""

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর লাগাম টেনে ধরবে কে?

খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমাণ্ডার শরীফ মো: আমান হাসান (গোল চিহ্নিত)-এর নেতৃত্বে আজ (২১ এপ্রিল) ভোরে সেনাবাহিনী খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের পূর্ণ চন্দ্র কার্বারী পাড়ায় অভিযানের নামে ঘরবাড়ি তল্লাশি-ভাঙচুর, জিনিসপত্র তছনছ-লুটপাট ও গ্রামবাসীদের আটক করে হয়রানি করা হয়। সংগৃহিত ছবি


সোহেল চাকমা

গত ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি থেকে জেএসএস (সন্তু) লারমা সমর্থিত পিসিপি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী “অপহরণের” ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে প্রকাশ্যে চলছে ব্যাপক সেনা অভিযান। আটক করে হয়রানি করা হয়েছে ৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। এতে সাধারণ পাহাড়ি জনগণের মধ্যে ছড়িয়েছে আতঙ্ক। পাহাড়িদের জননিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটিয়ে বাড়িঘরে তল্লাশি-ভাঙচুর, আটক, হয়রানি ও জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি'র মাধ্যমে একপ্রকার রাষ্ট্রীয় ম্যান্ডেট নিয়ে পুরোদস্তুর চলছে সেনা-নির্যাতন। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পাহাড়ে এ যেন সেনাবাহিনীর জাতিগত নিপীড়নের মহোৎসব চলছে।

শেখ মুজিবের পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোকে বাঙালি বানানোর হুমকি, জিয়াউর রহমানের সেটলার পুনর্বাসন প্রজেক্ট ও ব্যাপক সেনা মোতায়েন, গণহত্যা এবং এথনিক ক্লিনজিং পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম রুপান্তরিত হয়েছে সেনা কারাগারে। হাসিনার আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্তৃক ১১দফা নির্দেশনা জারীর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনকে পাকাপোক্ত করে ফেলার পর শাসকগোষ্ঠীর কাছে পাহাড়ি জনজাতিরগুলোর অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার উন্মুক্ত সুযোগ তৈরী হয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা যেভাবে আয়নাঘর, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনসহ গণবিরোধী কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের প্রতিবাদী কন্ঠকে দমন করতে চেয়েছিলেন, একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্যাগ দিয়ে চলছে নিপীড়িত পাহাড়ি জনগণের ন্যায্য আন্দোলন দমন ও আধিপত্যবাদ জারী রাখার প্রক্রিয়া।

আরেকদিকে পাহাড়ে বসবাসরত জনজাতিগুলোর মধ্যে টেনে দেয়া হয়েছে বিভাজনের সীমারেখা। জাতিগত বিভেদ- দ্বন্দ্ব- সংঘাত জিইয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে বিভিন্ন ভূঁইফোড় দল-উপদল। নামকাওয়াস্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার জন্য সেনাবাহিনীর সৃষ্ট এসব দল-উপদল দিয়ে জারী রেখেছে প্রক্সি যুদ্ধ।

দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া, সংবাদপত্রের মাধ্যমে পাহাড়িদের ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসী উপমার তত্ত্ব দাঁড় করানো হচ্ছে। সাংবাদিকদেরও ভৃত্য সাংবাদিকতার মনোবৃত্তি পরিহার করতে হবে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে পাহাড়িদের দেশের সমতলের মানুষের কাছে খারাপভাবে উপস্থাপন করার লালসা আসলে সেনা- শাসকগোষ্ঠীর পার্বত্য চট্টগ্রামকে শতবৎসর শাসনের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন।

পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং পাহাড়ি জনজাতিগুলোর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবিচল এক প্রতিজ্ঞ রাজনৈতিক দল হিসেবে ইতিমধ্যে ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) পাহাড়ি জনমনে আস্থা ও নির্ভরতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সেজন্য জন্মলগ্ন থেকে ইউপিডিএফ এর ওপর দমন-পীড়নের স্টীম রোলার চালিয়ে শাসকগোষ্ঠী বরাবরই পার্বত্য চট্টগ্রামের ন্যায্য রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে ভেস্তে দিতে নানামুখী পরিকল্পনা আঁটছে।

রাজনৈতিক কোনো ইস্যূকে কেন্দ্র করে সেনা-শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন কায়দায় ইউপিডিএফ-এর কর্মীদের হত্যা, ধরপাকড় ও সাংগঠনিক এলাকায় গিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে আসছে। ইউপিডিএফ-র অবস্থান করা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ঘরবাড়ি লুটপাট, ভাঙচুর করা হচ্ছে। একটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে ইউপিডিএফ-এর প্রচারপত্র, বিভিন্ন নথিপত্র, বই, পতাকা, কাপড়-চোপড় থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরঞ্চ না থাকাটাই এক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যাপার! দেশের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর এসমস্ত কিছু রয়েছে এবং এসবকিছুকে ব্যবহার করেই সেই রাজনৈতিক দলগুলো দেশের মানুষকে নিয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা বা অনুশীলন করছে। অথচ এ সমস্ত নথিপত্র ব্যবহার করে ইউপিডিএফ'কে সন্ত্রাসী সংগঠন ট্যাগ দিয়ে মিডিয়ায় তা খোলাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পতাকা, প্রচারপত্র, বইয়ের সরঞ্জামাদি থাকার প্রেক্ষিত বা মানদন্ডে ইউপিডিএফ যদি সন্ত্রাসী সংগঠন হয় তাহলে কথিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমতলে যতগুলো রাজনৈতিক দল এ সমস্তকিছু নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করছে তারাও কি সন্ত্রাসী সংগঠনের আওতায় পড়ে না?

মূলত, ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা একটা রাজনৈতিক সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতেই ‘ইউপিডিএফ-এর আস্তানার সন্ধান, উদ্ধারের অভিযান’ ইত্যাদি শিরোনামে সেনাবাহিনী নাটক মঞ্চস্থ করছে। এরপূর্বেও পাহাড়ে সেনাবাহিনীর এ সমস্ত নগ্ন নাটক দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। এর প্রধান একটি কারণ গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসররা পার্বত্য চট্টগ্রামের এখনো বহাল তবিয়তে স্বৈরাচারী ক্ষমতা চর্চা ও প্রয়োগের অবাধ স্বাধীনতা পাচ্ছে।

২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল সেনা কর্তৃক নির্যাতন চালিয়ে রমেল চাকমাকে হত্যা, রাঙামাটিতে বিলাইছড়িতে দুই মারমা কিশোরীর একজনকে ধর্ষণ আরেকজনকে যৌন হয়রানি, ২০১৮ সালে ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি ইয়ংড বৌদ্ধ বিহার এলাকায় ইউপিডিএফ সংগঠক মিঠুন চাকমা'কে হত্যা, ১৮ই আগস্ট স্বনির্ভরে তপন-এল্টন-পলাশ হত্যা, ২০২৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর পানছড়িতে বিপুল-সুনীল-লিটন-রহিন হত্যা কিংবা বান্দরবানে বম জনগোষ্ঠীর ওপর সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কেন রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছিল? সেনাবাহিনীর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মদদে প্রক্সি গ্রুপ ব্যবহার করে পূর্বপরিকল্পিত এসব হত্যাকাণ্ডে কাউকে গ্রেফতার এবং বিচার ও তদন্ত কেন হয়নি? 

গত ১৭ এপ্রিল রাঙামাটির কাউখালীতে মোঃ ফাহিম নামক সেটলার বাঙালি কর্তৃক এক মারমা তরুণীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ ও অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। অথচ প্রশাসন এখনো ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। কেন গ্রেফতার করতে পারেনি সেই প্রশ্নের জবাব কি রাষ্ট্র দিতে পারবে?

সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পাহাড়কে অশান্ত ও জনজীবন বিচ্ছিন্ন করার জন্য খাগড়াছড়ি পানছড়িতে জেএসএস (সন্তু) লারমার সশস্ত্র দল দ্বারা সংঘাত জিইয়ে রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনীর কথিত বন্দুকযুদ্ধে জেএসএস কর্তৃক গত ২০২৪ সালের ১০ নভেম্বর হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও পিসিপি'র চবি শাখার সাবেক সভাপতি মিটন চাকমা'কে। সেদিন তো সেনাবাহিনী কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে আজকের মতো এত তৎপর হতে দেখা যায়নি? পাহাড়ে সেনা ও সেটলার দ্বারা ডজনের অধিক গণহত্যা, কল্পনা চাকমা অপহরণ, অগ্নিসংযোগসহ শত শত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর বিচার ও তদন্তের কোনো মুরোদ নাই কেন রাষ্ট্রের? সুতরাং, পাহাড়ে জাতিগত সংঘাত অব্যাহত থাকার দায় এবং অপহরণ বানিজ্য জিইয়ে রেখে সেনা নির্যাতনের দায় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রণেতা সন্তু লারমা কিংবা আজকের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার কখনো এড়াতে পারে না।

একটা গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে পাহাড়িদের স্বাধীনভাবে জীবন-ধারণ করার অধিকার যেমন রয়েছে তেমনি তাদের জীবনের নিশ্চয়তা দেয়া ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অপহৃতদের উদ্ধারের উছিলায় যেভাবে পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে সেনা-তল্লাশী-ভাঙচুর, নিরীহ গ্রামবাসীদের আটক-গ্রেফতার, হয়রানি ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাতে সাধারণ পাহাড়ি জনগণ বরাবরই উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। জোর যার মল্লুক তার শাসন কখনো একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারে না। অপহৃত উদ্ধার অভিযানের নামে প্রকাশ্যে পাহাড়িদের জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলা স্পষ্টই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনের নগ্নরুপ। সেনাবাহিনীর এসব অগণতান্ত্রিক বর্বর নির্যাতন ও তৎপরতা বন্ধ করা প্রয়োজন। অবিলম্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের ওপর সেনা-নির্যাতন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। না হলে সেনাবাহিনীর লাগাম টেনে ধরবে কে?

* সোহেল চাকমা, এজিএস, পিসিপি, কেন্দ্রীয় কমিটি।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







Post a Comment