সৌম্য চাকমা
জুম্মদের মধ্যে এখন সর্বত্র ‘এগত্তর’, ’এগত্তর’ অর্থাৎ ঐক্যের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
এটা তাদের প্রাণের আকুতি। জাতি হিসেবে জীবন-মরণের বিষয়।
দেশে-বিদেশে অনেকে বলছেন, যারা এগত্তর
হবে না, তাদেরকে বয়কট করা হবে, তাদেরকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে ইত্যাদি। তাদের
এই প্রতিজ্ঞা থেকে বোঝা যায় তারা ঐক্য বিরোধীদের প্রতি কত ক্ষুদ্ধ।
কিন্তু যারা এসব কথা বলছেন তাদেরকে বলতে চাই, কারা ঐক্য চায় না , তারা তো বহু আগেই চিহ্নিত হয়ে আছে। আর গত এক সপ্তাহের আন্দোলনে ঐক্য বিরোধীরা নিজেরাই হাতে কলমে প্রমাণ করে দিয়েছে যে তারা ঐক্য চায় না। তারা মুখে কাঠখোট্টা “ঐক্য চাই না” বলছে না সত্য, কিন্তু তাদের কথাবার্তায় ও চলমান আন্দোলনে তাদের ভূমিকায় তারা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তারা এগত্তর হতে চায় না।
এগত্তর নিয়ে খাগড়াছড়িতে শিক্ষার্থীদের আঁকা একটি গ্রাফিতি |
এই অবস্থায় এগত্তর-পন্থীদের করণীয় কী? যে আন্দোলনের নেতারা শত্রু-মিত্র চিনে না, দালাল-সুবিধাবাদী চিনে না, তারা কখনই সফলভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে না। যারা ঐক্য চায়, তারা যদি কারা ঐক্যের পক্ষে, কারা ঐক্যের বিরোধী সেটা না জানে, তাহলে তারা কখনই ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে না।
যে কোন মহৎ কাজে বাধা আসে। ঐক্যের প্রচেষ্টাও
একটি মহৎ উদ্যোগ। এতে বাধা আসা খুবই স্বাভাবিক। যারা এই বাধাকে চিনতে এবং দূর করতে
পারে, তারাই সফল হয়। মহৎ কাজে সফল হতে সব সময় সোজা, সহজ ও সরল রাস্তা পাওয়া যায়
না। এটা যেন এক্যের উদ্যোক্তাদের মনে থাকে।
ঐক্য বিরোধীদের বা প্রতিপক্ষকে অনেক সময়
শক্তিশালী ও অপরাজেয় মনে হতে পারে। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়
তাদেরকে আপাত দৃষ্টিতে যতটা শক্তিশালী মনে হয়, বাস্তবে তারা ততটুকু শক্তিমান নয়।
বরং তাদের অনেক দুর্বল জায়গা থাকে। গ্রীক পুরাণে এ্যাকিলিজ ছিলেন সেরা যোদ্ধা, কিন্তু
তার দুর্বলতা ছিল পায়ের গোড়ালিতে।
পতনের আগ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকেও অনেক শক্তিশালী
মনে হয়েছে। মনে হয়েছে যেন তার ফ্যাসিস্ট শাসনের কোনদিন অবসান হবে না। কিন্তু তাকে
উৎখাতে যারা নেতৃত্ব দেন, তারা কোন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নেতা নন; তারা হলেন বলতে
গেলে সাধারণ ছাত্রছাত্রী। তাদের কয়েক দিনের আন্দোলনে হাসিনার সরকার ও দল খান খান করে
ভেঙে গেল।
আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐক্য বিরোধীদেরও
অনেক শক্তিশালী মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তারা তা নয়। পণ্ডিত ব্যক্তিরা বলেন শক্তি
চার প্রকার: অস্ত্র শক্তি, অর্থ শক্তি, জ্ঞাতি শক্তি ও জ্ঞান শক্তি। এই শক্তিগুলোর
মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট হলো জ্ঞান শক্তি, আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শক্তি হলো অস্ত্র শক্তি।
অস্ত্র শক্তির চেয়ে কম নিকৃষ্ট শক্তি হলো অর্থ শক্তি। অপরদিকে জ্ঞাতি শক্তি অর্থ শক্তির
চেয়ে উৎকৃষ্ট।
প্রতিক্রিয়াশীলরা সব সময় অস্ত্র শক্তিকে
ভর করে টিকে থাকতে চায়। কিন্তু যদি আন্দোলনকারীরা জ্ঞাতি শক্তি অর্থাৎ জনগণের শক্তির উপর নির্ভর করে
সংগ্রাম করেন তাহলে অস্ত্র শক্তি পরাজিত হয়। ৫ আগস্টের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান ও শেখ
হাসিনার পতন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সুতরাং জ্ঞাতি শক্তি যাদের আছে, অর্থাৎ যাদের পেছনে জনগণ রয়েছে, তাদেরকে
অবশ্যই অস্ত্র শক্তিকে ভয় পেলে চলবে না।
ঐক্য প্রত্যাশীরা যখন এই সত্য উপলব্ধি করবেন, তখন তাদেরকে আর কেউ থামাতে পারবে না। যেমনটা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের থামানো যায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৯০ দশকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতাদেরও থামানো যায়নি। তাদের নেতৃত্বে সে সময় গড়ে ওঠা প্রবল ছাত্র-গণ আন্দোলনে বর্ণচোরা প্রতিক্রিয়াশীল-দালালরা জ্ঞাতি শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিল। এবারও তার পুনরাবৃত্তি হতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই। তা না হলে জাতি হিসেবে জুম্মদের আর অস্তিত্ব থাকবে না। তাই ঐক্যপন্থীদের অবশ্যই জয় লাভের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। #
[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব
মতামতই প্রতিফলিত ]
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।