![]() |
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন মাইকেল চাকমা। |
নিজস্ব প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
ইউপিডিএফের অন্যতম সংগঠক মাইকেল চাকমা বলেছেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের
সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে ‘ইনক্লুসিভ’ বাংলাদেশ বা নতুন বাংলাদেশ হতে পারে না। পার্বত্য
চট্টগ্রামে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু না হওয়া পর্যন্ত সারা দেশে গণতান্ত্রিক
ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।”
শনিবার (১০ মে ২০২৫) সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
এ সময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে সংবিধান অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে দাবি জানানোর বিষয়ে তুলে ধরেন।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবেতিনি বলেন, “স্বায়ত্তশাসনের দাবি শুধু আজকের নয়। ইউপিডিএফের মূল দাবি হচ্ছে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন। গঠনের পর থেকে আমরা এ দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সংবিধানে স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করা হয়নি। ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন হয়েছিল সে সময় দাবি উঠেছিল স্বায়ত্তশাসনের। কিন্তু সে দাবি উপেক্ষিত হয়েছিল। এরপর বহুবার সংবিধান সংশোধন করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।”
“সেজন্য দেশে নতুন সংবিধান প্রণয়ন কিংবা সংস্কারের প্রক্রিয়া
চলমান। এই প্রক্রিয়ায় একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি আমরা সবাই। এখন
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে পাশ কাটিয়েতো ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ বা নতুন বাংলাদেশ হতে
পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু না হওয়া পর্যন্ত বা
পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাশ কাটিয়ে সারা দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে
না” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “১৯৭২ সালের সংবিধানে যদি সমস্যার সমাধান করা হত
তৎপরবর্তী সময়ে আমরা এরকম সমস্যার সম্মুখীন হতাম না। তাই উদ্বেগের সাথে আমাদের আরও
নতুন করে বলতে হচ্ছে। এই বাস্তবতায় এসেও যদি আমরা আগের মতো অবস্থায় থেকে যাই, তাহলে
সেই সমস্যা থেকে যাবে। নতুন করে আরও সংকট তৈরি হবে। এটা হচ্ছে বাস্তবতা, এটা হচ্ছে
আশঙ্কা।”
মাইকেল চাকমা বলেন, আমরা সারাদেশের নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিত মানুষদের
নিয়ে কথা বলি। কিন্তু ইউপিডিএফ যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি সংগঠন তাই আমাদের
প্রথম প্রায়োরিটি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেখানে যে রাজনৈতিক সংগ্রাম চলছে তা নিয়েই
মূলত আমাদের কাজ।
তিনি বলেন, সরকারের যেসব কমিশন রয়েছে সেসব কমিশনের সুপারিশের
বিষয়ে আমরা সুনির্দিষ্ট লিখিত প্রস্তাবনা ও মতামত দিয়েছি। ঐকমত্য কমিশন আমাদের প্রস্তাবনাগুলো
পজিটিভভাবে নিয়েছেন। তারা আমাদের প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনা করবেন বলে আমাদেরকে জানিয়েছেন।
স্বায়ত্তশাসন দাবির বিষয়ে কমিশন আশ্বস্ত করেছে কীনা সাংবাদিকরা
জানতে চাইলে মাইকেল চাকমা বলেন, “তারা সুনির্দিষ্টভাবে আশ্বাস দেয়নি। তবে কমিশন বলেছে
বাংলাদেশকে চারটি স্বায়ত্তশাসিত (চার প্রদেশে ভাগ) অঞ্চলে ভাগ করার প্রস্তাবনা এনেছে।
এক্ষেত্রে আমাদের সেখানে সুযোগ আছে, তার মাধ্যমে ওখানকার সমস্যার সমাধান হতে পারে।
এখন দেশে যদি চারটা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হতে পারলে, পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন নয়, পাঁচটা
কেন নয়?”
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে
আরো বলেন, “স্বায়ত্তশাসন এ কারণে প্রয়োজন যে, প্রত্যেকটি দেশে এরকম প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠির
জন্য, সেটা বাংলাদেশ বাদে আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে
এ ধরনের স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যার দিক দিয়ে যেসব ছোট
ছোট জাতিগুলো রয়েছে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষার
জন্য রক্ষাকবচ হলো স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা। ভূমি অধিকার থেকে শুরু করে তারা যাতে নিজেদের
রক্ষা করতে পারে, আগ্রাসন থেকে তারা যাতে মুক্ত থাকতে পারে সেজন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রের
সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা করলে তাহলে তারা নিজেদের মতো করে থাকতে
পারবে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানে তারা আরো ভালোভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে। আমরা সেই বিশ্বাস
থেকেই স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার দাবি করি।
ইউপিডিএফ সম্পর্কে তিনি বলেন, ইউপিডিএফ জনগণের সমর্থনের একটা
দল। জনগণের একটা দল। ইউপিডিএফের দাবি মানে হলো জনগণের দাবি আর জনগণের দাবি হলো ইউপিডিএফের
দাবি। আমি মনে করি স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে জনগণের কোন দ্বিমত নাই। সেখানকার মানুষ
দীর্ঘদিন ধরে সে দাবি করে আসছেন। সেই ’৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কাল থেকে আজ
পর্যন্ত দাবি তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে সংবিধানে
অন্তর্ভুক্ত করা এবং সেখানকার জনগণকে প্রকৃত অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেয়ার
দাবি জানাচ্ছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে
তিনি বলেন, ‘এই চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। এ চুক্তি
একটি দুর্বল চুক্তি। এ চুক্তির মাধ্যমে সেখানে স্বায়ত্তশাসন কায়েম হয়নি। চুক্তি নিয়ে
এখনো অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু এ চুক্তি এতই দুর্বল ছিল যে, যে কোন সরকার চাইলে
তা বাতিল করতে পারে। এ নিয়ে বোধহয় একটি মামলাও আছে কোর্টে। এ চুক্তির কোন সাংবিধানিক
স্বীকৃতি ছিল না, সাংবিধানিক কোন গ্যারান্টি ছিল না।
তিনি আঞ্চলিক দলগুলোর নিবন্ধনের শর্ত শিথিলের প্রস্তাব দেয়া
হয়েছে জানিয়ে বলেন, “নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন শর্তের কারণে আমাদের দলের নিবন্ধন পাওয়া
সম্ভব না। আঞ্চলিক দলের জন্য আলাদা বিশেষ ব্যবস্থা রাখার জন্য বলেছি।”
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কী প্রস্তাব দিয়েছেন জানতে চাইলে মাইকেল
চাকমা বলেন, "নির্বাচন যত দ্রুত সম্ভব হওয়া অবশ্যই দরকার। নির্বাচন কালক্ষেপণ
করার পক্ষে আমরা নই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করে যেন নির্বাচন দেয়।
একটা গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে যেন ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।"
উল্লেখ্য, সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানতে ও ঐকমত্যে
পৌঁছাতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কমিশন কাজ শুরু করে।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের ওপর ৩৯টি
রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চেয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। এরপর সেই মতামত ধরে সংশ্লিষ্ট দলের
সঙ্গে সংলাপ করছে কমিশন।
আজকে ইউপিডিএফের সাথে সংলাপে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি
অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টোর বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায়
উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, মোহাম্মদ
আইয়ুব মিয়া।
আর মাইকেল চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ প্রতিনিধি দলে ছিলেন বৃহত্তর
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে কেন্দ্রীয় সভাপতি অমল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক
যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জিকো ত্রিপুরা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি
ও ইউপিডিএফ সদস্য সুনয়ন চাকমা।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।