলে সভাপতি ভূলন ভৌমিক, প্রগতিশীল চিকিসক ডা. সুশান্ত বড়ুয়া, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নীতি চাকমা, প্রমূখ। এছাড়া সংহতি জানিয়ে আরো বক্তব্য রাখেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সোহেল, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনে কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি তিতাস চাকমা, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলে অর্থ সম্পাদক এনি চৌধূরী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সাইফুর রূদ্র। সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অংকন চাকমা। এসময় গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক থুইক্যাচিং মারমা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।


সমাবেশে ভূলন ভৌমিক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সরকারের মূল জায়গায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে আঘাত করতে হবে। বাংলাদেশে যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত পাহাড়ে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন কিংবা সমতলে জগণের মুক্তি হবে না। তাই পাহাড় এবং সমতলে সকল নিপীড়িত মানুষকে একত্র করে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে। পাহাড়ে সেনা ক্যাম্পের নামে ভূমি বেদখল, পর্যটনের নামে ভূমি বেদখল সর্বশেষ লামায় রাবার বাগানের নামে ভূমি বেদখল ৯৭ সালের আওয়ামী লীগ ও জেএসএস এর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন।

বক্তব্য রাখছেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল চট্টগ্রাম পূর্ব-৩ অঞ্চলে সভাপতি ভূলন ভৌমিক

সাদেকুল ইসলাম সোহেল বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বলতে কিছু নেই। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের দখলদারিত্ব। পাহাড় আর সমতলে সংগঠন মিলে আগামী দিনের সংগ্রামকে পরিচালনা করতে হবে। পাহাড় এবং সমতলে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সব ছাত্র-সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে হবে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের ভাষা ইনস্টিটিউট গঠন করে ভাষা কোর্স চালু করার আহ্বান জানান।

সমাবেশে পিসিপি’র সভাপতি সুনয়ন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষে পিসিপি নিরলসভাবে দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই সংগ্রাম করে আসছে। ৩৩ বছরে অনেক গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে পিসিপি’র। শিক্ষার সংগ্রামের পাশাপাশি পাহাড়-সমতলে ভূমি রক্ষার আন্দোলন, নারী নির্যাতন ও শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষে লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছে। পিসিপি ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করে আপোষহীনভাবে শাসকগোষ্ঠীর সকল ধরনের অন্যায় অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শাসকগোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্র ভেস্তে যাওয়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পিসিপি’র নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, ধরপাকড়, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ছাত্র সমাজ আজ দিশাহীন। ছাত্র আন্দোলনের নামে ব্যাঙের ছাতার মতন অনেকগুলো ভূঁইফোড় সংগঠন গড়ে উঠেছে। তারা আন্দোলনের নামে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নাম ভাঙ্গিয়ে ছাত্র সমাজকে বিভ্রান্ত করার অপ্রপয়াস চালাচ্ছে। ছাত্রদের মাঝে আন্দোলন সংগ্রামের বুলি আওড়ালেও প্রকৃতপক্ষে তাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থ ব্যতিত ছাত্রদের ও জনগণের অধিকারের প্রশ্নে তাদের কোন কর্মসূচি দেখা যায় না। ছাত্র সমাজকে এসব সংগঠন থেকে বিরত ও সতর্ক থাকতে হবে।


তিনি বলেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে আন্দোলনকে দমন করতে সরকার-রাষ্ট্রীয় বাহিনী নানান ষড়যন্ত্র করেছিল। জাতীয় বেঈমান, দালাল-প্রতিক্রিয়াশীলরাও আন্দোলনকে বাধা সৃষ্টি করেছিল। নব্বই দশকের সময়ে সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডার ইব্রাহিম, মেজর মাহবুব’র নেতৃত্বে মুখোশ বাহিনী, লায়ন বাহিনী, গ্রপ্রক বাহিনী সৃষ্টি করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণপরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতা-কর্মীদের হত্যা-গুম-অপহরণ করা হয়েছিল। মুখোশ বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে শহীদ অমর বিকাশ নিহত হয়েছিলেন। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারো সেনাবাহিনীর মদদে মুখোশ বাহিনীর আদলে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের আন্দোলনকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। সেনা-সরকারের মদদে এই সন্ত্রাসীরা পিসিপি ও ইউপিডিএফ নেতা-কর্মী, সমর্থকদের হত্যা, গুম-অপহরণ করছে। ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ি স্বনির্ভরে প্রকাশ্য দিবালোকে পিসিপি নেতা তপন-এলটন চাকমাসহ ৭জনকে হত্যা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সরকার-রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও জাতীয় বেঈমানদের মিলিত ষড়যন্ত্র নাসা করে ও সকল ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রসমাজ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে পিসিপি পতাকাতলে সমাবেত হয়ে জনগণের প্রাণের দাবি পূর্ণস্বায়তত্তশাসনের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য তিনি ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।

নারী নেত্রী নীতি চাকমা বলেন, পাহাড়ি নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। তাদেরকে নিজ বাড়িতেও ধর্ষণ-নির্যাতেনের শিকার হতে হচ্ছে। গত কয়েকদিন আগেও সাজেক পর্যটন এলাকা কংলাক পাড়ায় সেটলার কর্তৃক এক ত্রিপুরা কিশোরী ও বান্দরবানে এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ত্রিপুরা নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়াও খাগড়াছড়ি সদরে এক নারীকে গণধর্ষণ ও রামগড়ে ৫ম শ্রেণী পড়ুয়া এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে হিল উইমেন্স ফেডারেশনে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে অপহরণকারী লেঃ ফেরদৌস গংদের এখনো বিচারের আওতায় আনা হয়নি। শুধু তাই নয়, এ যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারী ধর্ষণ-খুন-নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটেছে সেসব ঘটনারও কোন সুস্থ বিচার ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেয়া হয়নি। এই বিচারহীনতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীদের ওপর ধর্ষণ-নির্যাতন-খুন-অপহরণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি পাহাড়ি নারীদের ওপর চলা নিপীড়ন-নির্যাতন প্রতিরোধ করতে নারী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

 





0/Post a Comment/Comments