মুক্তমত
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (বর্তমানে ক্ষমতাচ্যুত) শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন সন্তু লারমার ও আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। সংগৃহিত ছবি |
।। সুশোভন চাকমা ।।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি
সমিতির মধ্যেকার স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বয়স আজ ২৭ বছর পূর্ণ হলো। শুধু
বর্ষপূর্তি পালন করেই পার হয়ে গেলো এতগুলো বছর।
দীর্ঘ এই ২৭ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটে গেছে বহু অঘটন। কিন্তু চুক্তির
পুরোপুরি বাস্তবায়ন তো হয়নি, বরং চুক্তিটির ভবিষ্যত পরিণতি কী হবে তা নিয়ে রয়েছে নানা
সংশয়। কারণ চুক্তির ফলে গঠিত আঞ্চলিক পরিষদ আইন বাতিলসহ জেলা পরিষদের কিছু উল্লেখযোগ্য
ধারা বাতিল করে ইতিমধ্যে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে, যা এখন আদালতে লিভ টু আপিলে রয়েছে।
তবে চুক্তি বাস্তবায়ন না হলেও চুক্তির বর্ষপূর্তি এলে দিনটি পালনে প্রতিযোগিতা
লক্ষ্য করা যায়। কেউ শান্তির র্যালি করে, কেউ সভা-সমাবেশ করে, কেউ কনসার্টের আয়োজন
করে। ফানুসও উত্তোলন-কেক কাটার মতো দৃশ্যও আমরা দেখেছি। চুক্তি বর্ষপূর্তিতে এসব তামাশা
দেখলে মনে হয় যেন চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বড়ই শান্তি বিরাজ করছে! কিন্তু
আদতে শান্তি তো নয়ই, উপরন্তু ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামের সেনাশাসনে পাহাড়ি জনগণ আজ চরমভাবে
নিপীড়িত-নিষ্পেষিত।
এই চুক্তির সবচেয়ে ট্রাজেডির দিক হলো- চুক্তির পরবর্তী পাহাড়িদের ওপর
অন্তত দুই ডজনের অধিক সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখলসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের
ঘটনায় যারা জড়িত, যারা চুক্তি লঙ্ঘন করে নতুন নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে চলেছে,
যারা পাহাড়িদের শান্তি হরণের জন্য দায়ি, সেই সেনাবাহিনীই শান্তির বুলি আওড়ায়, উৎসবমুখরভাবে
চুক্তির বর্ষপূর্তি পালন করে, তথাকথিত শান্তি-সম্প্রীতির কনসার্টসহ নানা কিসিমের অনুষ্ঠানের
আয়োজন করে থাকে। পাহাড়ি জনগণের সাথে এর চেয়ে নিষ্ঠুর তামাশা ছাড়া আর কী হতে পারে!
আসলে এসব দেখে মনে হয়, সরকার ও সেনাবাহিনীর কাছে পার্বত্য চুক্তি হলো কেবল সেলিব্রেট
করার বিষয়, বাস্তবায়নের বিষয় নয়। এই চুক্তি যেন তাদের কাছে ‘বিজয়’ দিবস।
আমরা চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২৭ বছর ধরে এটাও প্রত্যক্ষ করছি যে, চুক্তি বর্ষপূর্তির
দিনটি এলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীদের একটি পক্ষ (জনসংহতি সমিতি) হতাশার বাণী শোনায়,
মাঝে মাঝে আন্দোলনের বুলিও আওড়ায়। কিন্তু আন্দোলন তো হয় না, বরং বছর ঘুরে যখন বর্ষপূর্তি
চলে আসে তখন একই হতাশার সুর ভেসে ওঠে তাদের কণ্ঠে। আর অপর পক্ষ (সরকার) নানা আশ্বাসবাণী
শুনিয়ে আর রঙ্গ-তামাশা করে দিনটি পালন করে থাকে।
অবশ্য এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। চুক্তি স্বাক্ষরকারী দল আওয়ামী লীগ
ক্ষমতাচ্যুত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। বর্তমানে
দেশের ক্ষমতায় রয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস রয়েছেন এই
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানের দায়িত্বে। চুক্তির বর্ষপূর্তি উপলক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন
সরকার প্রধান ড. ইউনুসও একটি বাণী দিয়েছেন। তাঁর বাণীতে আওয়ামী লীগ সরকার ও জনসংহতি
সমিতির মধ্যেকার স্বাক্ষরিত চুক্তিকে একটি ‘রাজনৈতিক চুক্তি’ এবং ‘পার্বত্য অঞ্চলকে
পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়’ বলে উল্লেখ থাকলেও চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে কোন
কথা বলা হয়নি। এতে বলা হয়েছে “শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়নের” কথা, বলা হয়েছে “পার্বত্য
জেলাসমূহের ‘নৈসর্গিক সৌন্দর্য সংরক্ষণ ও পর্যটন শিল্পের” প্রসারে নানামুখী সংস্কারের
উদ্যোগ নেয়ার কথা। এ থেকে ধরে নেয়া যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রামে
উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ব্যতীত চুক্তি বাস্তবায়নের পথে এগুবে না।
দীর্ঘ ২৭ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে চাপে ফেলার মতো বড় কোন আন্দোলন
গড়ে তুলতে না পারাটা জনসংহতি সমিতিরই ব্যর্থতা। এটা তাদের অস্বীকার করার কোন সুযোগ
নেই। যদিও ‘অসহযোগ আন্দোলন’ নামে একটি কর্মসূচি ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, তবে মাঝপথে সেটি
কোথায় যে হারিয়ে গেছে তা কেউই জানতে পারেনি। ফলে সরকার চুক্তি লঙ্ঘন করে যা ইচ্ছে
তাই করেই যাচ্ছে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, চুক্তির বর্ষপূর্তির দিনে সরকার-সেনাবাহিনীর পক্ষ
থেকে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়, বাণী দেওয়া হয়, এমনকি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের
প্রতিশ্রুতির কথাও আমরা শুনেছি। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে আন্দোলনের তর্জন-গর্জন
করা হয়, পুরোনো কর্মসূচিতে ফিরে যাবার হুমকিও দেয়া হয়। কিন্তু শেষ বেলায় চুক্তিও
বাস্তবায়ন হয় না, আন্দোলনও হয় না। প্রতারিত হয় সাধারণ নিরীহ শান্তিকামী জনগণ।
[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত]
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।