রোনাল চাকমা
গত ৫ আগস্ট
২০২৪ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুন্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হয়েছে। ১৬ বছর ধরে পেশি শক্তি
ব্যবহার করে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় টিকে ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দেশ ছেড়ে হাসিনা ও
তাঁর গংদের পালাতে হয়েছে, অনেকে ধরা পড়েছে। স্বৈরাচারী হাসিনা আমলে লেখক, ব্লগার, সমালোচক,
ভিন্নমত ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা কেউ নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে বাদ যায়নি।
দেশের দক্ষিণ-পূর্বের
এক কোণে পড়ে ছিল পার্বত্য জনপদ। দীর্ঘ ৫ দশক সেনা শাসনে পিষ্ট। সেনা শাসনে পার্বত্য
জনপদের বহু রাজনৈতিক কর্মী গুম-হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন এবং রাজনৈতিক মামলায় কারাগারে
আটক আছেন, বহু জনগণ উদ্বাস্তু হয়েছেন। হাসিনা পতনের পর মাইকেল চাকমা নামে এক রাজনৈতিক
কর্মী ৫ বছর পর ‘আয়নাঘর’ খ্যাত গোপন বন্দীশালা থেকে মুক্ত হয়েছেন।
পার্বত্য জনপদে
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দমন-পীড়ন শুরু হয়েছিল এক সমাবেশকে কেন্দ্র করে। যদিও শাসকদের বরাবরই
‘এথনিক
ক্লিনজিং বা জাতিগত নির্মূলীকরণ’ এবং ‘এ্যাজিমিলেশন বা আত্তীকরণ’ নীতি কার্যকর ছিল। ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগ এক
নির্বাচনী জনসমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে হাসিনা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ‘কারা রাস্তা অবরোধ করেছে ও জনগণকে
সমাবেশে আসতে বাধা দিয়েছে তাদের দেখে নিব।’ এই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন পার্বত্য জনপদের অধিকারকামী রাজনৈতিক কর্মী
ও অধিবাসীদের।
হাসিনার সমাবেশের
দিন অবরোধের অন্যতম কারণ ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী করে সংবিধানে বাঙালি ভিন্ন জাতিসত্তার
জনগণকে জোরপূর্বকভাবে বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেওয়া এবং পার্বত্য চুক্তি নামে জনগণের
সঙ্গে প্রতারণা বা মশকরা করা। কিন্তু পার্বত্য জনগণ তা মেনে নেয়নি। তাঁর পিতা মুজিবও
একই পথে হেঁটেছিলেন। এম এন লারমাসহ পার্বত্য প্রতিনিধিদের বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোয়ারে
ভেসে নেওয়ার সবক শুনিয়েছিলেন।
হাসিনার হুঁশিয়ারি
ও দাম্ভিকতার ফল পাহাড়ি জনগণ পেয়েছিল ম্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দমনমূলক ১১ দফা নির্দেশনা।
যা ২০১৫ সালে ৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত
মোতাবেক সে বছর ২২ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামে জারি করা হয়। এই নির্দেশনা নিরাপত্তা
বাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা দেয়। মনিপুরের মতন উত্তর-পূর্ব ভারতের বহু রাজ্যে যা কার্যকর
আছে। সেখানে ‘আফ্সা’ বা ইংরেজিতে AFSPA(Armed Forces Special Power ACT) নামে পরিচিত।
১১ দফা নির্দেশনা |
১১ দফা নির্দেশনা সেনাবাহিনীকে ‘ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা’ দিয়েছিল। ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি বনে গিয়েছিলেন পাহাড়ের হর্তাকর্তা। তাঁরই নির্দেশে পাহাড়ে প্রশাসন চলে। ডিসি, এসপি, ইউএনও এগুলো কাঠের পুতুল। সর্বত্র যুদ্ধ যুদ্ধ মহড়া। যখন যাকে ইচ্ছে গ্রেফতার, হয়রানি, জেলে প্রেরণ। ফলে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ কেড়ে নেয়া হয়। বিদেশি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া, সংবাদমাধ্যমের উপর কড়া সেন্সরশীপ আরোপ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়। জিওসি’র মদদে ভাড়াটে সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরি করে অধিকারকর্মীদের হত্যা, গুম ও গণগ্রেফতার কর্মসূচি চলে। ২৪ পদাতিক ডিভিশনের এক জিওসি তো পাহাড়ি জনগণকে ৩০ মিনিট যুদ্ধে শেষ করার প্রকাশ্য হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন (মে’ ২৭, ২০২২)। গত ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর এ পানছড়িতে বিপুল চাকমাসহ ৪ তরুণ নেতা হত্যা তাঁর সর্বশেষ সংযোজন।
১১ দফার মাধ্যমে
লাভবান হয়েছে কতিপয় সেনা কর্মকর্তারা যাঁরা প্রমোশন বাণিজ্য করেছে, বাড়তি বেতন ও সুযোগ-সুবিধা
পেয়েছে। সমতলের ক্যান্টনমেন্টের বিড়াল পাহাড়ে বাঘ বনে যাওয়ার মতন অবস্থা। সেনা কর্মকর্তারা
পর্যটন-রিসোর্টের ব্যবসা করেছে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড়ে ভূমিদস্যু ও মুনাফাভোগী কর্পোরেট
কোম্পানীর টুলস হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। বান্দরবানে কেএনএফ দমনের নামে সেনারা শতাধিক
বম জনগোষ্ঠীর শিশু, নারী ও জনগণকে বিনা বিচারে আটক করে রেখেছে। হাসিনা সরকার পতনের
পরও তাঁদের ছেড়ে দেয়া হয়নি। ২০১৮ সালে সেনাদের ধর্ষণ-নিপীড়নের শিকার হওয়া দুই মারমা
সহোদরার পাশে দাঁড়াতে গিয়ে চাকমা রানী ইয়ান ইয়ানকে পর্যন্ত শারীরিকভাবে হেনস্তা করা
হয়েছে। ’৯৬ সালে কল্পনা চাকমাকে কারা অপহরণ করেছে তা পার্বত্য জনপদ জানে। প্রতিটি
জনপদে নিজস্ব ইন্দ্রিয় থাকে। জনগণ জানে কার দ্বারা কোথায় কি হচ্ছে।
অথচ, হাসিনার
আমলে পার্বত্য চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি সম্পাদনার কারণে তিনি ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কারও
নিয়েছেন। নোবেল শান্তি পুরস্কারে তাঁর নাম প্রস্তাবনাও হয়েছিল। হাসিনার বহু পুরস্কার-উপাধি
জুটলেও পাহাড়ে শান্তি ফিরেন। শান্তির পায়রা অধরা থেকে যায়।
পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী কথা ছিল, ৬টি স্থায়ী ক্যান্টনমেন্ট বাদে পাহাড় থেকে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার হবে। সময় সীমা নির্ধারণ হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫দিনের মধ্যে শান্তিবাহিনী সকল অস্ত্র-গোলাবারুদ সমর্পন করেছে কিন্তু সরকার সেনা প্রত্যাহার তো দূরে থাক আরো বেশি করে ক্যাম্প বৃদ্ধি করেছে। চুক্তির আগে সেনাবাহিনীর ছিল ‘অপারেশন দাবানল’ সংক্ষেপে ‘জ্বালাও পোড়াও নীতি’। এখন হয়েছে ‘অপারেশন উত্তরণ’ অর্থাৎ ‘তথাকথিত বিদ্রোহ পরিস্থিতি উন্নতির নীতি।’ অথচ চুক্তির অপর পক্ষ জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমার ভাষ্য: চুক্তি নামে অস্ত্র জমা দিয়ে সরকার জুম্ম জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে (আজকের কাগজ, ২৯ডিসেম্বর ’০১) এবং চুক্তি আজ কাগুজে চুক্তিতে পরিণত হয়েছে (মুক্তকন্ঠ, ০২ এপ্রিল ’০২) এবং ‘আঞ্চলিক পরিষদ অকার্যকর করে রাখা হয়েছে।’(প্রথম আলো, ২৭ মে ’২৪)
অর্থাৎ পার্বত্য চুক্তি ছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের ধাপ্পাবাজি, প্রতারণা ও দূরভিসন্ধি। তিনি যতটা না পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান চেয়েছেন তাঁর চেয়ে বেশি চেয়েছেন ক্ষমতায় থাকার ‘ট্রাম্পকার্ড’ হিসেবে চুক্তিকে ব্যবহার ও রণক্লান্ত সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ বিরতির মতন সাময়িক স্বস্তি। অবশ্য যুগে যুগে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের চরিত্র এমন তাঁরা কথা দিয়ে কথা রাখে না, প্রতারণার জাল বুনে যায়। যা তৎকালীন জেএসএস নেতৃত্ব বুঝতে পারেনি।
যারা পার্বত্য জনপদকে এখনো সেনা চোখ দিয়ে দেখে ও সমাধান খোঁজে তারা এখনো ভুল পথে হাঁটছে। আশি-নব্বই দশকের মতন কোনো সেনা কর্মকর্তার বয়ান দিয়ে পার্বত্য সমস্যার সমাধান খোঁজা বোকামি ছাড়া কিছু না। পরিস্থিতির বহু পরিবর্তন হয়েছে, চেঙে-মিগিনী-হাজলঙ ও কর্ণফুলীর জল অনেক গড়িয়েছে। যত দমন-পীড়ন অন্যায় হবে, প্রতিরোধও তত বাড়বে। যুগে যুগে সেটা সত্য। ধরণ আর মাত্রা হয়তো ভিন্ন হবে। সম্প্রতি এক আলোচনায় চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় বলছেন, ‘পাহাড়ে গণতন্ত্র এলে বর্ডার আরো শক্ত হবে, বিচ্ছিন্ন হবে না’ (০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
আজকে (১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪) খাগড়াছড়িতে হাজার হাজার সাধারণ ছাত্র-জনতার সমাবেশ জানিয়ে দিচ্ছে, পাহাড় আজও শান্তি চায়। তরুণরা শান্তি চায়। শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্ত অংশীজনদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান চায়। তাঁরা কোন সংঘাত ও বৈষম্য চায় না। তাঁরা আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি ও মান-মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চায়। তাঁরা ২০২৪-এ এসে এক দেশে দুই শাসন ও দুই নীতি কিছুতেই বরদাস্ত করবে না
স্মরণে রাখতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। কেবল মাত্র আলোচনা-সংলাপ এই অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ সমাধান আনতে পারে। অবসান ঘটাতে পারে যুগ যুগ ধরে বঞ্চনাবোধ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে, রাষ্ট্রীয় সংস্কারে পাহাড়ি জনগণকেও অন্তর্ভুক্ত করা। তাঁদের সমস্যার কথা শোনা ও উপলব্ধি করা। হাসিনার মতো সমস্যাকে দীর্ঘায়িত না করা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গণবিরোধী ১১ দফা নির্দেশনা বাতিলপূর্বক সেনা শাসন প্রত্যাহার করে পাহাড়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। এই অঞ্চলকে বাদ দিয়ে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র পূনর্গঠন হতে পারে না। তা হলে ’২৪-এ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রাষ্ট্র সংস্কারের প্রেরণা ও ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। আশা রাখি, নতুন বাংলাদেশ সবার হয়ে উঠবে।#
* রোনাল চাকমা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্র নেতা
[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত ]
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।